স্বৈরাচাররা খান কী?

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

‘এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে বলা কঠিন। তবে মাংসখেকোদের একটা কথা বলতে পারি, পৃথিবীটা একদিন ভেজিটেরিয়ানদের হবে।’  

বলেছিলেন কে? মহাত্মা গান্ধী নাকি? জি না স্যার, যে মানুষটা বলেছিল, স্বৈরাচারী সমাজে তাকে সবাই বস বলে মানে। লোকটার নাম অ্যাডলফ হিটলার। ১৯৪১ সাল, বারুদ-ধোঁয়া-রক্ত-হাহাকারে পৃথিবীটাই তখন একাকার। এমন সময় এই লোক দেবে যুদ্ধের হুঙ্কার, যেন প্রতিপক্ষের প্যান্ট খারাপ হয়ে যায়; এইসব সবজি খাওয়া-টাওয়ার কথা কেন বলছে? সবজির কথা শুনে উদ্যানের লোকরা আবার খুশি হয়ে যাবেন না। হিটলার ভাত-ডালের সাথে মাখিয়ে যে সবজি খাওয়া হয়; তার কথাই বলেছিল। আর বলার কারণটা লালন ফকিরই বলে গিয়েছেন—খাওন ছাড়া দুনিয়া চলে না… 

কী বললেন? লালন খাওন না বলে পাগল বলেছিলেন? বলেছিলেন হয়তো। তবে এটাও সত্য যে খাওন ছাড়া দুনিয়া আসলেই চলে না। সেজন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটা খায়, পাড়ার লালু পাগল খায়, সাগরের তিমি মাছটা খায়, হিমালয়ের সাধু খায়, স্বৈরাচাররাও খায়। কী খেত তারা, কেন খেত—এইসবই আজকে একটু জানার চেষ্টা আরকি। 

ভালো কথা, স্বৈরাচাররা কী খায়, কীভাবে খায়—এইসব আলোচনায় কি তাদের একটু মানবিকভাবে দেখানো হয়ে যায়? মোটেই না। বরং তারা যে অতিমানব টাইপের কিছু না, এক্কেবারে আর দশটা সাধারণ মানুষের কাতারেই, সেটাই আরও ভালো করে স্পষ্ট হয়। এখন আপনি যদি ‘কী? হিটলার ভাত খেত? কী মিল, সেও ভাত খেত! সবকিছুতেই তার কথা মনে পড়ে।’ বলে হু-হু করে কান্না জুড়ে দেন; আপনার ব্যাপার! 

চলুন ঢুকে পড়ি স্বৈরাচারদের খাদ্যজগতে। 

মানুষটার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ক্যাভিয়ার। কোন স্বৈরশাসকের? অ্যাডলফ হিটলার? বা রোমানিয়ান স্বৈরশাসক চসেস্কুর? না, এই ক্যাভিয়ার লাভারের নাম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ! মোটামুটি দুর্ভিক্ষপীড়িত এক দেশ, তার প্রেসিডেন্টের প্রিয় হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম দামি খাবারটা? আহা, সে তো হতেই পারে। যেমন আপনার প্রিয় হতে পারে সোনারগাঁ হোটেলের সোনার রাঙতা দেওয়া জিলাপি। প্রিয় বলেই আপনাকে সবসময় খেতে হবে নাকি? ব্যাপার হলো, এরশাদ সাহেব খেতেন। প্রায় প্রায়ই খেতেন কিনা জানি না, তবে সুযোগ পেলে ক্যাভিয়ার তিনি হাতছাড়া করতেন না।  

ক্যাভিয়ার কেন এত দামি? কারণ এটা স্টার্জন মাছের ডিম। এই অতি দুর্লভ স্টার্জন মাছ পাওয়া যায় কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ অংশে, যেখানে দূষণের হার বেশ কম। সেই দুর্লভ মাছ পাওয়ামাত্র তার পেট চেপে ধরলেই হড়হড় করে ডিম পাওয়া যাবে এমন না। স্ত্রী স্টার্জন ডিম দিতে শুরু করে ২০ বছর বয়স থেকে। ততদিন পর্যন্ত তাকে সময় দিতে হবে। তারপর সেই মাছ ধরে আন, ডিম সংগ্রহ করো, প্রসেস করো, ডিস্ট্রিবিউশন করো—কত কাজ! কাজেই দামটাও চড়া। এরশাদ সাহেব চড়া মূল্য দিতেন, খেতেন। তার পয়সা, তার খুশি। পয়সা কোত্থেকে আসত, এইসব আবার জিজ্ঞেস করতে যাবেন না। 

তিনি আমও যে খেতেন, পত্রিকা ঘাঁটলে এই তথ্য পাওয়া যায়। তবে শখ করে খান নাকি শুধু ঠ্যাকায় পড়লে, এই তথ্য পত্রিকা দিতে পারেনি। ঘটনা হলো পার্টি অফিস থেকে বাসায় এসেছেন এরশাদ, সাথে দলীয় লোকজন কিছু। এরশাদ বারবারই বলছেন, এবার খেতে যাব আমি, কিন্তু ভেতর থেকে ডাক আর আসে না! একটু পর খবর এল ভেতর থেকে, রওশন এরশাদ কোনো কারণে রাগ করেছেন, আজকে ‘ভাত বন্ধ।’ আহা… এত মজা পাওয়ার কী হলো? আপনার ভাত বন্ধ হয় না? এহ, কোথাকার কোন উত্তম কুমার এসেছেন আপনি!  

যা হোক, স্বৈরাচার হলেও, এরশাদের ক্ষুধা তো দমাতে হবে। আম আনালেন, কেটে দিতে বললেন। নিজে খেলেন, উপস্থিত নেতা কর্মীদেরও সাধলেন। আর আমাদের দিয়ে গেলেন মেসেজ, হ্যাঁ, স্বৈরাচাররা ডিনারে আম খায়। অন্তত কিচেনে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে ঠ্যাকায় পড়ে হলেও খায়। 

তার চিরবিদায়ের কিছুদিন আগে প্রকাশ পাওয়া একটা সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম পত্রিকার পাতায়। তিনি খুব সখেদে বলছিলেন, না, এইসব মাংস-টাংস খেতে আর ভালো লাগে না। কোথাও দাওয়াত পেলে আর খেতে ইচ্ছা করে না। বয়স যখন বেড়েছে, গুঁড়া মাছ, সবজি খেতেই ভালো লাগে। 

আমার চোখ চকচক করে উঠল। মাছের প্রসঙ্গ যখন এসেছে, সাংবাদিক নিশ্চয়ই ক্যাভিয়ারের কথা জানতে চাইবেন, এখন আগের মতো ভালো লাগে কিনা। নাহ, সাংবাদিক ওই লাইনেই আর থাকলেন না, চলে গেলেন পলিটিক্যাল প্রশ্নে। যত্তসব বেরসিক! 

বগুড়ার দই তার প্রিয় খাবারের একটা। কার? এরশাদের? উঁহু। হাসিনার? উঁহু। জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের। তা হতেই পারে, বগুড়া তো তারই ‘রাজত্বের’ অংশ তখন; নিজের ‘প্রজাদের’ তৈরি খাবার প্রিয় হবে না? কী তাজ্জব কথা! 

স্বৈরাচারদের শুধু প্রিয় খাবার না, খাদ্যাভিমানও থাকে, সেটা দেখিয়েছিলেন এই ইয়াহিয়া খান। উত্তাল ১৯৭১ সালের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সেই ডাক বাঙালির মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো। ইয়াহিয়া খান দেখলেন অবস্থা সুবিধার না, আলোচনা করতে ঢাকায় এলেন তিনি। বসল বৈঠক, স্বাভাবিকভাবেই তাতে হোস্ট শেখ মুজিব, গেস্ট ইয়াহিয়া খান। অতিথির জন্য বাঙালির স্বভাবসুলভ ঔদার্য্যে নানা রকমের খাবারের আয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান খেলেন না সেসব কিছুই। যতটুকু খেলেন, সেটা না খাওয়ার মতোই। ঢাকার অস্থায়ী বাসভবন থেকে বাবুর্চির রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি, সেটাই খাবেন। খেলেনও তাই। আলোচনায় যেমন এক হওয়া যাচ্ছে না, খাবারেও একই দশা। কী একটা অবস্থা! 

এটা গেল ইয়াহিয়ার খাদ্যাভিমানের অংশ। এবার এর বেগতিক দশার কথা শোনাই। শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনে ততক্ষণে যোগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের বাঙালি পাচক নুরু মিয়া। ড. কামাল হোসেন ঘটনাটা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন এইভাবে—‘জেনারেল পীরজাদা ফোন করে বললেন, দেখেন আপনারা বাঙালিরা তো অতিথিদের ব্যাপারে দুর্বল থাকেন। ইয়াহিয়া তো আপনাদের অতিথি হিসেবে এসেছে। তিনদিন ধরে কোনো রান্না হচ্ছে না। বাবুর্চিরা রান্না করবে না। তারা অসহযোগ করছে। আপনারা যদি একটু অনুমতি দেন তাহলে বাবুর্চিরা ওনার (প্রেসিডেন্টের) জন্য কিছু গরম খাবার তৈরি করতে পারে।’  

শেখ মুজিব অনুমতি দিলেন ডাল-রুটি রান্না করতে। সেটাই খেয়ে ইয়াহিয়া প্রাণধারণ করলেন। অবশ্য মাঝের দিনগুলোতে তিনি একেবারে না খেয়ে ছিলেন বলা যায় না। কফি আর বিস্কিট খেয়েছিলেন। বগুড়ার দই সম্ভবত তখন আর তার এত প্রিয় ছিল না! 

কফি ইয়াহিয়ার প্রিয় ছিল বোঝা গেল। এই খেয়েই কি তিনি নেশার ঝোঁক সামলাতেন? তাহলে তো হয়েছিলই! বলা হতো এঞ্জিনের মতো ধূম্র উদগীরণ করতেন তিনি। দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার ‘প্রাইভেট লাইফ অভ ইয়াহিয়া খান’ বইতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটা ঘটনা তুলে এনেছেন। ইয়াহিয়া খানের কিছু জেনারেল পাকিস্তানে একটা পার্টির আয়োজন করেছেন। খাবারের আয়োজন, পার্টির সাজসজ্জা দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে একটা ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। তুমুল পার্টির একপর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বেহেড মাতাল হলেন। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরলেন একটা বেলুনের ওপর। ঠাস। ‘গেল গেল, জগজীবন রাম গেল’—হাসিতে প্রায় হাততালি দিয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট। বলে রাখা ভালো, জগজীবন রাম ছিলেন সেসময়ের ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। যা হোক, ইয়াহিয়া সিগারেট চেপে ধরলেন আরেকটা বেলুনের ওপর—ঠাস। ‘এবার গেল ভুট্টো’। 

শেষ আরেকটা বেলুন ফাটালেন। কার নাম বললেন তা আর বলার দরকার নেই, পাঠক হিসেবে আপনি বুদ্ধিমান আমি জানি। তারপর বিখ্যাত গায়িকার হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন। গায়িকার নাম জানতে চাইছেন? থাক থাক… স্বৈরাচারদের খানা-খাদ্য নিয়ে এই লেখা, তাদের প্রেম-মুহাব্বত নিয়ে এত কথার কী দরকার? 

তবে, স্বৈরাচারদের বিষাদ নিয়ে লেখা যেতে পারে। ইরানের সাংবাদিক আমির তাহেরি একাত্তরের সময়টা ইয়াহিয়াকে বেশ কাছে থেকে দেখেছেন। তার কথা অনুযায়ী, অন্তত আড়াই লিটার মদ ইয়াহিয়ার দৈনিক লাগতই। আর মদের প্রভাবটাও মাঝেমাঝে বোঝা যেত, যখন ইয়াহিয়ার ঘর থেকে বদ্ধ মাতালের হুঙ্কার আসত ভেসে—‘মুজিবকে এখান থেকে নিয়ে যাও, সোজা ফাঁসিতে নিয়ে ঝোলাও! এক্ষন ঝোলাও!’ 

‘ফাঁসিতে ঝোলাও’ আরেকজনও বলতেন, তবে সুযোগ পেলে। ভদ্রমহিলার নাম ডোনা র‍্যাচেল, পরিচয় তখন ফাস্টলেডি। তার পতিপ্রবর হলেন ইতালির কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি। ডিনারের সময় হলে দুনিয়া উল্টে যাক, র‍্যাচেলকে পাঁচ সন্তান নিয়ে ডাইনিঙে উপস্থিত থাকতেই হবে। মুসোলিনি আসবেন, গম্ভীর মুখে সালাদ খাবেন। সালাদের ওপর ঢালা হবে অলিভ অয়েল, লেবুর রস আর মুঠো মুঠো রসুনের কুচি। সেই রসুন কুচির পরিমাণ এমন হবে যে বিরাট বোল উপচে পড়তে হবে। স্বৈরাচার সাহেবের একটু গ্যাসের সমস্যা, তাই তার ধারণা রসুন খেলে এই উপদ্রব থেকে মুক্তি পাবেন। র‍্যাচেলের কথা অনুযায়ী, ডিনারের পর মুসোলিনি ঘরে ঢুকলে মনে হতো বিশাল একটা রসুন তার যাবতীয় দুর্গন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছে! কী আর করা, বাচ্চাদের বেডরুমে ঠাঁই নিতেন তিনি।  

‘পেটের ভুটভাট’ সারাতে আরেকটা টোটকাও নিয়মিত চালিয়ে যেতেন মুসোলিনি। সেটা হলো প্রতিদিন তিন লিটার দুধ খাওয়া। আমি ডাক্তার না, তবে মানবজীবন যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বুঝি, তিন লিটার দুধ দৈনিক খেলে গ্যাস্ট্রিকের রোগির পেটের আওয়াজটা ভুটভাট থেকে ধ্রুম-ধ্রাম হয়ে যাওয়ার কথা! বেচারা র‍্যাচেল, তাকে দোষ দিয়ে আর কী লাভ! 

মজার ব্যাপার হলো, এই দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা যেন হিটলার না জানেন, সেজন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যেতেন মুসোলিনি। তার ধারণা ছিল, দুধ খাওয়ার মতো ভালো-ছেলে টাইপের একটা কাজ হিটলারের কাছে যথেষ্ট ‘ফ্যাসিস্ট-সুলভ’ মনে হবে না! 

এই যে, কান টানলে যেমন মাথা আসে, এক স্বৈরাচারের কথায় কথায় এসে পড়েছে আরেক স্বৈরাচার। কুখ্যাত হিটলার, যাকে স্বৈরাচারদেরও স্বৈরাচার বলে উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু তার খাদ্যাভ্যাস যেকোনো নিরীহ লোকের চেয়ে যেন মিনমিনে। সকালে উঠে লোকটা খাবে ওটসের সাথে ফলমূল, ভেষজ চা। কোনো কোনোদিন স্বাদ বদলাতে রুটির সাথে জ্যাম। 

মাংস? ছি ছি ছি… এইসব ‘বর্বর’ খাবার আর হিটলার? কখনও না! হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে স্কোয়াব খাওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু সেটা কেউ যেন না জানে! স্কোয়াবটা কী জিনিস? ওই যে চার সপ্তাহ বয়সী বাচ্চা কবুতরের মাংস হালকা একটু ভাজা ভাজা, একটু রোস্ট টাইপ। 

তাহলে স্বৈরাচার সাহেব খান কী? দুনিয়ার তাজা শাকসবজি, স্যুপ, পাস্তা, ভাত, সয়াবিন। সয়াবিন তো তিনি এমনভাবে খেতেন যে এর নামই বাজারে চাউর হওয়া শুরু করেছিল নাজি-বিন নামে। কেন এসব খেতেন হিটলার? কারণ তারও পেটের সমস্যা! মাছ-মাংস ‘হারাম’।  ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অমান্য করবে, এমন সাধ্য স্বৈরাচারেরও নেই। 

মদটা খেতেন হিটলার কালেভদ্রে, সেটাও শুধু বিয়ার আর ওয়াইন। বরং মিষ্টি খাবার মুখ তার। পেস্ট্রি, ক্যান্ডি—এসব পেলে ছাড়াছাড়ি নেই। চকলেট খাওয়া শুরু করে মিটিং পিছিয়ে দিয়েছেন এমন নজিরও আছে।  

এই যে নিরীহ খাবার-দাবার খেয়ে যাচ্ছে লোকটা, তার আগে প্রতিবেলায় কিন্তু ঘটত একটা নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। আর সেটা যেত ১৫ জন তরুণীর একটা ফুড টেস্টিং টিমের ওপর দিয়ে। নামেই ফুড টেস্টার, আসলে তাদের মূল কাজ খাবারে বিষ আছে কিনা সেটা পরখ করা। হিটলারের সবসময় ভয় ছিল বৃটিশরা যেকোনো ভাবেই হোক তার খাবারে বিষ মেশাবে। 

তা ফুড টেস্টাররা কীভাবে বিষ পরখ করবে? খুব সরল ব্যাপারটা। ১৫ জনকেই হিটলারের জন্য প্রস্তুত করা খাবারটা খাওয়াও, ঘড়ি ধরে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করো। যদি ওরা না মরে, অসুস্থ না হয়ে পড়ে, ফ্যুয়েরারকে গিয়ে বল যে জাঁহাপনা, খাবার প্রস্তুত। আর ফুড টেস্টাররা মরলে বাবুর্চি যারা আছে ব্রাশফায়ার করে ফেলে দাও! 

এই ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জনকে জার্মানির পতনের পর গুলি করে মারে রাশিয়ান আর্মি। বেঁচে গিয়েছিল একজন—মার্গট ওয়ল্ক। হিটলার আত্মহত্যার আগেই পালিয়ে যাওয়ায় জানে বেঁচে যায় সে, তবে টানা ১৪ দিন সোভিয়েত আর্মির হাতে ধর্ষিত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি সারাজীবনের সঙ্গী হয়েছে তার। হিটলারের জন্য ফুড টেস্টিং নিয়ে ১৯১২ সালে মার্গটের দেওয়া জবানীর একটা অংশ শোনা যাক—কিছু মেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই খাবার খাওয়া শুরু করত। কারণ প্রচণ্ড মৃত্যুভয় নিয়ে আমাদের সব খাবার খেতে হতো। খাওয়ার পর আমরা অপেক্ষা করতাম কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। যখন দেখতাম আমরা বেঁচে আছি, তখন সবাই কুকুরের মতো চিৎকার করে কাঁদতাম।

হিটলার নিরামিষ খেতেন, তবে টেবিলে অন্যান্য অফিসারদের জন্য মাছ-মাংস থাকত। অন্যদের হিটলার এগুলো খেতে না করতেন না, তবে কেউ খেলে মরা-খাদক বলে ঠাট্টা করতেও ছাড়তেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে হিটলার খেতেন শুধু ক্লিয়ার স্যুপ আর ম্যাশড পটেটো। তার প্রিয় অনুচর গ্যোয়েবলস প্রায়ই এটাসেটা বলে ডিনারের টেবিল থেকে সটকে পড়তেন। কাঁহাতক আর ‘শবাহারী’ খোঁটা শুনতে ভালো লাগে? আরেক পারিষদ বরম্যান অবশ্য এই দিক দিয়ে পাক্কা। দিব্বি হিটলারের সাথে স্যুপে চুমুক দিতেন, কচরমচর করে গাজর চিবাতেন; তারপর হিটলারকে ডিনারের জন্য অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নিজের বাঙ্কারে ফিরে সাঁটাতেন পর্ক চপ, কাটলেট আর বাছুরের স্নিৎজেল!  

বেশিরভাগ স্বৈরাচারীই খেয়ে গেছেন ঠিক তার অঞ্চলের প্রচলিত খাবারটা
অলংকরণ: রাজিব কান্তি রায়

এইরকম মাংস চিবানোর ব্যাপারে কিঞ্চিৎ গুজব আছে উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিনকে নিয়েও। এই মাংসটা নরমাংস। সাংবাদিক অনিতা সুরিউইচ ‘ডিক্টেটরস উইথ স্ট্রেঞ্জ ইটিং হ্যাবিটস’ নামের একটা ফিচার লিখতে গিয়ে ইদি আমিনকে ‘আপনি ক্যানিবাল কিনা’ প্রশ্ন করলে, উত্তর পেয়েছিলেন, আরে না, আমি নরমাংস খুব একটা পছন্দ করি না। এইরকম নোনতা নোনতা মাংস এত শখ করে খাওয়ার কী আছে? 

লোকটা রসিকতা করল নাকি? কে জানে! ডিক্টেটর মানুষ, অনিতা আর ডিটেইলসে জিজ্ঞেস করতে যাননি। 

স্বৈরাচারদের এমন খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করলে একটা মজার জিনিস পাওয়া যায়। তারা যতই মানুষের কাছ থেকে দূরে সরা শুরু করে, খাবার নিয়ে খুঁতখুতানি তাদের ততই বেড়ে যায়। খাবারের ‘বিশুদ্ধতার’ দিকে এমনভাবে তারা কড়াকড়ি শুরু করে, যেন মানুষের জন্য না, আকাশের দেবতার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা হচ্ছে! এই যেমন কিম জং ইলের কথাই ধরা যাক। হ্যাঁ, উত্তর কোরিয়ার এখনকার সুপ্রিম লিডার কিম জং উনের বাবার কথাই হচ্ছে।  তিনিও ছিলেন সুপ্রিম লিডার। হিটলারের মতো ফুড টেস্টার হিসেবে তারও ছিল এক প্রমীলা বাহিনী। বিষ-টিষ আছে কিনা তা তো চেখে দেখতই, তার ওপর প্রতিটা ভাতের কণা সমান ও একই রঙের রয়েছে কি না, তা ভাল করে পরীক্ষা করতেন তারা। সুপ্রিম লিডারের খাবার বলে কথা, প্রতিটা ভাত যমজের মতো একরকম না হলে কি চলে? 

কোরিয়া থেকে আমাদের অঞ্চলে আবার একটু ফিরি। আসামের চা বেশ কড়া, দার্জিলিঙের চা বেশ সুগন্ধি। দুটার কম্বো করে কড়া লিকারের সুগন্ধি চা বানিয়ে কে খায় বলুন তো? মোদী? না। মমতা? না। যে খায়, তার নাম শেখ হাসিনা। 

জানি, আপনারা একেবারেই চমকে উঠছেন না। নিত্য-নতুন রেসিপি তো তিনি আর আজকে থেকে দিচ্ছেন না! এই জন্যই এদেশবাসী সময়ে সময়ে পায় মাংসের বদলে কাঁঠালের বার্গারের রেসিপি, মিষ্টি কুমড়ার বেগুনীর রেসিপি, পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি, মাছের কাঁটা গলিয়ে নরম করে গিলে খাওয়ার রেসিপি। এছাড়াও তার থেকে পাওয়া যায় শীতের দিনে ডিম সেদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার টোটকা, টমেটোকে সান-ড্রাইড করার তরিকা। বলতেই হবে, বাংলাদেশের এই স্বৈরাচার রেসিপি তথা রান্নাকে ব্যবহার করেন কূটনীতির অংশ হিসেবে। তাই তাকে দেখা যায় জেলে থাকা অবস্থায় আরেক কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে রান্না করে পাঠাতে, দিল্লীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাড়িতে ভাপা ইলিশ রান্না করতে। সেসময় অবশ্য মমতাও প্রণবের বাড়িতে  গিয়েছিলেন হাসিনার সাথে দেখা করতে। হাসিনা মমতার জন্যও ইলিশ রেঁধেছিলেন। কিন্তু মমতা ‘অত তাড়াতাড়ি আমি রাতের খাবার মুখি তুলি না’ বলে কেন এড়ালেন, কে জানে! 

একইসাথে, খাওয়া-দাওয়ার মজলিশটাকেও হাসিনা পলিটিক্যাল কমিউনিকেশন ফিল্ড হিসেবে ভালোই ব্যবহার করেন। নির্বাচনী প্রচারে মিঠামইন যাওয়া হচ্ছে? ওকে, রাষ্ট্রপতির বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ করা যাক। আমরা খবরে শুনি সেসময়ের রাষ্ট্রপতির পুত্র গম্ভীর গলায় বলছেন, ২০ পদের মাছ রান্না হবে, এরমাঝে শেখ হাসিনার পছন্দ রুই, পাবদা, চিতল। অষ্টগ্রামের পনির প্রায়ই গণভবনে যায়, এবারও যাবে। আর এখানে তো খাওয়ানো হবেই। 

আমরা শুনি, শ্বাস ফেলে ভাবি, এমনই তো মাটির মানুষ হওয়া উচিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর। বাংলার মাটি-বাংলার জলের মানুষ তো মাছই খাবে, পনির পেলে আদর করে কোলে তুলে নেবে। 

শেখ হাসিনা সভা করতে যাবেন রংপুরের পীরগঞ্জে। শ্বশুরবাড়িতে তার জন্য আয়োজন হচ্ছে রুটির সাথে ছোটো ছোটো পিস করা মুরগির মাংস, নানা পদের ভর্তা, অনেকরকম শাক, মাছের নানা আইটেম। এগুলো সবই তার প্রিয় খাবার। আমরা পত্রিকায় পড়ে আকুল হই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতার এগুলোই তো হওয়া উচিত পছন্দের খাবার! সে ভোট দিনের নাকি রাতের, তাতে কী আসে যায়! 

এক জনসভায় আয়োজন করা হয়েছে ৩২ পদের। শেখ হাসিনা আগ্রহ করে খেলেন দুই পদ—কালোজিরার ভর্তা আর টাকি মাছের ভর্তা। নেতাকর্মীরা আবেগে থরোথরো—বঙ্গবন্ধুর কন্যা তো মাছপাগল হবেই। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় আয়োজন করা হয়েছে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর খাবারের। আয়োজন সামান্য—খাসীর মাংস, সবজি, ডাল, সেমাই, ভাত, পোলাও। প্রধানমন্ত্রী পোলাও খেলেন না, আর সব খেলেন। 

পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হোসেন শেখ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যাহ্নভোজের জন্য পোলাও, সাদা ভাত, খাসির মাংস, ডাল, সবজি ও সেমাই করা হয়েছে। তিনি পোলাও ছাড়া বাকি সকল খাবার খেয়েছেন। এর আগে কোনো রাষ্ট্রনায়ক এভাবে নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে খেয়েছেন কিনা আমাদের জানা নেই।

তিনি খাওয়াতে ভালোবাসেন, খাওয়া নিয়ে, খাওয়ার রেসিপি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন, পছন্দের খাবার খেতে ভালোবাসেন। এমনকি, ৫ আগস্টে যখন বহু মানুষ গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ছিল, তখন তার জন্য গণভবনে মজার মজার খাবার তৈরি হচ্ছিল। সে খাবার কী হবে, সেটা তিনি নাকি সকালের চা খেতে খেতে বাবুর্চিকে বলে দিয়েছেন। মানুষ যে কী না… গণভবনে লংমার্চ করবি ভালো কথা,  লাঞ্চের পরে করা যায় না? সেই না খাওয়া খাবার হয়তো তাকে খেতে হয়েছে ভারতের মাটিতে গিয়ে, কে জানে! 

‘আপনি কী খান বলুন, আমি আপনাকে বলে দেব আপনি কে’—বলে গেছেন উনিশ শতকের ফরাসি প্রাবন্ধিক জ্যঁ আঁথেলমা ব্রিলা-সাভারিন। স্বৈরাচারদের খানাখাদ্য নিয়ে বিখ্যাত বই ডিক্টেটর ডিনারসের লেখক ভিক্টোরিয়া ক্লার্ক আর মেলিসা স্কট একে বাড়িয়েছেন আরও—‘আপনি কে, সেটা নির্ভর করে আপনি কী খাচ্ছেন, কীভাবে খাচ্ছেন, কার সাথে খাচ্ছেন তার ওপর। খাবার আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ তো করেই, তার সাথে আপনার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবী নিয়ে আপনার ধ্যান-ধারণাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।’  

আবার, ঠিক কোন খাবারটা খেলে যে আপনি স্বৈরাচারী হবেন, তার কোনো ঠিক নেই। বেশিরভাগ স্বৈরাচারীই খেয়ে গেছেন ঠিক তার অঞ্চলের প্রচলিত খাবারটা। তবে হেহে, অন্যান্য কাজের মতোই, খাবারের ব্যাপারেও তারা রেখে গেছেন স্বৈরাচারীতার লক্ষণ। যা তারা চান, যেভাবে চান, সেটাই হতে হবে। আর না হলে, তারা খাবেন তাদের আরও প্রিয় খাবারটা—কল্লা!   

রাজা যায়, রাজা আসে। হাতেগোনা কয়েকজন স্বৈরাচারীর নাম কিংবা খাদ্যাভ্যাস এখানে আনার চেষ্টা করা হলো মাত্র। যারা অন্তত এই অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত, বা কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক। আরও আছে অজস্র স্বৈরাচার, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পড়ে থেকে মানুষের অনর্গল ঘৃণাই সম্ভবত এখন তাদের একমাত্র খাদ্য। 

হিটলারের ঠিক বিপরীত কথা বলেই আজকের আলোচনা শেষ করা যাক—এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে বলা কঠিন। তবে স্বৈরাচারদের একটা কথা বলতে পারি, পৃথিবীটা একদিন গণমানুষের হবে।

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন