বাকস্বাধীনতা কী, অন্তত কাগজে-কলমে, আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কিন্তু এর সীমা-পরিসীমা কতটুকু, বাকস্বাধীনতা ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের মধ্যে সীমারেখাটা ঠিক কোনখানে টানা হবে, এর পরিণতি কী হতে পারে— তার একটা রূপরেখা নির্মাণের চেষ্টা এই লেখাটা।
‘তুমি যা বলছো আমি তার সাথে একমত নই, কিন্তু তোমার সে কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।’ ভলতয়েয়ারের নামে বহুলপ্রচলিত এই উক্তিটির মধ্যে বাকস্বাধীনতার চেতনা/স্পিরিট সবচেয়ে সফলভাবে ফুটে উঠেছে। বাকস্বাধীনতার মূল অনুষঙ্গ হলো যে কথা আমার শুনতে ভালো লাগছে না, সেটাও কারো বলতে পারার অধিকারের জন্য লড়াই করা। আফটার অল, যে কথা শুনতে ভালোই লাগে সেটাকে তো কেউ থামাতেও যাবে না। সুতরাং, বাকস্বাধীনতা সম্ভবত তখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যখন অপছন্দের কোনো কথা বলা হচ্ছে। গণতন্ত্রের, সহিষ্ণু সমাজকাঠামো গঠনের অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে বাকস্বাধীনতা।
জাতিসঙ্ঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১৯তম অনুচ্ছেদে এবং আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনে সকল মানুষের যেকোনো মত ধারণ করার ও তা নির্ভয়ে প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে আলাদা করে প্রথম গুরুত্ব আরোপ করেন ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন লিবার্টি’র বিশাল এক অংশ জুড়ে রয়েছে অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশের অধিকার ও প্রয়োজনীয়তার আলাপ। মিলের মতে, বাকস্বাধীনতা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্যই নয়, বরং জাতিগত অগ্রগতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিল মনে করতেন একটা মুক্ত সমাজে অসংখ্য মতামত মার্বেলের মত ঠোকাঠুকি করবে এবং তার মধ্যে দিয়েই কল্যাণকর সত্যের উত্থান হবে। এমনকি একটা অভিমত যদি সত্যও হয়, মিল মনে করে তাহলেও সেটাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করা একটা সুস্থ চর্চা। এই চর্চা সেই সত্যটাকে নির্জীব মৌলবাদে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে, এবং বারবার বিরোধিতার মোকাবেলা করে নতুনরূপে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। সেজন্য কোনো প্রকার কর্তৃপক্ষের দ্বারা কোনো মত দমন করার একদমই পক্ষপাতী ছিলেন না মিল। তিনি বলেন:
‘কোনো অভিমতে অভিব্যক্তি দমন করার মূল খারাপ দিক হলো এটা সমগ্র মানবজাতিকে বঞ্চিত করে; বঞ্চিত করে বিদ্যমান প্রজন্মকে এবং অনাগত প্রজন্মকে; যারা সেই ভিন্নমত ধারণ করে না তাদেরকেই বরং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি সেই অভিমতটা ঠিক হয় তাহলে মানুষ বঞ্চিত হয় ভ্রান্তির বদলে সত্য লাভ করার সুযোগ থেকে। আর যদি অভিমতটা ভুলও হয়, তবুও গোটা প্রজন্ম বঞ্চিত হয় আরো চমৎকার এক সুযোগ থেকে, সেটা হলো ভ্রান্তির সাথে বিরোধের মধ্য দিয়ে সত্যের ব্যাপারে আরো উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত ধারণা লাভ করা।’
ঠিক তথ্য থেকে ভুল তথ্যের পরিশোধনের খাতিরে স্টুয়ার্ট মিলকে একটা সেনসরশিপ ব্যবস্থার কথা বলা হলে, তখন মিল হয়তো বলবেন কোনো নিখুঁত সেনসরশিপ ব্যবস্থা আসলে সম্ভব না। বরং বেশিরভাগ সময়ই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় এমন ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা যা নির্ধারণ করে দিতে চায় কোন ধরণের মতামত প্রচারিত হবে এবং কোনগুলো হবে না। সত্য কিংবা কল্যাণ খুব কম সময়ই তাদের বিবেচ্য থাকে। ইতিহাসে এর অনেক নজির পাওয়া যায়। যেমন, ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক গ্যালিলিও কিংবা ব্রুনোর কণ্ঠরোধের কাহিনি আমরা সবাই জানি। অথচ এখন তাদের মতামতই সত্য বলে গৃহীত। অতএব, সত্যতার নিরিখে কারো মতামত যদি কেউ রোধ করতে চায়, তাহলে তাকে নিশ্চয়তা দিতে হবে সে নিজে সম্পূর্ণভাবে সত্যের দাবিদার। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় তেমনটা হয় না।
সেজন্যই স্টুয়ার্ট মিল একটা মুক্ত সমাজ ও সেখানে অসংখ্য মতামতের অবাধ প্রচলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে মিলের বক্তব্য সংক্ষেপে এরকম একটা উপপাদ্যে প্রকাশ করা যায়:
সূত্র ১: সত্য অনেক মূল্যবান এবং মানুষকে সত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা অবাধ করে দিতে হবে
সূত্র ২: বাকস্বাধীনতা মানুষকে সত্যে পৌঁছতে সাহায্য করে
সিদ্ধান্ত: অতএব, বাকস্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান এবং বাকস্বাধীনতার সংরক্ষণ জরুরি
তবে কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা রয়েছে যখন কারো বাকস্বাধীনতা প্রয়োগের ফলে অপর কারো নিরাপত্তা সরাসরি হুমকির মুখে পড়তে। যেমন, বিচারক অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস জুনিয়র স্মরণীয় এক বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, একটা ভিড় গিজগিজে থিয়েটারে “আগুন! আগুন!” বলে চিৎকার করা তো বাকস্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত না। কারণ আপনার সেই মশকরার কারণে অসংখ্য মানুষ আহত, এমনকি নিহতও হতে পারে।

অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি রায়
এ ক্ষেত্রে এখনো মিলের ‘হার্ম প্রিন্সিপল’ প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। মিলের ‘হার্ম প্রিন্সিপল’- এর মূল কথা হলো: ‘একমাত্র এই কারণেই একটা সভ্য সমাজের সদস্যের উপর ন্যায্যভাবে জোর খাটানো যেতে পারে। তা হলো তাকে অন্য কারো ক্ষতি করা থেকে আটকানোর জন্য।’ কিন্তু এখানে মিল অত্যন্ত সতর্ক। সরাসরি অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন বক্তব্য ছাড়া কারো মতপ্রকাশের অধিকারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে রাজি নন: ‘যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কোনো বিষয়ে একমত হয়, এবং একজন মানুষ তার বিরুদ্ধমত ধারণ করে, তাহলে পৃথিবীর সবার সেই একজনের কণ্ঠরোধ করা যতটুকু ন্যায্য, সেই একজনের দ্বারাও বাকি প্রত্যেকের কণ্ঠরোধ করা ততটুকুই ন্যায্য।’
স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী/ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য
কিন্তু হার্ম প্রিন্সিপল কোন সীমা পর্যন্ত বাকস্বাধীনতাকে রক্ষা করবে সেটা পুরোপুরি স্পষ্ট না। কোনো বক্তব্য কোন পর্যায় পর্যন্ত সরাসরি কারো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটা নির্ধারণ করা বেশ জটিল। যেমন, কথা বলার অবাধ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে যুক্তিটা ক্ষমতাসীনরা দিয়ে থাকে তা হলো নির্দিষ্ট কিছু মতের প্রচারণা রুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন, কেননা তা সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। এই ধারণার প্রচারকদের মধ্যে প্রথম একজন ছিলেন প্লেটো। প্লেটো কবি/শিল্পীদেরকে বহিষ্কৃত কিংবা শিল্পমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করার পক্ষে বিস্তর লিখেছেন তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে। তার মতে, কবিরা সমাজে মিথ্যা ছড়ান। তাছাড়া খারাপ ব্যক্তিদের মহিমান্বিত করার ও অনুসরণীয় ব্যক্তিদের হীন প্রমাণ করার ক্ষমতা কবিদের থাকে। ফলে রাষ্ট্রের ও সমাজের স্থিতিশীলতার খাতিরে এদের কণ্ঠরোধ করার মধ্যে প্লেটো কোনো সমস্যা দেখতে পাননি। অথচ দুঃখের ব্যাপার হলো, প্লেটোর গুরুকে এই অজুহাতেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সক্রেটিসের ব্যাপারে বলা হয় তিনি এথেন্সের যুবসমাজকে কলুষিত করেছিলেন এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিলেন। সক্রেটিসের কাছে সুযোগ ছিল মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে যাওয়ার। শর্ত দেয়া হয়েছিল তিনি যদি বাকি জীবন চুপচাপ কোনো অশান্তি সৃষ্টি না করে অতিবাহিত করতে রাজি হন তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু সক্রেটিস তা মেনে নেননি। যিনি নিজেকে ডাঁশমাছি বা গ্যাডফ্লাই নামে ডাকতেন, এথেন্সকে বিরক্ত করা, অস্থিতিশীল করাকেই নিজের কর্তব্য বলে মনে করতেন, তার পক্ষে এটা মেনে নেয়ার কথাও না। অর্থাৎ, বেশিরভাগ সময় সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার যুক্তিটাকে রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা ও ভিন্নমতকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
আবার, ধর্মপরায়ণ কারো কাছে নিজের ধর্মের ব্যাপারে কোনো সমালোচনা বা কটূক্তি সহ্য করা বেশ কঠিন। এটা তাকে মানসিকভাবে পীড়িতও করতে পারে। কিন্তু সেটা কি কারো মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্বিত করার এখতিয়ার দেয়? ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের জেমস কার্কাপের একটা কবিতা প্রকাশের জন্য সে ‘গে নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদককে জরিমানা ও কারাভোগ করতে হয়। সেই কবিতায় যীশুখ্রিষ্টকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয় যার কারণে বহু খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ভীষণভাবে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। সেসময় পিটার ট্যাচেল লেখেন: ‘খ্রিষ্টান ধর্মকে সকল প্রকার ভিন্নমত ও সমালোচনা থেকে সুরক্ষিত থাকার বিশেষ সুযোগ কেন দেয়া হবে? অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তো এরকম ঢালাওভাবে বিরোধী মত ও ধারণা রুদ্ধ করার অধিকার উপভোগ করে না। বাকস্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার ও শৈল্পিক স্বাধীনতার খাতিরে ধর্মদ্রোহিতার আইনের অবলুপ্তি প্রয়োজন।’
এ ব্যাপারে যদিও একটা দাবি আছে যে বাকস্বাধীনতা মানে কাউকে আঘাত করা নয়। কিন্তু তাহলে আবারো আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যেতে হবে। বাকস্বাধীনতা তখনই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক যখন তা কাউকে আঘাত করতে পারে বা কারো অপছন্দের কারণ হতে পারে। যে কথা কারো মধ্যে বিরূপতার জন্ম দেয় না সেটাকে রক্ষা করারও তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এ বিষয়ে অলিভার কামের বক্তব্যও কাছাকাছি: ‘বাকস্বাধীনতা কখনো কারো মনে আঘাত দিতে পারবে না এই ধারণাটাকেও প্রশ্ন করতে হবে। কেননা এখানে ধরে নেয়া হয় যে আঘাত দেয়াটা এড়িয়ে যাওয়াই কর্তব্য। বাকস্বাধীনতা অবশ্যই কখনো-কখনো আঘাত করে থাকে, কিন্তু তাতে কোনো ভুল নেই। বাজে চিন্তার ধ্বংসের মাধ্যমেই জ্ঞান এগিয়ে চলে। আর এ প্রক্রিয়ায় কটাক্ষ ও মশকরাও খুব কার্যকর হাতিয়ার।’ অর্থাৎ এ ধরণের “আঘাত” বা চিন্তার সংঘর্ষ অনেক সময়ই আমাদের মনে চিন্তার নতুন শাখার জন্ম দিতে পারে। মিল যখন বিভিন্ন মতামতের অবাধ প্রচলনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অগ্রগতির কথা বলতে গিয়া হয়তো এই ব্যাপারটাই ইঙ্গিত করেছিলেন।
তবে, কিছু চরমপন্থী উদাহরণও রয়েছে যেখানে বাকস্বাধীনতার সীমানা টেনে দিতে হয়। যেমন, হেইট স্পিচ বা ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য। হেইট স্পিচ বেশিরভাগ সময় তাদেরকেই আক্রমণ করে যারা ইতোমধ্যে লৈঙ্গিক, আর্থিক, বা সামাজিক অবস্থানের কারণে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্যের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য হয় সমমনা আরো মানুষ জড়ো করা। এমতাবস্থায়, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আরো সহজ শিকারে পরিণত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে একটা বিখ্যাত নজির রয়েছে। ১৯৭৭ সালে নব্য-নাৎসির একটি দল ইলিনোয়ের স্কোকি নামে একটি গ্রামে মিছিল করার পরিকল্পনা করে। সেই গ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল হয় হলোকস্ট থেকে ফিরে আসা লোক, বা তাদের নিকটজনের কেউ হলোকস্টে মৃত্যুবরণ করে। এ ব্যাপারে বিতর্কের তুমুল ঝড় উঠেছিল সে সময়। শেষ পর্যন্ত মিছিলটা যদিও স্কোকিতে হয়নি, কিন্তু শিকাগোরই একটা পার্কে তা সংঘটিত হয়েছিল। এরপর থেকে স্কোকি একটা বাকস্বাধীনতার চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়।
বিশ শতকের দার্শনিক কার্ল পপারের প্রস্তাবিত একটি ধারণা ছিল ‘প্যারাডক্স অফ টলারেন্স” তথা ‘সহিষ্ণুতার গ্যাঁড়াকল।’ এর মূল বক্তব্য হলো, অসহিষ্ণুতাকেও আপনি নিজের সমাজে সহ্য করবেন কিনা? অর্থাৎ, যারা সমাজের নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে, তাদেরকে কোনো স্থান না দিতে বদ্ধপরিকর, আপনি তাদেরকেও স্থান দেবেন কিনা? যদি দেন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি না দেন, তাহলে আপনার সহিষ্ণুতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই জটিলতার জায়গা থেকেই স্কোকি গ্রামের ঘটনাটা এত গুরুত্বপূর্ণ। ঘৃণামূলক বক্তব্যকে আপনার মোকাবেলা করতে হবে পালটা বক্তব্যের মাধ্যমেই। আপনি যদি এই ধরণের মতামত দমন করতে চান, তাহলে তার ফল আরো কদর্য হতে পারে। কেননা জোরপূর্বক এসব ঘৃণ্য বক্তব্যের প্রচারণা দমন করা গেলেও, এই বক্তব্যগুলো যে মনোভাব থেকে জন্ম নেয় সেগুলো আরো ফুঁসে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও একবার যদি ‘ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য’ আখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্যকে নিষিদ্ধ করার চল শুরু হয়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে সেই তকমার সীমানা বাড়তে বাড়তে যেকোনো প্রকার প্রথাবিরোধী মতকে দমনের কাজে তা ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে, সংলাপনির্ভর সংঘর্ষের মঞ্চ খোলা থাকাই ভালো। সে ক্ষেত্রে, কোনো স্থায়ী পরিবর্তনের সম্ভাবনা আরো বাড়ে।
অর্থাৎ, বাকস্বাধীনতার মর্মকথাই এই যে, এমনকি নির্বোধ ঘৃণাজীবীদেরও আমাদের মোকাবেলা করতে হবে বাকস্বাধীনতা দিয়েই। জোরপূর্বক দমন-পীড়ন কেবল সেইসব বিষাক্ত মনোভাবকে নজরের অন্তরালে আরো ফুলে-ফেপে ওঠার সুযোগ করে দেয়।
ইন্টারনেটের যুগে বাকস্বাধীনতা
ইন্টারনেটের কল্যাণে গণমাধ্যমের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে গেছে। যেকোনো বার্তা এখন মুহূর্তে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে এমন এক সময়ে বাকস্বাধীনতার সুফল-কুফল পুনর্মূল্যায়নের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন কোনোপ্রকার জবাবদিহিতা ছাড়া পরিচয় গোপন রেখে যা ইচ্ছা তাই গণপরিসরে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে, অপরদিকে বহু ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে একটা ভিন্ন চিত্রও লক্ষ করা যায়। ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যে অ্যালগরিদম দ্বারা শাসিত সেখানে আপনার সকল তথ্যই এখানে মূলত পণ্য। আর সেই তথ্য ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়া ভিন্নমতের সাথে পরিচিত করার বদলে আপনি ইতোমধ্যে যেসব ধ্যান-ধারণার সাথে এমনিতেই একমত সেগুলোর সম্মুখীন করে। ফলে চিন্তার সংঘর্ষের বদলে নির্দিষ্ট কিছু ভাবনাবলয়ের মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খেতে থাকি। ক্রমশ আমরা একটা সংকীর্ণ চিন্তাপ্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকি। যার ফলে নতুন কোনো মত বা বক্তব্য আমাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রবলভাবে আক্রান্ত করতে পারে। দেখা গেছে ইন্টারনেটে যেকোনো তর্ক-বিতর্ক খুব সহজেই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। গডউইনের নিয়ম বলে, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বিতর্ক যতক্ষণ ধরে চলতে থাকে, সেখানে ‘নাৎসি’ শব্দটা ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়তে থাকে।’ অর্থাৎ, সহিষ্ণুতার সাথে ভিন্নমত মোকাবেলা করার বদলে অহেতুক তকমা লাগিয়ে দেয়ার কিংবা খারিজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ইন্টারনেটের কল্যাণে একটা স্বস্তির বুদ্বুদে যে আমরা বাস করি, সেই অভ্যস্ততাই হয়তো এই অসহিষ্ণুতার হেতু।