নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জির রচনা: আম ও আদব 

অভিজিৎ ব্যানার্জি
অভিজিৎ ব্যানার্জি
অর্থনীতিবিদ
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

এতদিনকার আগের ঘটনা যে আমার ঠিকমত মনেও নেই কোথায় যাচ্ছিলাম বা কেন যাচ্ছিলাম। ওই যে সবুজ-হলুদ বগিওয়ালা লোকাল ট্রেনগুলো, যেগুলোর খোলা দরজাগুলো কেবল একটা লোহার অর্গল দিয়ে আলাদা করা থাকে, তাতে চড়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। গরমকাল ছিল। একজন সন্ন্যাসী এসে বসলেন দরজার পাশে, ট্রেনের মেঝেতে। কোমরের উপর থেকে তার পরনে কিচ্ছু ছিল না। ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর, তিনি নিজের কাচকির মধ্য থেকে বের করে আনলেন হলুদ-কমলাটে একটা আম, আর নিজের শক্ত বাদামি দুই হাতের মাঝখানে সেটাকে চেপে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর, যখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে আমটা যথেষ্ট নরম হয়েছে, তখন আমটার উপরের দিক দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে চুষতে শুরু করলেন।   

রস চুইয়ে তার লম্বা দাঁড়ি বেয়ে গড়াতে শুরু করলো, তবু তা মোছার কোনো চেষ্টা তার মধ্যে দেখা গেল না। জীবনে এভাবে আমি কাউকে আম খেতে দেখিনি। এখন আমি জানি যে একপ্রকার আম আছে যার নাম হলো চুষি আম। এসব আম এভাবেই খেতে হয়। কিন্তু যে অন্তরঙ্গতার সাথে তিনি আমটাকে দুই হাতের মধ্যে ধরে রেখেছিলেন আর বিশেষ করে যেভাবে ঠোঁট লাগিয়ে খাচ্ছিলেন, তাতে আমাদের কল্পনার জন্য কিছু বাকি থাকলো না। একবারের জন্যেও তিনি আমাদের কারো দিকে তাকাননি, তবুও সবারই মনে হয়ে থাকবে যে তিনি যেন একটা পারফর্মেন্স করছেন আমাদের সামনে। আমাদেরকে কী দেখাতে চাইছিলেন তিনি? যে এই উদাম বক্ষ ও জটপাকানো চুল সত্ত্বে তার জীবনে এক চমৎকার আনন্দ আছে? তার এই আনন্দের সাথে চারুতার কোনো জরুরি সংযোগ আদৌ ছিল না (যদিও তার পুরো কাজটার মধ্যে একপ্রকার চারুতা অবশ্যই ছিল, তবে সেটা বোন-চাইনিজ কাপগুলোর চারুতা না অবশ্যই)। কাউকে কোনোকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি।      

খাদ্যগ্রহণের এ-ধরণের লাগামছাড়া দৃশ্য যাতে দেখতে না হয় সেজন্যই সম্ভবত খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে শিষ্টাচার আবিষ্কার করা হয়েছিল। পাশ্চাত্যে খেতে বসার সময় কোন কোন আচরণ শিষ্টাচারসম্পন্ন বলে ধরা হবে তার নির্ধারক মধ্যযুগের পর থেকে অনেকটাই পালটে গেছে। মধ্যযুগীয় ভোজগুলি তো নাচা-গানা, হৈ-হুল্লোড়, মদ এবং মাংসের নানা পদ মিলিয়ে বেশ জবরদস্ত এন্তেজাম ছিল বলেই জানা যায়। ল্যানক্যাস্টারের ডিউকের জন্য ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড যে ভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন সেটার খাদ্যসূচিতে আমি অন্তত বারো পদের মাংসের হিসাব পেয়েছি। তার মধ্যে ছিল শুয়োরের মাথা, হাঁসের রোস্ট, বন্য শুয়োর, তিতির পাখি, লার্ক পাখি, বক পাখি, খরগোশ, ষাঁড়ের মাংস, সারস পাখি, হরিণের পেশির (এক ধরণের মাংসই হবে) এক ধরণের জেলি। অতিথিরা নিজেরা ছুরি নিয়ে আসতো, এবং সেই ছুরি দিয়ে হাড্ডি থেকে মাংস ছাড়িয়ে হাত দিয়ে খেত। একই পানপাত্রে অনেকে একসাথে খেত। থালা হিসেবে ব্যবহার করা হতো এক টুকরা রুটি অথবা খোদ টেবিলটাকেই। আর অতিথিদের যেতে দেয়ার আগে চামচ গুণে নেয়া হতো। প্রচুর পরিমাণে খাওয়াদাওয়া হতো, হাঁড়ি-হাঁড়ি মদ গেলা হতো, আর এগুলোর সাথে স্বাভাবিকভাবেই চলতো ভালো পরিমাণে ‘মেয়েবাজি’ (এখানে বলা যায় সেই কুখ্যাত বাদামভোজের কথা, যা পাদ্রী সেজার বোর্জিয়ার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিল একশজন উলঙ্গ বারবনিতা।)        

তবে সত্যি কথা হলো যে শুধুমাত্র চরম উদাহরণগুলোর কথাই লিখিত থেকে যায়। বেশিরভাগ খাবারের উৎসব নিশ্চয়ই আরো শান্তশিষ্ট ছিল। মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদরা বারবার এই দিকে জোর দিয়েছেন যে যাজকবর্গ ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে বারবার চেষ্টা করা হচ্ছিল খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট আদব-লেহাজ প্রচার করার। এই তৎপরতা থেকেই বোঝা যায় যে এ ব্যাপারে কিছু সমস্যা নিশ্চয়ই চালু ছিল। বারো শতকের একটা গ্রন্থ পাওয়া যায়, যার নাম হলো সুসভ্য মানুষের গ্রন্থ (লাতিনে এর নাম Urbanus Magnus।) বইটার লেখক ছিলেন বেক্লেসের ড্যানিয়েল। কীভাবে যেন বইটা আমার মায়ের হাতে এসে পৌঁছায়। ড্যানিয়েলের মত তারও কড়া নির্দেশ ছিল ‘টেবিলের উপর কনুই রাখা যাবে না।’ ড্যানিয়েল বলেছিলেন, ‘নিজের টেবিলে তাও চাইলে করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য কারোর বাড়িতে দাওয়াতের সময় একদমই না।’ আমার মা এ ব্যাপারে ড্যানিয়েলের চাইতে কম সহিষ্ণু ছিলেন।    

ছবি: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি


যাহোক, মধ্যযুগের ভোজগুলো ভিক্টোরিয়ান আমলের অতিরিক্ত সুশীল ডিনার পার্টিগুলোর চেয়ে অনেক দিক দিয়েই আলাদা ছিল। সেখানে টেবিলের পায়াগুলো আগাগোরা কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকত যাতে করে কোনো উদাম ঠ্যাঙের ন্যূনতম আঁচও না পাওয়া যায়, আর প্রতিটি কোর্সের জন্য থাকত আলাদা চামচ ও কাঁটাচামচ। এই বদলের পিছনে বড় একটা ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও পরিচ্ছন্নতাবোধের উদ্ভবের। মানুষের যখন বেশি বেশি পাত্র কেনার সামর্থ্য হলো, তখন আর তারা ভাগাভাগি করতে যাবে কেন? চামচটামচ যখন আরো সহজলভ্য হয়ে গেল, তখন নিজের হাত এঁটো না করে (যেহেতু হাত ধুয়ে ফেলার গরম পানি অতটাও সুলভ ছিল না) চামচ ও কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়াই তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক মনে হতে শুরু করলো। এই একই যুক্তি উলটে দিয়ে বলা যায়, আমরা ভারতীয়রা যে হাত দিয়ে খাই তার পেছনে একটা কারণ এই হতে পারে যে আমাদের এখানকার পানি এতটাও ঠান্ডা না যে হাত থেকে তেল-মসলা ধুয়ে ফেলা যাবে না। আমার জন্য হাত দিয়ে খাওয়াটা এতই স্বাভাবিক যে আমি শুধু ভাবি পাশ্চাত্যেও যদি গরম পানির কল সবখানে চালু হয়ে যেত তাহলে কত ভালো হতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল আমাদের সন্তানদেরকেই নিজেদের দলে ভেড়াতে পেরেছি। আপনারা বুঝতেই পারছেন, এই কারণে আমাদের কতটা ঝামেলা তৈরি হয় (বিশেষ করে আমার জন্য) যখন আমরা কোনো ‘শিষ্টাচারসম্পন্ন’ বাড়িতে দাওয়াতে যাই আর আমার ছেলে-মেয়েরা মাংসটা হাত দিয়ে তুলে নেয়।

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সেটা হলো খাবার-দাবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এইসব নিয়ম-নীতিকে কেবল এই নিক্তিতে বিচার করা যাবে না যে কোনটা বেশি সুবিধাজনক। প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়রাও যে হাত দিয়ে খাবার খায় সেটা নিয়ে পাশ্চাত্যে একটা অস্বস্তি চালু রয়েছে। কিন্তু হাত দিয়ে যেমন-তেমন উপায়ে খাওয়া যাবে এই ভাবনাটাও বেশ অপরিচিত। আমাদের পরিবারে শেখানো হতো খাবার যেন কোনোমতেই আঙুলের দ্বিতীয় করের উপরে না ওঠে। আবার আমি খেয়াল করেছি যে আমার ভাইয়ের আয়া নিজের পুরো থাবা দিয়ে খাবার খেত। তার কয়েক বছর পরে আমি ‘দখল’ নামে গৌতম ঘোষের অসাধারণ সিনেমাটা দেখি। সেখানে একটা আনন্দোৎসবের দৃশ্য আছে, এবং এই দৃশ্যটাই গোটা সিনেমার প্রাণকেন্দ্র। সেই দৃশ্যে দেখায় যে অভিবাসীরা নিজেদের পুরো হাত দিয়ে ভাত চটকাচ্ছে এবং কবজি পর্যন্ত চেটে খাচ্ছে। আমাদের এই মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ সমাজে এ-ধরণের আচরণ করলে বেশ গালি খেতে হতো।

কিন্তু সব ক্ষেত্রেই খাবার খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হয়। কেবল সহজলভ্যতা যদি প্রধান নিয়ামক না-ও হয়, আমরা কীভাবে খাই সেটা পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দেয় আমরা কারা, এবং সমান গুরুত্বের সাথে জানিয়ে দেয় আমরা কারা নই। খাদ্যগ্রহণের শিষ্টাচার মূলত শ্রেণি ও বর্ণসাপেক্ষ ব্যাপার-স্যাপার। সেই সূত্রেই ইউরোপ যে হাত দিয়ে খাওয়ার প্রচলন দিয়ে সরে আসলো তা ছিল আরো বৃহত্তর আত্মসংযমী এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই অংশ। এই আত্মসংযম লক্ষ করা গেছে সকল শরীরবৃত্তীয় আচরণে (জনসমক্ষে আর কোনো পাদ দেয়া বা কুলি করা হবে না), যৌনরুচি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে, পশু-পাখি ও অন্যান্য মানুষের প্রতি নির্মম আচরণের বিরুদ্ধে। তখন থেকে আর আস্ত কোনো জন্তুর গা থেকে মাংস ছাড়িয়ে খেতে হতো না, কাটা অবস্থায়ই টেবিলে মাংস হাজির করা হতো। আমার প্রবৃত্তি বলে যে কিছুকাল আগ পর্যন্তও যে রাজকীয়তার সাথে বীরদর্পের একটা সংযোগ ছিল সেটা এই ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাজাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল বলশালী (শারিরীকভাবে এবং মানসিকভাবে) হওয়া, যৌনসক্ষম হওয়া এবং গুরুভোজে পারঙ্গম হওয়া। রুচি ও শক্তির এ-ধরণের প্রদর্শনী ছিল রাজা হিসেবে তাদের যোগ্যতার সাক্ষ্য। কিন্তু পরবর্তীতে যখন নেতা (কিংবা রাজাও বলা চলে) হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও সুপরিচালনার বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য হয়ে উঠলো, তখন রাজাদেরও হয়ে উঠতে হলো আরো সংযমী ও পারদর্শী। হয়তো আজ পুতিন ও ট্রাম্পের কল্যাণে আমরা পুরনো দিনগুলো ফিরে পাব।      

তবে কেউ আবার এটা ভেবে বসবেন না যে আমি বলতে চাইছি দুনিয়ার সকল সমাজের অন্তর্নিহিত একটা প্যাটার্ন আছে যার কারণে সমাজগুলো সময়ের সাথে সাথে আরো আদবসম্পন্ন হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি আমি যখন লখনৌতে যাই, তখন নিজের বয়সী বা আরো মুরুব্বিদের সাথে আলাপ করতে বসলেই শুনি তেহজিবের কথা। তেহজিব হলো কতগুলো আদবসিদ্ধ আচরণের সমষ্টি যা উনিশ ও বিশ শতকে হিন্দু ও মুসলিমদের শহুরে সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে ছিল। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের  বোর্দো বলেছিলেন, আদব-লেহাজ হলো অভ্যাসের ব্যাপার। এসব আদব কোনো নির্দিষ্ট উপ-সংস্কৃতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, এবং এর চর্চাকারীরা মনে করে এসব খুবই প্রাকৃতিক এবং সহজাত। কিন্তু সত্য হলো যে এসবের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আপনি কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তার সাথে (যেমন, টেবিলে কনুই রাখলেই আমার মা ঝামটা মারতো) এবং সেই পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণকারী বৃহত্তর অর্থনৈতিক অবস্থার (যেমন, আমাদের বাসায় একটা টেবিল ছিল এবং আমার বাবা-মা কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকেছিলেন)। 

যারা আমাদের চাইতে ভিন্ন আচরণ করে তাদেরকে আমরা নিচু চোখে দেখি, বিশেষ করে যদি দেখা যায় সামাজিকভাবে তারা সুবিধাবঞ্চিত। এবং যারা প্রভাবশালী পদে থাকে তাদেরকে আমরা অনুকরণ করতে চাই। অসাধারণ বাঙালি রম্যলেখক পরশুরামের ‘উলট–পুরাণে’ দেখা যায় ভারত ব্রিটেনে উপনিবেশ গেড়েছে। সেখানে ব্রিটেনের ভারত কর্তৃক নিয়োজিত গভর্নর ভারতীয়দের মত আম খেতে চায়। সে বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে ওভাবে আম খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তার হাত বেয়ে রস পড়তে থাকে। আমিও ফরাসিদের মত ছোট ছোট টুকরায় কেটে পিরিচে রেখে কাঁটাচামচ দিয়ে আম খেতে পারি। কিন্তু সেই সন্ন্যাসীর মত তৃপ্তি নিয়ে নিজের ঠোঁট চেটে চেটে আম খাওয়া, তা যদিও আমার খুব ইচ্ছা, তবু কেমন যেন দূরের ঠেকে। খাবার-দাবারকে ঘিরে এসব মনগড়া নৈতিকতা বাদ দিলেও তো দুনিয়ায় আমাদের বিভাজনের উপলক্ষ্য কম নেই, তাই না?  

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন