বাকস্বাধীনতা বাছবিচার

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
আলস্যের উকিল
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

বাকস্বাধীনতা কী, অন্তত কাগজে-কলমে, আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কিন্তু এর সীমা-পরিসীমা কতটুকু, বাকস্বাধীনতা ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের মধ্যে সীমারেখাটা ঠিক কোনখানে টানা হবে, এর পরিণতি কী হতে পারে— তার একটা রূপরেখা নির্মাণের চেষ্টা এই লেখাটা।   

‘তুমি যা বলছো আমি তার সাথে একমত নই, কিন্তু তোমার সে কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।’ ভলতয়েয়ারের নামে বহুলপ্রচলিত এই উক্তিটির মধ্যে বাকস্বাধীনতার চেতনা/স্পিরিট সবচেয়ে সফলভাবে ফুটে উঠেছে। বাকস্বাধীনতার মূল অনুষঙ্গ হলো যে কথা আমার শুনতে ভালো লাগছে না, সেটাও কারো বলতে পারার অধিকারের জন্য লড়াই করা। আফটার অল, যে কথা শুনতে ভালোই লাগে সেটাকে তো কেউ থামাতেও যাবে না। সুতরাং, বাকস্বাধীনতা সম্ভবত তখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যখন অপছন্দের কোনো কথা বলা হচ্ছে। গণতন্ত্রের, সহিষ্ণু সমাজকাঠামো গঠনের অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে বাকস্বাধীনতা।    

জাতিসঙ্ঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১৯তম অনুচ্ছেদে এবং আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনে সকল মানুষের যেকোনো মত ধারণ করার ও তা নির্ভয়ে প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে আলাদা করে প্রথম গুরুত্ব আরোপ করেন ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন লিবার্টি’র বিশাল এক অংশ জুড়ে রয়েছে অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশের অধিকার ও প্রয়োজনীয়তার আলাপ। মিলের মতে, বাকস্বাধীনতা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্যই নয়, বরং জাতিগত অগ্রগতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিল মনে করতেন একটা মুক্ত সমাজে অসংখ্য মতামত মার্বেলের মত ঠোকাঠুকি করবে এবং তার মধ্যে দিয়েই কল্যাণকর সত্যের উত্থান হবে। এমনকি একটা অভিমত যদি সত্যও হয়, মিল মনে করে তাহলেও সেটাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করা একটা সুস্থ চর্চা। এই চর্চা সেই সত্যটাকে নির্জীব মৌলবাদে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে, এবং বারবার বিরোধিতার মোকাবেলা করে নতুনরূপে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।  সেজন্য কোনো প্রকার কর্তৃপক্ষের দ্বারা কোনো মত দমন করার একদমই পক্ষপাতী ছিলেন না মিল। তিনি বলেন:
 
‘কোনো অভিমতে অভিব্যক্তি দমন করার মূল খারাপ দিক হলো এটা সমগ্র মানবজাতিকে বঞ্চিত করে; বঞ্চিত করে বিদ্যমান প্রজন্মকে এবং অনাগত প্রজন্মকে; যারা সেই ভিন্নমত ধারণ করে না তাদেরকেই বরং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি সেই অভিমতটা ঠিক হয় তাহলে মানুষ বঞ্চিত হয় ভ্রান্তির বদলে সত্য লাভ করার সুযোগ থেকে। আর যদি অভিমতটা ভুলও হয়, তবুও গোটা প্রজন্ম বঞ্চিত হয় আরো চমৎকার এক সুযোগ থেকে, সেটা হলো ভ্রান্তির সাথে বিরোধের মধ্য দিয়ে সত্যের ব্যাপারে আরো উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত ধারণা লাভ করা।’

ঠিক তথ্য থেকে ভুল তথ্যের পরিশোধনের খাতিরে স্টুয়ার্ট মিলকে একটা সেনসরশিপ ব্যবস্থার কথা বলা হলে, তখন মিল হয়তো বলবেন কোনো নিখুঁত সেনসরশিপ ব্যবস্থা আসলে সম্ভব না। বরং বেশিরভাগ সময়ই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় এমন ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা যা নির্ধারণ করে দিতে চায় কোন ধরণের মতামত প্রচারিত হবে এবং কোনগুলো হবে না। সত্য কিংবা কল্যাণ খুব কম সময়ই তাদের বিবেচ্য থাকে। ইতিহাসে এর অনেক নজির পাওয়া যায়। যেমন, ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক গ্যালিলিও কিংবা ব্রুনোর কণ্ঠরোধের কাহিনি আমরা সবাই জানি। অথচ এখন তাদের মতামতই সত্য বলে গৃহীত। অতএব, সত্যতার নিরিখে কারো মতামত যদি কেউ রোধ করতে চায়, তাহলে তাকে নিশ্চয়তা দিতে হবে সে নিজে সম্পূর্ণভাবে সত্যের দাবিদার। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় তেমনটা হয় না।    
সেজন্যই স্টুয়ার্ট মিল একটা মুক্ত সমাজ ও সেখানে অসংখ্য মতামতের অবাধ প্রচলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে মিলের বক্তব্য সংক্ষেপে এরকম একটা উপপাদ্যে প্রকাশ করা যায়:

সূত্র ১: সত্য অনেক মূল্যবান এবং মানুষকে সত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা অবাধ করে দিতে হবে
সূত্র ২: বাকস্বাধীনতা মানুষকে সত্যে পৌঁছতে সাহায্য করে
সিদ্ধান্ত: অতএব, বাকস্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান এবং বাকস্বাধীনতার  সংরক্ষণ জরুরি

তবে কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা রয়েছে যখন কারো বাকস্বাধীনতা প্রয়োগের ফলে অপর কারো নিরাপত্তা সরাসরি হুমকির মুখে পড়তে। যেমন, বিচারক অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস জুনিয়র স্মরণীয় এক বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, একটা ভিড় গিজগিজে থিয়েটারে “আগুন! আগুন!” বলে চিৎকার করা তো বাকস্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত না। কারণ আপনার সেই মশকরার কারণে অসংখ্য মানুষ আহত, এমনকি নিহতও হতে পারে। 

শুধুমাত্র অন্যকারো ক্ষতি করা থেকে আটকানোর জন্যই সভ্য সমাজের কোনো সদস্যের উপর ন্যায্যভাবে জোর খাটানো যেতে পারে
অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি রায়


এ ক্ষেত্রে এখনো মিলের ‘হার্ম প্রিন্সিপল’ প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। মিলের ‘হার্ম প্রিন্সিপল’- এর  মূল কথা হলো: ‘একমাত্র এই কারণেই একটা সভ্য সমাজের সদস্যের উপর ন্যায্যভাবে জোর খাটানো যেতে পারে। তা হলো তাকে অন্য কারো ক্ষতি করা থেকে আটকানোর জন্য।’  কিন্তু এখানে মিল অত্যন্ত সতর্ক। সরাসরি অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন বক্তব্য ছাড়া কারো মতপ্রকাশের অধিকারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে রাজি নন: ‘যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কোনো বিষয়ে একমত হয়, এবং একজন মানুষ তার বিরুদ্ধমত ধারণ করে, তাহলে পৃথিবীর সবার সেই একজনের কণ্ঠরোধ করা যতটুকু ন্যায্য, সেই একজনের দ্বারাও বাকি প্রত্যেকের কণ্ঠরোধ করা ততটুকুই ন্যায্য।’ 



স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী/ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য

কিন্তু হার্ম প্রিন্সিপল কোন সীমা পর্যন্ত বাকস্বাধীনতাকে রক্ষা করবে সেটা পুরোপুরি স্পষ্ট না। কোনো বক্তব্য কোন পর্যায় পর্যন্ত সরাসরি কারো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটা নির্ধারণ করা বেশ জটিল। যেমন, কথা বলার অবাধ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে যুক্তিটা ক্ষমতাসীনরা দিয়ে থাকে তা হলো নির্দিষ্ট কিছু মতের প্রচারণা রুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন, কেননা তা সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। এই ধারণার প্রচারকদের মধ্যে প্রথম একজন ছিলেন প্লেটো। প্লেটো কবি/শিল্পীদেরকে বহিষ্কৃত কিংবা শিল্পমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করার পক্ষে বিস্তর লিখেছেন তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে। তার মতে, কবিরা সমাজে মিথ্যা ছড়ান। তাছাড়া খারাপ ব্যক্তিদের মহিমান্বিত করার ও অনুসরণীয় ব্যক্তিদের হীন প্রমাণ করার ক্ষমতা কবিদের থাকে। ফলে রাষ্ট্রের ও সমাজের স্থিতিশীলতার খাতিরে এদের কণ্ঠরোধ করার মধ্যে প্লেটো কোনো সমস্যা দেখতে পাননি। অথচ দুঃখের ব্যাপার হলো, প্লেটোর গুরুকে এই অজুহাতেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সক্রেটিসের ব্যাপারে বলা হয় তিনি এথেন্সের যুবসমাজকে কলুষিত করেছিলেন এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিলেন। সক্রেটিসের কাছে সুযোগ ছিল মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে যাওয়ার। শর্ত দেয়া হয়েছিল তিনি যদি বাকি জীবন চুপচাপ কোনো অশান্তি সৃষ্টি না করে অতিবাহিত করতে রাজি হন তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু সক্রেটিস তা মেনে নেননি। যিনি নিজেকে ডাঁশমাছি বা গ্যাডফ্লাই  নামে ডাকতেন, এথেন্সকে বিরক্ত করা, অস্থিতিশীল করাকেই নিজের কর্তব্য বলে মনে করতেন, তার পক্ষে এটা মেনে নেয়ার কথাও না। অর্থাৎ, বেশিরভাগ সময় সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার যুক্তিটাকে রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা ও ভিন্নমতকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।   

আবার, ধর্মপরায়ণ কারো কাছে নিজের ধর্মের ব্যাপারে কোনো সমালোচনা বা কটূক্তি সহ্য করা বেশ কঠিন। এটা তাকে মানসিকভাবে পীড়িতও করতে পারে। কিন্তু সেটা কি কারো মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্বিত করার এখতিয়ার দেয়? ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের জেমস কার্কাপের একটা কবিতা প্রকাশের জন্য সে ‘গে নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদককে জরিমানা ও কারাভোগ করতে হয়। সেই কবিতায় যীশুখ্রিষ্টকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয় যার কারণে বহু খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ভীষণভাবে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। সেসময় পিটার ট্যাচেল লেখেন: ‘খ্রিষ্টান ধর্মকে সকল প্রকার ভিন্নমত ও সমালোচনা থেকে সুরক্ষিত থাকার বিশেষ সুযোগ কেন দেয়া হবে? অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তো এরকম ঢালাওভাবে বিরোধী মত ও ধারণা রুদ্ধ করার অধিকার উপভোগ করে না। বাকস্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার ও শৈল্পিক স্বাধীনতার খাতিরে ধর্মদ্রোহিতার আইনের অবলুপ্তি প্রয়োজন।’ 

এ ব্যাপারে যদিও একটা দাবি আছে যে বাকস্বাধীনতা মানে কাউকে আঘাত করা নয়। কিন্তু তাহলে আবারো আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যেতে হবে। বাকস্বাধীনতা তখনই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক যখন তা কাউকে আঘাত করতে পারে বা কারো অপছন্দের কারণ হতে পারে। যে কথা কারো মধ্যে বিরূপতার জন্ম দেয় না সেটাকে রক্ষা করারও তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এ বিষয়ে অলিভার কামের বক্তব্যও কাছাকাছি: ‘বাকস্বাধীনতা কখনো কারো মনে আঘাত দিতে পারবে না এই ধারণাটাকেও প্রশ্ন করতে হবে। কেননা এখানে ধরে নেয়া হয় যে আঘাত দেয়াটা এড়িয়ে যাওয়াই কর্তব্য। বাকস্বাধীনতা অবশ্যই কখনো-কখনো আঘাত করে থাকে, কিন্তু তাতে কোনো ভুল নেই। বাজে চিন্তার ধ্বংসের মাধ্যমেই জ্ঞান এগিয়ে চলে। আর এ প্রক্রিয়ায় কটাক্ষ ও মশকরাও খুব কার্যকর হাতিয়ার।’  অর্থাৎ এ ধরণের “আঘাত” বা চিন্তার সংঘর্ষ অনেক সময়ই আমাদের মনে চিন্তার নতুন শাখার জন্ম দিতে পারে। মিল যখন বিভিন্ন মতামতের অবাধ প্রচলনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অগ্রগতির কথা বলতে গিয়া হয়তো এই ব্যাপারটাই ইঙ্গিত করেছিলেন। 



তবে, কিছু চরমপন্থী উদাহরণও রয়েছে যেখানে বাকস্বাধীনতার সীমানা টেনে দিতে হয়। যেমন, হেইট স্পিচ বা ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য। হেইট স্পিচ বেশিরভাগ সময় তাদেরকেই আক্রমণ করে যারা ইতোমধ্যে লৈঙ্গিক, আর্থিক, বা সামাজিক অবস্থানের কারণে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্যের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য হয় সমমনা আরো মানুষ জড়ো করা। এমতাবস্থায়, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আরো সহজ শিকারে পরিণত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে একটা বিখ্যাত নজির রয়েছে। ১৯৭৭ সালে নব্য-নাৎসির একটি দল ইলিনোয়ের স্কোকি নামে একটি গ্রামে মিছিল করার পরিকল্পনা করে। সেই গ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল হয় হলোকস্ট থেকে ফিরে আসা লোক, বা তাদের নিকটজনের কেউ হলোকস্টে মৃত্যুবরণ করে। এ ব্যাপারে বিতর্কের তুমুল ঝড় উঠেছিল সে সময়। শেষ পর্যন্ত মিছিলটা যদিও স্কোকিতে হয়নি, কিন্তু শিকাগোরই একটা পার্কে তা সংঘটিত হয়েছিল। এরপর থেকে স্কোকি একটা বাকস্বাধীনতার চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়।

বিশ শতকের দার্শনিক কার্ল পপারের প্রস্তাবিত একটি ধারণা ছিল ‘প্যারাডক্স অফ টলারেন্স” তথা ‘সহিষ্ণুতার গ্যাঁড়াকল।’ এর মূল বক্তব্য হলো, অসহিষ্ণুতাকেও আপনি নিজের সমাজে সহ্য করবেন কিনা? অর্থাৎ, যারা সমাজের নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে, তাদেরকে কোনো স্থান না দিতে বদ্ধপরিকর, আপনি তাদেরকেও স্থান দেবেন কিনা? যদি দেন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি না দেন, তাহলে আপনার সহিষ্ণুতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই জটিলতার জায়গা থেকেই স্কোকি গ্রামের ঘটনাটা এত গুরুত্বপূর্ণ। ঘৃণামূলক বক্তব্যকে আপনার মোকাবেলা করতে হবে পালটা বক্তব্যের মাধ্যমেই। আপনি যদি এই ধরণের মতামত দমন করতে চান, তাহলে তার ফল আরো কদর্য হতে পারে। কেননা জোরপূর্বক এসব ঘৃণ্য বক্তব্যের প্রচারণা দমন করা গেলেও, এই বক্তব্যগুলো যে মনোভাব থেকে জন্ম নেয় সেগুলো আরো ফুঁসে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও একবার যদি ‘ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য’ আখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্যকে নিষিদ্ধ করার চল শুরু হয়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে সেই তকমার সীমানা বাড়তে বাড়তে যেকোনো প্রকার প্রথাবিরোধী মতকে দমনের কাজে তা ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে, সংলাপনির্ভর সংঘর্ষের  মঞ্চ খোলা থাকাই ভালো। সে ক্ষেত্রে, কোনো স্থায়ী পরিবর্তনের সম্ভাবনা আরো বাড়ে।

 

অর্থাৎ, বাকস্বাধীনতার মর্মকথাই এই যে, এমনকি নির্বোধ ঘৃণাজীবীদেরও আমাদের মোকাবেলা করতে হবে বাকস্বাধীনতা দিয়েই। জোরপূর্বক দমন-পীড়ন কেবল সেইসব বিষাক্ত মনোভাবকে নজরের অন্তরালে আরো ফুলে-ফেপে ওঠার সুযোগ করে দেয়।

ইন্টারনেটের যুগে বাকস্বাধীনতা

ইন্টারনেটের কল্যাণে গণমাধ্যমের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে গেছে। যেকোনো বার্তা এখন মুহূর্তে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে এমন এক সময়ে বাকস্বাধীনতার সুফল-কুফল পুনর্মূল্যায়নের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন কোনোপ্রকার জবাবদিহিতা ছাড়া পরিচয় গোপন রেখে যা ইচ্ছা তাই গণপরিসরে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে, অপরদিকে বহু ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে একটা ভিন্ন চিত্রও লক্ষ করা যায়। ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যে অ্যালগরিদম দ্বারা শাসিত সেখানে আপনার সকল তথ্যই এখানে মূলত পণ্য। আর  সেই তথ্য ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়া ভিন্নমতের সাথে পরিচিত করার বদলে আপনি ইতোমধ্যে যেসব ধ্যান-ধারণার সাথে এমনিতেই একমত সেগুলোর সম্মুখীন করে। ফলে চিন্তার সংঘর্ষের বদলে নির্দিষ্ট কিছু ভাবনাবলয়ের মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খেতে থাকি। ক্রমশ আমরা একটা সংকীর্ণ চিন্তাপ্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকি। যার ফলে নতুন কোনো মত বা বক্তব্য আমাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রবলভাবে আক্রান্ত করতে পারে। দেখা গেছে ইন্টারনেটে যেকোনো তর্ক-বিতর্ক খুব সহজেই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। গডউইনের নিয়ম বলে, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বিতর্ক যতক্ষণ ধরে চলতে থাকে, সেখানে ‘নাৎসি’ শব্দটা ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়তে থাকে।’  অর্থাৎ, সহিষ্ণুতার সাথে ভিন্নমত মোকাবেলা করার বদলে অহেতুক তকমা লাগিয়ে দেয়ার কিংবা খারিজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ইন্টারনেটের কল্যাণে একটা স্বস্তির বুদ্বুদে যে আমরা বাস করি, সেই অভ্যস্ততাই হয়তো এই অসহিষ্ণুতার হেতু। 

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন