ভিলেনসুরত   

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
আলস্যের উকিল
আলোচিত কিছু ভিলেন। অলঙ্করণ করেছেন রিসাদ


বাংলা সিনেমার কিছু উল্লেখযোগ্য ভিলেনের নাম মনে করুন তো।
কাদের কথা মাথায় আসছে?
স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে ভেসে ওঠার কথা ডিপজল, কাবিলা কিংবা জাম্বুর চেহারা। 

তাদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পান কি?
এদের মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো এরা কালো, মোটা, চুল কম। হিরোদের বিপরীতে তাদের ভাষাভঙ্গির মধ্যেও স্পষ্ট তফাৎ টের পাবেন। হিরোরা কথা বলে সুন্দর, সুললিত, তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ ভাষায়, এবং নিজেদেরই চারিত্রিক অশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবেই যেন, ভিলেনরা বলে ‘অশুদ্ধ’ ভাষায়। এইটুকু অন্তত স্পষ্ট, ভিলেনদেরকে আমাদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সেটার মধ্যে তাদের ব্যাপারে অন্তর্নিহিত কিছু পূর্বানুমান লুকিয়ে রয়েছে। সেটা হলো, যারা খারাপ তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ‘কদর্যতার’ সাথে মিলিয়ে দেখি। সহজ কথায়, কালা মানেই বদ। অথচ, কিছু আরোপিত অতিরঞ্জন বাদে, কাবিলা বা জাম্বু  কিন্তু গড়নের দিক দিয়ে আর দশজন বাংলাদেশির খুব কাছাকাছি। তবুও বিশেষভাবে তাদের গড়নটাকেই চারিত্রিক ত্রুটির সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকাটার মধ্যে আমাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও সেখান থেকে জন্ম নেয়া আত্মঘৃণার কোনো ভূমিকা নেই তা বলা যাবে না। আমরা ইদানীং প্রায়ই কিছু নাটক হয়তো দেখি যাতে সাবিলা নূর বা মেহজাবিনের মত ফর্সা নায়িকারা মুখে কালি মেখে কালো হওয়ার অভিনয় করছে। বাংলাদেশের মত অঞ্চলে তো আদতেই চাপা বর্ণের মেয়েদের কোনো অভাব থাকার কথা না। তবুও কাস্টিং-এর ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী? কেননা যখন কোনো অভিনেতা খুনি হওয়ার অভিনয় করে, তখনো যেমন দর্শকের জানা থাকা দরকার যে সে আসলে খুনি না, একইভাবে আমাদের জানা থাকা দরকার যে টিভির নায়িকারাও আসলে কালো না।

ছবিঃ সাবিলা নূর
বাংলাদেশের মত অঞ্চলে তো আদতেই চাপা বর্ণের মেয়েদের কোনো অভাব থাকার কথা না। তবুও কাস্টিং-এর ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী?
নাটকের একটি দৃশ্যে সাবিলা নূর


কেননা মহাভারতের দ্রৌপদীর গায়ের রঙ কালো হওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও, গায়ের রঙ কালো হওয়া নাটক-সিনেমার নায়িকা হওয়ার পূর্বশর্তের বিরোধী। এরকম কেলেঙ্কারি একটা কাণ্ড ঘটেছিল ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া অথেলো সিনেমাটাতে। সেখানে অথেলোর অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ের তার ভিলেনসুলভ কাজকর্ম আরো রঙচঙ মাখিয়ে ফুটিয়ে তোলেন নিজের মুখে কালো কালি মেখে। মানে, কালো হওয়া আর যাবতীয় অকাজ-কুকাজ যে একই লাইনের, সেটাই স্পষ্ট করে দেয়া হলো। এসব খুচরা ট্রিক্সের মাধ্যমে হিরোদের ব্যাপারে খুব সহজেই আমাদের সহানুভূতি ও ভিলেনদের প্রতি ঘৃণা আদায় করে নেয়া যায়। অর্থাৎ, হিরো ও ভিলেনদের এই বিরোধী গুণগুলি তাদের মধ্যকার বিভাজনরেখার কাজই করে।  

এটা অবশ্য নতুন কিছু না। আর যেকোনো ধারণার ইতিহাসের মতই, সৌন্দর্যের ধারণার কুলজি সন্ধানের জন্যেও আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীন গ্রিসে। আমাদের বাংলা সিনেমার যে নজিরগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর উহ্য বক্তব্যটা হলো সৌন্দর্যের সাথে শুভের ও কদর্যতার সাথে অশুভের একটা অনিবার্য সংযোগ রয়েছে। গ্রিকরাও তাই বিশ্বাস করতো, এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্য কোনোরকম রাখঢাকের বালাই ছিল না। ভাষার মধ্যে একটা সংস্কৃতির বদ্ধমূল ধ্যানধারণার হদিস পাওয়া যায়। সৌন্দর্যের গ্রিক প্রতিশব্দ ছিল কালোস, একইসাথে যার অর্থ ছিল সততাও। আবার, কদর্যতার প্রতিশব্দ ছিল আইস্ক্রোস, যেটার আরেক অর্থ ছিল লজ্জাজনক কোনোকিছু। হোমারের ইলিয়াডের এক পর্যায়ে থের্সিটেস নামে একজন সাধারণ লোক আগামেমননের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে নারাজ হয় এবং অডিসিউস দ্রুতই তাকে পরাস্ত করে। গ্রিক ভাষায় কদর্যতা ও জঘন্যতার সমার্থকতার দরুন তার ব্যাপারে হোমারের বিবরণটা এভাবে পড়া যায়: ‘ইলিয়নে জন্মানো সবচেয়ে নিকৃষ্ট/কুশ্রী মানুষ ছিল সে। তার পা ছিল বাঁকা, ফলে এক পায়ে সে ছিল খোড়া। তার কাঁধ ঝুঁকে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছিল, আর মাথার খুলি ছিল ভীষণ উঁচা আর তাতে ছোপ ছোপ সাদা উলের মতন চুল।’ অর্থাৎ, আমাদের সিনেমার সেই চল তার উত্তরাধিকারের জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারে হাজার হাজার বছর পুরানো, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্যকেও। যদিও এখানে কেউ উল্লেখ করতে পারেন সক্রেটিসের কথা, যে অত্যন্ত কুৎসিত বলে প্রখ্যাত, তবুও সম্মানিত। আমি অবশ্য এটাকে দেখি এমনভাবে যে, নিজের বাহ্যিক কদর্যতার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই সম্ভবত তাকে হতে হয়েছিল সমস্ত এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। এসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে গ্রিকরা বাহ্যিক রূপকে অন্তরের অবস্থার প্রতিফলন হিসেবেই দেখত। অর্থাৎ, আপনার বাহ্যিক গড়ন ও মুখাবয়ব দেখে বুঝে ফেলা সম্ভব আপনার চরিত্র ও মন কেমন। ফলে কদর্যতা ছিল এমন এক অবস্থা, যার থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাময় পাওয়া যায় তত ভালো। ইতিহাসবিদ জেকব বার্খার্ট এক স্পার্টান শিশুর কথা উল্লেখ করেছিলেন, যে পরে ডেমারেটাসের স্ত্রী হয়েছিল। সে দেখতে ভীষণ খারাপ হওয়ায় রোজ তাকে থেরাপনিতে হেলেনের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো, এবং সেই সুন্দরীতমার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে আর্জি জানানো হতো যেন দেবী সেই মেয়ের কদর্যতা মুছে যায়। কদর্যতা যেনবা একটা রোগ, একটা বিশেষ কন্ডিশন, যার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া জরুরি।

এরকম ধারণার বিস্তার আরো বহুদূর পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা যেসব গল্পের হাত ধরে দিনদুনিয়া বুঝতে শুরু করে, অর্থাৎ রূপকথার মধ্যে এরকম উপাদানের প্রাচুর্য আমলে নেয়ার মতই। রূপকথাগুলোর সাধারণত আন্তর্জাতিকতা অন্য যেকোনো গল্পমাধ্যমের চেয়ে বেশি, কেননা খুব সহজেই তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে, আঞ্চলিক উপাদানগুলোকে নিজের অংশ করে নিয়ে হাজির হতে থাকে। আমাদের অঞ্চলে আছে শুয়োরানি-দুয়োরানিদের গল্প, কিংবা ডাইনিবুড়িরা। তারা হয় বিগতযৌবনা, অদ্ভুত গায়ের রঙ আর উঁচা নাকবিশিষ্ট নারী। অন্যদিকে নায়িকারা হয় অনন্য সুন্দরী ও ফর্সা। যেমন সিন্ডেরেলা কিংবা স্নো হোয়াইট। এখানে, তাদের সৌন্দর্য গল্পের কোনো আকস্মিক অংশ না, বরং তাদের সৌন্দর্যকে ঘিরেই গল্পগুলো আবর্তিত হয়। ‘মিরর, মিরর অন দ্য ওয়াল/হু’জ দ্য ফেয়ারেস্ট অফ দেম অল?’ দেখা যায় নিজেদের সৌন্দর্যের কারণেই নিজেদের কুশ্রী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা কাজের মেয়ের ঈর্ষার শিকার হয়ে বিপদে পড়ে, নাহয় দেখা যায় তাদের লাবণ্যের প্রেমে পড়ে নায়ক নানারকমের পাগলামি করে। আর এখানেও সেই একই যুক্তি অনুসৃত হয়: সিন্ডেরেলার মুখশ্রী তার পরিষ্কার মনের কারণেই এমন, অন্যদিকে তার কিম্ভূত সৎমা ও সৎবোনেদের চেহারা তাদের অন্তরের কাদারই ইশারা।  

ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করে বোঝার জন্য বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট গল্পটা একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। আর দশটা রূপকথার মতই, এই গল্পেরও দেশকালভেদে অসংখ্য সংস্করণ পাওয়া যায়। গল্পের মূল লেখক ছিল গাব্রিয়েল-সুজান বার্বো দে ভিলেন্যুভ। গল্পটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৪০ সালের দিকে। গল্পটার কঙ্কাল এরকম: এক বিপত্নীক বণিকের তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ে বেশ নিষ্ঠুর আর নিচুমনা, আর কনিষ্ঠ মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর, একইসাথে নির্লোভ ও আন্তরিক। সেই মেয়ের নামই বেল। বেল শব্দের অর্থই সুন্দরী। এতক্ষণ সৌন্দর্য ও সদাচারের সংযোগের ব্যাপারে যা যা বললাম, সেসবই এই গল্পে পাওয়া যাচ্ছে। যাইহোক, সেই বণিক একবার ব্যবসার কাজে দূরে এক জায়গায় যায়। তার বড় দুই মেয়ে তার কাছে দামি জিনিসপত্র চায় (যেহেতু তারা লোভী), আর বেল চায় একটা দুর্লভ গোলাপ (যেহেতু সে নির্লোভ।) বণিকের অনেক বড় লোকসান হয়, ফলে সে কিছু কিনতে পারে না। কিন্তু একটা বাগানে ছোট মেয়ের কাঙ্ক্ষিত সেই গোলাপ দেখতে পেয়ে সেটা তুলতে যান। জানা যায় সেই বাগানটাই হলো বিস্ট তথা এক জন্তুসুলভ ব্যক্তির। সে এক শর্তে বণিককে যেতে দিতে রাজি হয়, যে বণিক ফিরে গিয়ে তার বদলে এক মেয়েকে এখানে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেবে। অবশ্যই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ছোট মেয়ে বেলই এগিয়ে আসে। পরে দেখা যায় সেই বিস্টের সাথে বেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় বিস্ট বেলকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় না। পরে বেল বাড়ি ফিরতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসার শর্তে বিস্ট রাজি হয়। কিন্তু বেলের বড় দুই বোন বেলের আলিশান জীবনযাপনে ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রেখে দেয়। পরে বেল টের পায় সে বিস্টকেই ভালোবাসে, ফলে সে তার কাছে ফিরে যায়। বেলের ভালোবাসা পেয়ে বিস্টের উপর থেকে অভিশাপ উঠে যায় এবং সে রাজকুমারের রূপে আবির্ভূত হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, বিস্ট যতক্ষণ নিজের মনের মধ্যে সংকীর্ণতা ও রূঢ়তা লালন করে চলছিল, ততক্ষণ তার জানোয়ার-রূপ বলবৎ ছিল। কিন্তু যখনই সে কোমলতা ও ভালোবাসাকে নিজের অন্তরে ঠাই দেয়, তখনই সে তার রাজকীয় রূপ ফিরে পায়। আবারো, সেই একই ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, কারো মনের কুরূপই নিজেকে প্রকাশ করে তার চেহারা ও বাহ্যিক অবয়বে।

আরো একটা ব্যাপার আছে। বলা হয় ভিলেন্যুভ গল্পটা লিখেছিল একটা বাস্তব ঘটনাকেভিত্তি করে। পেট্রাস গনসালভাসের একটা বিশেষ কন্ডিশন ছিল, যার নাম হাইপারট্রাইকোসিস। এই কন্ডিশনের কারণে শরীরে খুব দ্রুতগতিতে ও অত্যধিক পরিমাণে চুল ও পশম গজায়। এ কারণে পেট্রাস পরিচিত ছিল ‘বুনো আদমি’ নামে। তার বাগদত্তা ক্যাথেরিন বিয়ের দিনের আগ পর্যন্ত পেট্রাসের এই কন্ডিশনের ব্যাপারে জানতো না। এবং বলা হয় জানার পরেও এ ব্যাপারে তার তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। গোটা ইউরোপ জুড়ে তারপর এই গল্প ছড়িয়ে পড়ে, এবং তাদেরকে ডাকা হয় ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ বলে। তাদের কাহিনির উপর ভিত্তি করেই ভিলেন্যুভ, ব্যুমোঁ ইত্যাদি লেখকেরা বিভিন্ন গল্প-রূপকথা রচনা করে। এভাবেই একজন লোক তার মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে হয়ে ওঠে রূপকথার রসদ। তাকে জন্তুর মত বানিয়ে তোলা হয়।

এখান থেকে আমরা নজর ফেরাতে পারি বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে বহুলব্যবহৃত আরেকটি ট্রোপের দিকে। সেটা হলো শারীরিক বা মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভিলেন হিসেবে দেখানো। এই ট্রোপটা এত বহুলব্যবহৃত যে আমরা যেন প্রায় অভ্যস্তই হয়ে গেছি। হ্যারি পটারের ভোল্ডেমোর্ট থেকে শুরু করে সুপারম্যানের লেক্স লুথর, সবাই এই ট্রোপের আওতায় পড়ে। বাংলা সাহিত্য ও নাটকেও আমরা অহরহ শুনতে পাই কানকাটা রমজান, ল্যাংড়া মাস্তান ইত্যাদি চরিত্রের নাম। তাদের বাহ্যিক অবয়বে এসব বিকলতা যেন তাদের অন্তরের ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিতপূর্ণ। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো দ্য ডার্ক নাইট-এ হার্ভি ডেন্টের ভিলেন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করার মুহূর্তটা। সে ছিল গথাম শহরে ন্যায়ের পক্ষের এক যোদ্ধা। কিন্তু তার প্রেমিকার মৃত্যু ও নিজের মুখের অর্ধেক ঝলসে যাওয়ার মুহূর্তটা চিহ্নিত করে তার অশুভের দিকে পা বাড়ানোটাকেও। ব্যাটম্যানের সবচেয়ে পরিচিত ভিলেন জোকারের গল্পটাও প্রায় এরকম, তারও চেহারায় বিকৃতির ছাপ। এরকমটা প্রায়ই দেখানো হয় যে তাদের এই শারীরিক কমতিগুলোর কারণে তার মধ্যে একপ্রকার তিক্ততাবোধ জন্ম নেয়, যার ফলে সে বেছে নেয় খারাপের পথ। অপরদিকে, হিরোরা কেবল স্বাভাবিকই হয় না, হয় একটা অতিরঞ্জিত আদর্শ গড়নের অধিকারী। 

ভিলেনদেরকে এভাবে কুৎসিত কিংবা বিকলাঙ্গ হিসেবে চিত্রিত করার প্রধান উদ্দেশ্যটা হলো তারা কতটা আলাদা, ‘স্বাভাবিক’ থেকে কতটা চ্যুত, সেটা দেখানো। এ ধরণের চিত্রায়ণের মাধ্যমে একপ্রকার অপরায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি এতে করে একটা প্রচ্ছন্ন বিমানবীকরণও যে ঘটে না, তা বলা যাবে না। প্রায় সকল সভ্যতায়ই তথাকথিত কুৎসিত অথবা বিকলাঙ্গ মানুষদের জন্তুসদৃশ হিসেবে দেখার ইতিহাস রয়েছে। ইউরোপে বিভিন্ন সার্কাসে তাদেরকে মানুষ টিকেট কেটে দেখতে আসতো। তারা হয়ে উঠতো মজার কিছু দৃশ্য। বিভিন্ন নিউরোলজিকাল সমস্যাকেও অশুভ শক্তির আছর হিসেবে দেখার নজিরও কম না। মধ্যযুগে কারো কোনোপ্রকার মানসিক ব্যাধি দেখা দিলে মনে করা হতো তার মাথায় শয়তান বাসা বেঁধেছে, এবং শয়তান যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য তাদের খুলিতে ফুটা করে দেয়ার চিকিৎসাও প্রচলিত ছিল! একইভাবে বিভিন্ন হরর সিনেমাতে আমরা এখনো দেখি কোনো নিউরোলজিকাল কন্ডিশনযুক্ত চরিত্রকে শয়তান বা তেমন কোনো অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এভাবে বিগত যুগের বিশ্বাসগুলো ঠাই করে নিচ্ছে হাল আমলের শিল্পের মধ্যেও। 

এসব ভ্রান্ত বিশ্বাসের পুনরুৎপাদনে জন্ম নিতে পারে এক দুষ্টচক্র। আমার খুব প্রিয় একটা সিনেমা হলো মেগামাইন্ড। অনেকটা সুপারম্যানের প্যারডি করে বানানো এই সিনেমাটার শুরুতে দেখা যায় দুটো গ্রহ থেকে দুটো শিশুকে ক্যাপসুলে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীর উদ্দেশে। তাদের মধ্যে একজন শিশু, মেট্রোম্যান, যে দেখতে খুব সুন্দর, তার সুপারম্যানের মত নানাবিধ ক্ষমতা, সে গিয়ে পড়ে এক আলিশান মহলে। অন্য শিশুটা হলো মেগামাইন্ড, যার গায়ের রঙ নীল আর মাথাটা অতিকায় বড়, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছাড়া যার আর কোনো ক্ষমতাই নেই, সে গিয়ে পড়ে একটা জেলখানায়। সেখানেই তাদের গোটা জীবনের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। মেট্রোম্যান বড় হয় পর্যাপ্ত যত্ন ও আদরের সাথে, স্বীকৃতির কোনো অভাব হয় না। সে গড়ে ওঠে একজন হিরো হিসেবে। অপরদিকে মেগামাইন্ড বড় হয় কয়েদিদের মাঝে। সদিচ্ছা বা প্রতিভার জন্য পুরস্কৃত হওয়া তো দূরের কথা, ন্যূনতম মূল্যায়নও সে পায় না। উদ্ভট দৈহিক গড়নের কারণে স্কুলেও সে প্রচণ্ড বাজে ব্যবহারের শিকার হয়। চোখের সামনে সে দেখতে পায় মেট্রোম্যান কীভাবে সেই ছোটবেলা থেকেই সবার মধ্যমণি হয়ে রয়েছে।

ছবিঃ মেগামাইন্ড
মেগামাইন্ড আমাদের বলতে চেয়েছে যে অপরাধীরা শেষমেষ ভুঁইফোড় কিছু না
মেগামাইন্ড সিনেমার একটি ফ্রেম




একসময় নিজের এই হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষার প্রভাবেই যেন মেগামাইন্ড হয়ে ওঠে এক ভিলেন, সুপারভিলেন। তারপরের ঘটনা পাঠক নিজে সিনেমাটা দেখে জেনে নেবেন আশা করি। কিন্তু মেগামাইন্ডের এই ভিলেন হয়ে ওঠাটা কি অপ্রত্যাশিত কিছু? নাকি অসংখ্য আপাত-নিরীহ আচার ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আগে থেকেই তার ভিলেন হয়ে গড়ে ওঠার এন্তেজাম করে রাখা হয়েছিল? মেগামাইন্ড দর্শকদের কাছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে একটা সুপারহিরো বনাম সুপারভিলেন সিনেমা হিসেবে খ্যাত হলেও, আমার কাছে মনে হয়েছে এই সিনেমাটা আমাদের বলতে চেয়েছে যে অপরাধীরা শেষমেষ ভুঁইফোড় কিছু না। তাদের বাতাবরণ ও পরিপার্শ্বের মধ্য দিয়েই তাদের জন্ম। মেগামাইন্ড আমাদেরকে দেখায় যে, আমরা যদি আমাদের রিপ্রেজেন্টেশান ও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল না হই, তাহলে আমরা জন্ম দেব কিছু সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসির। যাদেরকে আমরা ইতোমধ্যে ভিলেন বলে বিশ্বাস করতে চাই, তারা ক্রমাগত ভিলেন হয়েই আমাদের সামনে হাজির হতে থাকবে।











থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন