ঝাল কি আসলেই গরিবের খাবার? 

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: রিসাদ

ওই ঝাল ঝাল খাবার? ওটা তো রজিলদের খাদ্য!  

মুঘল অন্দরমহলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সম্রাট আজ তশরিফ রেখেছেন, কী সৌভাগ্য! সাধারণত সম্রাট যখন এমন ঘোষণা দিয়ে আসেন, বুঝে নিতে হবে বিবির কাছে বসে ওনার পরিপাটি আহার সারার ইচ্ছে হয়েছে। এমন না যে অন্য কোথাও সম্রাটের খাওয়ার জায়গা নেই। একঘণ্টার নোটিশে দুইশ লোকের ব্যাপক ভোজনের ব্যবস্থা মুঘল হেঁশেলে সবসময় রাখা হতো। সেটা চেক, ডবল চেক হয়ে নানা নিরাপত্তায় সম্রাটের সামনে এসে পৌঁছুতো। কিন্তু অন্দরমহলের যখন ব্যাপার, এখানে বিবির হাতের রান্নার, বা বিবির পছন্দের খাবারের একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকতে হবে। 

শুরু হয়েছে খাবার। দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকানো মোমবাতির আলো তৈরী করেছে একটা রোমান্টিক আবহ।  বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আগরবাতির সুবাস। শত পদের খাবার সামনে, সম্রাট কোনোটা চাখছেন, কোনোটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, কোনোটা আবার রানির পীড়াপিড়িতে বেশ কয়েকগাল খাচ্ছেন। হুট করে একটা খাবার খেতে গিয়ে থমকে গেলেন তিনি। ঘি-মালাই-বাদামের সমারোহে যে মুঘল খানা-খাদ্য, এটার ঘ্রাণটা যেন ভিন্নরকম! কী এটা? সম্রাটের চোখে প্রশ্ন।

জাঁহাপনা, আপনার হিন্দুস্তানি দরবারীরা খুব আগ্রহ করে খায় এটা। ঝাল নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এটার মাঝে ওদের মতো মরিচ দেইনি। মরিচ ফেঁড়ে বীজগুলো ফেলে দিয়ে সবুজ শাঁসটা গাভীর দুধে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই শাঁস ফেলে দিয়ে দুধটুকু দিয়েছি মাংসে। খেয়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।

সম্রাট আস্তে করে বললেন, ও… ওই গরীবদের খাদ্য? 

তিনি তো আমাদের মতো বাংলায় বলেননি, ফারসিতে বলেছিলেন, রজিলদের খাদ্য?  

তারপর পাতে নিলেন, ঝালে একটু হু-হা করলেন, বললেন স্বাদটা খারাপ না!

 ওই যে ‘রজিলদের খাদ্য’ বললেন, খাবারের নামটা পরিচিতি পেয়ে গেল এই নামেই। বলুন তো এই খাবারের এখনকার ভার্সনকে আমরা কী বলে ডাকি? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, রেজালা!

গল্পটা মশলা মাখানো, তবে মূল ঘটনা সত্য। মুঘল সম্রাট সত্যিই ‘রজিলদের খাদ্য’ বলে ডেকেছিলেন দাবী খাদ্য গবেষকদের।

এখন প্রশ্ন হলো, ‘রজিল’ বা দরিদ্র মানুষের খাবারকে সম্রাটের মতো উন্নাসিক মানুষের পাতে উঠতে কী করতে হয়েছে? এককথায় উত্তর—ঝালটা ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে।

তাহলে দুর্মুখেরা যে বলে, গরিবমানুষ ঝাল বেশি খায়—সত্যি নাকি ব্যাপারটা? কী অন্যায় ব্যাপার বলেন তো! একটা মানুষ স্রেফ ঝাল বেশি খায় দেখে তাকে একটা ভাগে ফেলে দেবেন? বা তার পূর্বপুরুষ কেমন ছিল হিসাব করে ফেলবেন? বৈষম্যহীন ব্যবস্থা নিয়ে দেশ যখন তোলপাড়, তখন স্বাদের ভিত্তিতে এ কেমন বিভাজন? সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে এর প্রতিবাদে হয়তো ছড়াও লিখে ফেলতেন—

ঝালের আমি, ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা।

এমনটি বলবে না!

আবার, এত এত মানুষ ‘গরিবমানুষ ঝাল খায় বেশি’ কথাটা বলেছে, ঠিক উড়িয়ে দিতে মন চাইলেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফেলুদার মতো আমাদেরও তাই বলতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই!  

সেই ‘কালটিভেট’ করতে আমাদের প্রয়োজন ঝালের সাগরে ডুব দেওয়া। আর সেজন্য প্রথমে দরকার, ঝালের ইতিহাস-পাতিহাসটা হালকা করে ঘুরে আসা। ওটা না জানলে ঝালের পোস্টমর্টেম আর করা যাবে কীভাবে? পাঠক, ঝালের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।

ঝাল মশলার রাজনীতি

দেশীয় যেকোনো খাবারেই আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁচামরিচ ঠাসি। আলুভর্তায় দেই, পান্তাভাতে দেই, মাছ-মাংসের ঝোলে তো দেই-ই। অন্যদিকে, যেসব বিদেশি খাবার আমরা মোটামুটি চিনি, সেগুলোয় কাঁচামরিচটা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই। পাস্তায় কাঁচামরিচ? বার্গারে কাঁচামরিচ? হাহা, মানুষ শুনলে হাসবে তো! ওইসব জায়গায় ব্ল্যাক পিপার ব্যবহার করাই রীতি। এইসব দেখে একটা ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক, কাঁচামরিচ হচ্ছে আমাদের দিশি খাদ্য। জন্ম-জন্মান্তরের ভাই। অন্যদিকে গোলমরিচ বা ব্ল্যাক পিপার হচ্ছে বিদেশি সৎ ভাই। অথচ, পুরো ব্যাপারটাই উল্টো!

১৫২০ বা ৩০ অথবা তার কাছাকাছি সময়ে এই উপমহাদেশে কাঁচামরিচের আগমন। তার আগে আমাদের ঝাল ছিল আদা, লবঙ্গ, দারচিনি, চুইঝাল, গোলমরিচ, বনের মাঝে জন্মানো পিপ্পলি। এই গোলমরিচ নিয়ে আরবরা বাণিজ্যও করত জলপথে। বাণিজ্য বলতে, তারা নিয়ে বিক্রি করত মিশরে। সেই মিশর রোমানদের অধীনে থাকায় মশলা সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপে। সারা ইউরোপ তখন খাচ্ছে এই অঞ্চলের ব্ল্যাক পেপার। ইয়োর কান্ট্রি, আওয়ার পিপার স্যার। উই আর ভেরি প্রাউড স্যার!

ঘটনা এরপর ঘটিয়ে ফেলল মুসলমানরা। তারা মিশরের দখল নিয়ে ফেলে ইউরোপের সাথে কানেকশন দিল ঘ্যাচাং করে। এবার ইউরোপ কী করে? খাবারে একটু ঝাল না হলে হবে কী করে? লাগাও অভিযান, আরবদের ওপর ভরসা না করে নিজেদেরই ভারতবর্ষে আসার পথ বের করতে হবে।

এইভাবেই স্পেনের ক্রিস্টোফার কলম্বাস সাহেব ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন আমেরিকা মহাদেশ! কী অসাধারণ ভুল! সুকুমার রায়ও সম্ভবত তার ননসেন্স রাইমে এমন ‘আবোল-তাবোল’ লিখতে পারতেন না। যাই হোক, কলম্বাস সেখানে মরিচও পান, আর সেটা ইউরোপে নিয়ে আসার পাশাপাশি ইউরোপীয় বণিকদের জন্যও খুলে দেন এক নতুন দুয়ার, ঝাল ব্যবসার দুয়ার।

ওই যে শুরুতে বললাম, ১৫২০-১৫৩০, এরমাঝে কোনো একটা সময়েই পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের জাহাজে ভারতের গোয়া দিয়ে ঝাল ভরা হয়। মানে, গোয়া বন্দরে ঝালের জাহাজ ভেড়ানো হয়। সেই যে উপমহাদেশবাসীর মরিচপ্রেম শুরু, দিনে দিনে তা কেবল বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আর যে ইউরোপের হাত ধরে এ অঞ্চলে মরিচ আসলো, সেই ইউরোপের লোকজন মরিচ খাওয়ায় রয়ে গেল আমাদের কাছে শিশু। 

ইতিহাস-পাতিহাস ঘোরা হলো, এবার ইতিহাস থেকে একটা জোক শোনা যাক। 

উপমহাদেশীয় নেটিভের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত ছিল এক বৃটিশ কর্মকর্তার। বুঝতেই পারছেন, বৃটিশ আমলের জোক। খেলেন-দেলেন, বাড়ি ফিরলেন ভদ্রলোক। সকালে স্ত্রীকে বললেন, এখন আমি জানি, এখানকার নেটিভরা কেন খাওয়ার পর পানি ব্যবহার করে।

স্ত্রী প্রশ্ন করলেন—কেন?  

কারণ আমাদের মতো ওরা টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে আগুন ধরে যেত!

কিন্তু আমরা, মানে উপমহাদেশের মানুষরা, কেন মরিচ বেশি খায়?

তার আগে প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন মরিচ খায়। 

বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করেছেন—ঝাল কোনো স্বাদ না। ঝাল একটা অনুভূতির নাম! ভাবছেন পপুলার একটা ইমোশনাল বাক্য ঝেড়ে দিলাম? না স্যার, ঝালের অনুভূতি তৈরি হয় একধরনের জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা থেকে। আমাদের জিভে প্রায় ১০ হাজার স্বাদগ্রন্থি আর ধারক কোষ থাকে, যা আমাদের পাঁচ ধরনের স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। এই পাঁচ ধরনে ঝালের অস্তিত্ব নেই! কী আছে সেটাও বলে দিচ্ছি, টক, মিষ্টি, তিতা, নোনতা আর উমামি। জিভের ডগা বা অগ্রভাগে মিষ্টি এবং পেছনের দিকটায় তিক্ত বা তেতো স্বাদগ্রাহক থাকে, অগ্রভাগের কিছু পরে এবং মাঝখানে লবণাক্ত বা নোনতা, দুইপাশে টক ও উমামি স্বাদ গ্রহণের জন্য একটা করে অংশ থাকে। কারও যদি উমামির স্বাদ কেমন জানতে ইচ্ছা করে, পনির খান; কিংবা সয়া সস খান। ওটার মাঝে উমামির স্বাদ আছে!

তাহলে এই জ্বালাপোড়া পাওয়ার জন্য মানুষ ঝাল কেন খায়?

এই বিষয়ে একটা গবেষণা আছে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার মনোরোগবিদ পল রোজিনের। তিনি খেয়াল করেন, বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খায় না, মানুষ বাদে। প্রচুর মানুষকে গবেষণার অংশ হিসেবে ঝাল খাইয়ে খাইয়ে তিনি যে পরীক্ষাটা করেছেন, তাতে ঝাল খাওয়ার বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন ভূতের সিনেমা দেখে মানুষ ভয় পেলেও ভৌতিক সিনেমার প্রতি আসক্তির সাথে। রোজিনের কথা, মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যারা অতি নেতিবাচক বিষয়কেও উপভোগ করতে পারে।

ঝাল আসলে মরিচ গাছের আত্মরক্ষার একটা কৌশল। বিভিন্ন মরিচের মধ্যে ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই জিনিস মরিচ ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদে পাওয়া যায় না। এখন তার তো বংশবৃদ্ধি করা দরকার। এইদিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খেলে বীজসুদ্ধো হজম করে ফেলে। তাহলে স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মরিচ খাইয়ে মরিচ গাছের কী লাভ? কাজেই বাড়াও ক্যাপসাইসিন। স্তন্যপায়ী ঠেকাও। সেইসাথে পোকামাকড় ঠেকাও। 

আরেকদিকে, পাখিরা বেশিরভাগই মরিচ খেলে বীজ হজম করে ফেলে না। তারা মরিচ খেলে লাভ। তাই, পাখির টেস্টবাডে মরিচের ঝাল কোনো জ্বালাও-পোড়াও করে না। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা! 

টিয়াপাখিকে দেখবেন কপকপিয়ে মরিচ খায়। তার বিষ্ঠার সাথে মনের আনন্দে চলে মরিচ গাছের বংশবৃদ্ধি। এমন প্রাণীকে খাইয়েই তো লাভ!

মানুষ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা ঝালে এমনই আসক্ত, মরিচ গাছ বছর বছর ঝাল বাড়িয়েও এদের থামাতে পারছে না। একটু পরিসংখ্যান শোনাই, বিবিসির দেওয়া তথ্য। এই তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন। নতুন প্রজন্ম মনে হয় আরও বেশি বেশি ঝাল খাচ্ছে! 

যদি কেউ খুব ঝাল খাবার খায়, একটু খেলেই মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেবে পেট ভরে গেছে! যদিও তাতে না ভরেছে পেট, না পূরণ হয়েছে পুষ্টি!
ঝাল সহযোগে খাওয়ার প্রতীকী ছবি। একেছেন সামিউল

এইবার আসা যাক ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন কেন ঝাল বেশি খায় প্রসঙ্গে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা তিনটা কারণ বলেছেন। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে না, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলোর মানুষের ঝাল খাওয়ার একইরকম কারণ। এর মাঝে তুরষ্ক আছে, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া আছে, মেক্সিকো, আফ্রিকান দেশগুলোও আছে। 

প্রথম কারণ, গরম দেশে খাবার-দাবার ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। কী ছোটোলোক জীব, মানুষ যা খায়, তার সেখানে ভাগ বসাতে হবেই! শীতপ্রধান দেশে তো এইসব ফ্যাসিজম চলবে না! ঠান্ডা আবহাওয়াই ব্যাকটেরিয়াকে সাইজ করে দেবে। গরম দেশে ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে মশলাই ভরসা। অন্যান্য মশলার পাশাপাশি ক্যাপসাইসিন ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে ভালো ভূমিকা রাখে। কাজেই, ঠাসো ঝাল! খাবার ফিট তো রাঁধুনি হিট!

দ্বিতীয় কারণ, ক্যাপসাইসিন শুধু জিভেই জ্বালাপোড়া শুরু করে না, ভালোরকম ঝাল খেলে দেখবেন কপালে চিকন ঘাম দেওয়া শুরু করেছে। আরেকটু খেলে সারা শরীরে ঘাম। এই যে স্বেদগ্রন্থি ঘাম ছেড়ে দিচ্ছে, শরীরের উত্তাপও কিন্তু তাতে যাচ্ছে কমে। গরমের মাঝেও আপনি পাবেন ফুরফুরে এক অনুভূতি। এজন্য হলেও ঝাল খাবেন। ঘামেই শান্তি!

তৃতীয় কারণ, এইরকম গরম আবহাওয়ায় মরিচ ভালো জন্মায়। ব্যস, এই একটা কারণই তো যথেষ্ট মরিচ খাওয়ার জন্য। ফলন বেশি, দাম কম—মানুষের খেতে কী আর লাগে? বাসায় তরকারি নাই? লাগাও মরিচ দিয়ে কোনো ভর্তা। তরকারি পছন্দ না? লাগাও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিমভাজা।

এই পর্যন্ত কারণগুলো শুনে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না যে গরম দেশ হওয়ায় মানুষজন ঝাল বেশি খায়—এর সাথে গরিব হওয়ার সম্পর্ক কী? তাহলে বাকী কারণগুলো শুনুন।

চতুর্থ কারণ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কয়েকটা পাখি আর পোকামাকড়ের জন্য ক্যাপসাইসিন যে বিষ হিসেবে কাজ করে, মানুষ এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগায়। বেশি করে মরিচ খেলে ঘামের সাথে ক্যাপসাইসিনের যে ঘ্রাণ বের হয়, পোকামাকড় তাতেই কাত! এইভাবে আফ্রিকায় মানুষ সেৎসি মাছি ঠেকায়, এদিককার মানুষ ম্যালেরিয়া ঠেকায়।  এবার বলুন আপনি, মশা-মাছি কাদের এলাকায় দেখা যায়? ইউরোপে? আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া জাপানে? নাকি আফ্রিকা, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, কড়াইলের বস্তিতে? তাহলে ঝালটা কারা খাবে? বড়লোকরা?

পঞ্চম কারণ, রাস্তায় বসে এক লোকের খাওয়া দেখছিলাম। খুব যত্ন করে একটা সেদ্ধ আলু ছিলল। তাতে গুচ্ছের মরিচ আর লবণ মেশালো। তারপর সামনে পলিথিনের ওপর রাখা পাহাড়সম ভাতে একটু একটু করে মাখিয়ে গবগব করে গিলে ফেলল। এটা আর কিছু না, দরিদ্র হওয়ার খুব নিষ্ঠুর অর্থনীতি। আপনাকে খুব উত্তেজক আর সস্তা খাবার দিয়ে অনেকখানি ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, নুন দিয়েও সম্ভব। কিন্তু ঝালের যে মজা, নুনে তো ওটা পাবেন না! ডোমিনিক ল্যাপিয়ের তার কলকাতাকে নিয়ে লেখা সিটি অব জয়তে ক্ষুধার সাথে ঝালের একটা সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি কেউ খুব ঝাল খাবার খায়, একটু খেলেই মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেবে পেট ভরে গেছে! যদিও তাতে না ভরেছে পেট, না পূরণ হয়েছে পুষ্টি!

গরিবমানুষের মস্তিষ্কও সম্ভবত খুব দ্রুত অর্থনীতি বুঝে যায়!

ষষ্ঠ কারণ, জিভে লেগেছে ঝাল। শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। সিগন্যাল চলে গেছে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কও তো বসে থাকার বান্দা না! সে সাথে সাথে ছাড়া শুরু করল এন্ডরফিন নামে একধরনের রাসায়নিক। এটা একধরনের নিউরোকেমিক্যাল, বাংলায় বলা যেতে পারে স্নায়বিক রাসায়নিক। এই এন্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেবে আপনার। কিন্তু এই মস্তিষ্কের কাজ কি শুধু ব্যথা কমানো? এই যে ‘ব্যথা’ পেয়ে আপনার মন যে বিষণ্ণ হলো, সেটা ঠিক করবে কে? ইউসুফ সরকার? উঁহু, কাজটা মস্তিষ্কই করবে। শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে আরেক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ করে। যার কারণে আমাদের মধ্যে ভালো লাগা, খুশি থাকা, সুখের অনুভূতি তৈরি হয়।

এইবার, আপনার কাছে জিজ্ঞাসা। মন ভালো করতে আপনি কী করেন? শপিং করেন? ভালো ভালো খাবার খান? দেশে-বিদেশে ঘুরতে যান? এগুলো কিছু করেন না? কী বললেন? ঝাল খান?

অভিনন্দন, আপনি গরীবস। পকেটে পয়সা থাকলে কেউ এত সস্তায় সুখী হওয়ার চেষ্টা করে না।

সপ্তম কারণ, বিখ্যাত আমেরিকান শেফ কাম লেখক অ্যান্থনি বোর্ডেইন প্রায় প্রায়ই বলতেন, গরিবদেশগুলোর খাবারই সবচেয়ে মজা, কারণ মজা না করে তাদের উপায় নাই! যদি গরুর সবচেয়ে ভালো জায়গার অংশটা বা টাটকা অ্যাসপ্যারাগাস প্রতিদিন খাওয়ার মতো অর্থ আপনার হাতে থাকে, তাহলে আপনার খুব ক্রিয়েটিভ হওয়ার দরকার নাই। কিন্তু কসাইয়ের দোকানের মাথার মাংস, ভূঁড়ি, লেজ, জিহবাই যদি আপনাকে বাধ্য হয়ে খেতে হয়, কোনো না কোনো ক্রিয়েটিভ উপায়ে এই রান্না মজা না করে আপনার উপায় নাই। আর ঝাল, মশলা এই ক্রিয়েটিভিটির অন্যতম অস্ত্র।

কী বুঝলেন? অ্যান্থনি বোর্ডেইন তার অভিজ্ঞতায় তার পরিচিত খাবারের কথা বলেছেন। কিন্তু চিন্তা করেন তো নিজের টেবিলের কথা? একদিন দুইদিন পান্তা খেতে ভালোই লাগে। অর্থের কারণে প্রতিদিন যদি এটাই খেতে হয়? কয়দিন পারবেন মশলার, ঝালের  সাহায্য নেওয়া ছাড়া?

নজরুল চাইলে লিখতেও পারতেন— 

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান

তুমি মোরে খাইয়েছ ঝালের বিরান।

তাহলে? গরীবদের বেশি ঝাল খাওয়া কি প্রমাণিত?

২০১৮ সালে চাও মা, জে সং ও আরও কয়েকজন মিলে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, চায়নার মাঝে সিচুয়ান অঞ্চলের খাবার সবচেয়ে ঝাল। আর সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়! অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ঝালের মাত্রা যত কমতে থাকে, সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থাও ততো চাঙ্গা! শেষমেষ মনে হচ্ছিলো, চায়নার কোনো প্রদেশ চমচম খাওয়া শুরু করলে ওদের উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!

কিন্তু খুব বড় পরিসরে এমন আর গবেষণা খুঁজে পাওয়া গেল না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকটাক গবেষণা কিছু দেখা যায়, ফলাফল ওই আগেরটাই। 

সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু হুট করে যদি পিছিয়ে যাই সাড়ে তিনশ বছর? সম্রাট আওরংজেবের আমলে? নিখিল ভারতবর্ষ তখনও ঝাল খেত, ভালোভাবেই খেত। তারা কি গরিবতখন? সেই সময়ে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ কর যারা দেয়, তাদের গরিববলবেন কীভাবে? সেই সময়ের ঝাল-খেকো হিন্দুস্তানীদের ক্ষেত্রে এই ‘গরিব মানেই ঝাল’ তত্ত্ব খাটবে কীভাবে? বা ইউরোপের যখন মধ্যযুগ, খুব কি ঝাল-মশলা খেত তারা? তখনই বা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয়দের’ জন্য এই তত্ত্ব কোথায় যায়?

সম্ভবত ঝাল-তত্ত্ব সময়ের সাথে সাথে চলমান একটা সাইন কার্ভের মতো। সময় কখনও বলবে ঝাল খায় গরীবরা। কখনও বলবে ঝাল খায় ধনীরা, ট্যালট্যালে স্যুপ, নুন ছেটানো মাছ হচ্ছে গরীবদের জন্য। কে জানে?   

তবে, আমার এত কঠিন তত্ত্ব টানার কী দরকার? এখনকার জ্ঞানীগুণীরা যখন বলছেন, হয়তো কিছু চিন্তা করেই বলছেন। ভবিষ্যতে নতুন কোনো তত্ত্ব, কোনো গবেষণার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত মেনে নেওয়াই ভালো যে গরীবরা ঝাল বেশি খায়।

সেক্ষেত্রে সুকুমার রায় হয়তো তার কবিতাটা আবার সংশোধন করে লিখতেন—

ঝালের আমি ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা

চৌধুরী বংশের মেয়ের সাথে

তুই ব্যাটা মিশবি না।

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন