যেভাবে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল স্বৈরাচারী

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
আলস্যের উকিল


কে না চায় মনে মনে স্বৈরাচারী হতে? দেশজুড়ে নিজের জয়জয়কার, পাবলিকের টাকায় বাড়ি-গাড়ি, অপছন্দের লোকজনকে হাপিশ করে দেয়া—আহা! কে না চায়? 

কিন্তু দুঃসংবাদ হলো এই চাওয়া এ যুগের সঙ্গে একটু বেমানান। মানুষজন ইদানিং বেশিই সেন্সিটিভ। মানবাধিকারে একটু টোকা পড়লেই ছ্যাঁত করে ওঠে। তাদেরকে নাকি গুম করা যাবে না, তাদের টাকায় বিদেশে বাড়ি করা যাবে না, বিচারব্যবস্থা স্বচ্ছ রাখতে হবে। শখ কত! আহা, ‘কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’  যখন একজন স্বৈরাচারী শান্তিতে পুরা দেশটাকে নিজের বাপের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ও দেশের জনগণকে নিজের দাসানুদাসের মত ব্যবহার করতে পারতো? প্যারা নাই, এখনো আছে সেই দিন। শুধু আরেকটু কৌশলী হতে হবে আরকি। স্বৈরাচারকে চিনির প্রলেপ দিয়ে খাওয়াতে হবে মানুষকে। সেটি কীভাবে করবেন? আপনার জন্যই এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো একজন সফল স্বৈরাচারী হওয়ার কলাকৌশল। 

ক্ষমতায় আসবেন কীভাবে?    

স্বৈরাচারী হওয়ার মানে হলো খাদ্যশৃঙ্খলের সবচেয়ে উপরে অবস্থান করা। ক্ষমতার আদ্যপান্ত আপনাতেই শুরু এবং শেষ। আপনি হয়তো ভাবছেন কঠোর পরিশ্রম ও একান্ত নিষ্ঠার মাধ্যমেই সে পর্যায়ে পৌঁছনো সম্ভব। কিন্তু, না। জীবন একটা পাতানো খেলা। এ খেলায় নিয়ম হলো শুরুতেই জিতে বসে থাকতে হবে। সুতরাং, সবচেয়ে ভালো হয় যদি ক্ষমতা বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়। অথবা ধরুন বাপ যদি হয় দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন নায়ক, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! তখন তো দেশের উপর আপনার হক স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি; জনগণ-টনগণ পরে।  অবশ্য আপনি দুর্ভাগা হলে, অন্য উপায় খুঁজতে হবে। ঢুকে পড়ুন কোনো একটি রাজনৈতিক দলে। ঝোপ বুঝে কোপ মারুন ও ধীরে ধীরে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে শীর্ষে উঠে যান এবং হাসিল করুন নিজের উদ্দেশ্য। স্বৈরাচারীদের ওস্তাদ অ্যাডলফ হিটলার কিন্তু ১৯১৯ সালে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে ঢোকেন। একবার এক সভায় দলপ্রধানের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজের বাগ্মিতার প্রমাণ দেন হিটলার ভরা মজলিসে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে এই দলকে পরিণত করেন নাৎসি পার্টিতে। হিটলারের কাছ থেকে অনেককিছু শেখার আছে আপনার। আরো ভালো হয়, যদি কোনোভাবে একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারেন। তাহলে সেটা আপনার ভবিষ্যতের সকল স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করতে সাহায্য করবে, আবার আন্তর্জাতিক মহল থেকেও চাপ খাবেন কম। আর একবার ক্ষমতায় চলে আসার পর পরবর্তী নির্বাচনসমূহ হাতিয়ে নেয়া কঠিন কিছু না। তা না হলে, জনগণের কোনো বিপ্লবকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগান, হাইজ্যাক করে নিন। সেটাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় চলে আসুন। আলা বাদিউর ‘বিবাহ যেভাবে প্রতিবার প্রেমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, একটা রাষ্ট্রও প্রতিবার যেই আদর্শিক আন্দোলনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সাথে প্রতারণা করে’-এই উক্তিটাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিন। গুডলাক। 

আপনিই সর্বেসর্বা!

মনে রাখবেন, আপনিই সব। ত্রাতা, দাতা, নবাবজাদা সবই আপনি। দেশ ও জাতির সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যেন আপনিই হন। তা না হলে আপনার স্বপ্নের সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র কায়েম হবে না। আগেকার দিনে তো শাসককে খোদ ঈশ্বরের বংশধর বলে মেনে নেয়াই হতো। এখন আর সেই সুবর্ণ দিন নাই। ফলে এখন আপনারই নিজ দায়িত্বে মানুষকে বোঝাতে হবে যে আপনিই তাদের অধীশ্বর; গড়ে তুলতে হবে নিজের কাল্ট অফ পার্সোনালিটি। এর জন্য প্রথমেই নিজেকে কোনো এক আদর্শ বা চেতনার সাথে একাত্ম করে ফেলতে হবে, যাতে আপনার বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই সেই আদর্শের বিরুদ্ধে যাওয়া বলে সাব্যস্ত করা যায়। 

আপনি আর ব্যক্তি থাকবেন না, নিজেই হয়ে উঠবেন সেই চেতনার মূর্তরূপ। তারপর, সম্ভব হলে নিজের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে জাতির কোনো পুরানো হিরোর। অগাস্টাস সিজার যেমন নিজের পালক-পিতা জুলিয়াসের খ্যাতি বেচে নিজের উত্থান নিশ্চিত করেছিল। এই সহজ কৌশলটা এখনো কার্যকর। বিশেষ করে সেই হিরো যদি হয় আপনারই বাপ-মা বা স্বামী, তাহলে তো আরো ভালো। এরপর শুরু করবেন আসল কাজ। সকল নোটে আপনার, বা আপনার সেই বাপ-দাদার ছবি থাকতে হবে। রাস্তাঘাটে, প্রতিটা চত্বরে, ময়দানে থাকবে ভাস্কর্য, সকল অফিস-আদালতে আপনাদের ছবি টাঙিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক হবে। পদে পদে জনতাকে মনে করিয়ে দিতে হবে দেশটা কার। এবং আপনি যে সর্বগুণে গুণান্বিত তা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য মোসাহেবরা যেন আপনার নামের আগে কয়েকশ বিশেষণ যোগ করে নেয় তা অবশ্যই নিশ্চিত করবেন। কিম ইল সুং পরিচিত ছিলেন ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, চিরজয়ী সেনাপতি , ‘মহান সূর্য ও মহৎ মানব’, ‘মহান নেতা’, ‘মহান পিতা’, ‘জাতির সূর্য, ‘দূরদর্শী, ‘জাতির বিবেকের পরাকাষ্ঠা’, ‘অদ্বিতীয় দেশপ্রেমিক’, ‘জাতীয় বীর’, ‘আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক’ ইত্যাদি অভিধায়। আমাদের দেশেও এমন নজির বিরল নয়। তবে মানুষ অবশ্যই জানবে আপনি এসব চান না। এসব আপনার ভক্তকূল তথা দেশের জনগণই চায়, কারণ তারা আপনাকে ভালোবাসে। তুর্কমেনিস্তানের সাপারমুরাত নিয়াযভের মত আপনাকে বলতে হবে, ‘রাস্তাঘাটে নিজের ছবি ও ভাস্কর্য দেখতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু জনগণ তাই চায়।’  


ভ্রম বজায় রাখুন 

যেমনটা বললাম, মানুষ এখন আর স্বৈরাচারের কদর করে না। গণতন্ত্রে কি এক মধু যেন পেয়ে গেছে তারা! ফলে আপনার স্বৈরাচারটাকে পাতলা ঘোমটার আড়ালে রাখা গেলেই ভালো। দেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার ভ্রমটুকু অন্তত বজায় রাখতে হবে। তাই বলে লাগাম ছেড়ে দেয়া যাবে না। কেউ বাকস্বাধীনতার নামে আপনার আসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসবে, বা বাজেট নিয়ে সমালোচনা করবে তা তো হতে পারে না। বাকস্বাধীনতা মানে তো স্বৈরাচারানুভূতিতে আঘাত দেয়া নয়, তাইনা? এমন কোথাও হতে দেখলে তা দমন করা আপনার দায়িত্ব। কিন্তু তাই বলে যেন দেশে নীরবতা বিরাজ না করে তাও খেয়াল রাখবেন। স্লাভোয় জিজেকের একটা টোটকা মনে রাখবেন:  ‘স্তালিনের আমলে যদি কেউ জনসমক্ষে স্তালিনের সাথে দ্বিমত করে বসে, আর দ্বিতীয় কেউ যদি চিৎকার করে উঠে তাকে থামিয়ে দেয়, তাহলে প্রথমজনের আগে গুম হবেন দ্বিতীয়জন। কেননা সে বাকস্বাধীনতার যে ভুয়া পর্দা, তাতে আঘাত হেনেছে।’ 

স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভয় জিজেক

বাকস্বাধীনতা না থাকলেও তার ভ্রম বজায় থাকতে হবে সর্বদা। নীরবতা হতে পারে উস্কানিমূলক, জায়গা তৈরি করে দিতে পারে আরো ভয়াবহ সব প্রশ্ন ও সন্দেহের। তাই বাকোয়াজি কোলাহল দিয়ে ভরে রাখবেন মানুষের মন। ইন্টারনেটের কল্যাণে তা এমনিতেও খুব সহজ। এখানে সবকিছুই হাজির হয় ‘ইস্যু’ আকারে। তুচ্ছ থেকে বিরাট সকল ঘটনার ব্যাপারে সমান গুরুত্ব দিয়ে মতামত দাঁড় করানোর প্রয়োজন বোধ করবে লোকে। পেপারে ছাপতে থাকুন নায়িকাদের প্রিয় ফলের খবর, টিভি টকশোতে যেন তুমুল তর্ক চলতে থাকে অপ্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে। উমবের্তো একো’র মতে, সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে আপনার দায়িত্ব মানুষের কথাকে নীরব করেই দেয়াই না, বরং তাকে অহেতুক কোলাহল দিয়ে প্রতিস্থাপিত করাও।   

ইতালিয়ান লেখক ও দার্শনিক উমবের্তো একো

  
কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হবে, এমনকি সহযোগিতাও করতে হবে। আসল বিষয়গুলিতে কেউ হাত না দিলেই হলো। আশা করা যায় এই খর্বিত স্বাধীনতা উপভোগ করতে করতে একসময় মানুষ ভুলে যাবে আদতে স্বাধীনতা কী। জনগণ জানবে তারাই ক্ষমতায়। মাঝে-মাঝে বলবেন, ‘আপনারা না চাইলে আমি আর নেতৃত্বে থাকব না।’  ইকুয়েটরিয়াল নিউ গিনি’র তিওডোরো ওবিয়াং নগুয়েমা টানা ৩২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ঘোষণা দিলেন, ‘যেদিন আপনারা আমার উপর বিরক্ত হয়ে যাবেন, সেদিন আমি পদত্যাগ করে চলে যাব।’ এতদিনে বোধহয় ওই দেশের লোকেরা বিরক্ত হতেও ভুলে গেছিল। গণতন্ত্র কী? স্রেফ একটা শব্দই তো। তাকে নিজের মত সংজ্ঞায়িত করে নেয়াই যায়। 

    
বিদ্রোহ দমন

সাবধান হন। ন্যূনতম বিরোধীস্বরকেও হাল্কা করে নেবেন না। অবাধ্যতা সংক্রামক। আজকে যে ১০-১২জন ছোকড়া রাস্তার এক চিপায় কয়েকটা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কালকেই দেখা যাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে সংখ্যা বাড়তে বাড়তে শত, তারপর হাজার, এমনকি লাখ  ছাড়িয়েছে। ফলে এইসব বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই নষ্ট করা দরকার। আরো ভালো হয় যদি সেই বীজ রোপনই না করা যায়, সে ব্যবস্থা করা। মানুষে-মানুষে স্বাভাবিক সংযোগ ও সম্পর্ক কঠিন করে তুলতে হবে। মাঠ, পার্ক, লাইব্রেরি ইত্যাদি গায়েব করে ফেলুন। সবখানে থাকবে শুধু বিরাট বিরাট স্থাপত্য। আলাপ-আলোচনা, পাঠচক্র এসব আয়োজনের পথ যতটা সম্ভব কঠিন করে তুলুন। মানুষ যদি মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগই না পায়, চিন্তার লেনদেনই না করতে পারে, তাহলে বিদ্রোহের সম্ভাবনা শুরুতেই নস্যাৎ হয়। যেমন ধরুন, জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের কাছে আরব বসন্তের ঘটনাক্রম স্বাভাবিকভাবেই বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক মনে হয়েছিল, ফলে তারা আরব বসন্ত থেকে কী কী শেখা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য একত্র হতে গেলে রবার্ট মুগাবে সেখানকার উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করেন। বাংলাদেশে কিছুদিন আগেই ২০২২ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে গ্রেফতার করা হয়। খাদিজা ফেসবুকে একটি ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন, যেখানে একজন বক্তা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রবাসী হওয়ায় তার বদলে গ্রেফতার করা হয় খাদিজাকে। এনআইডি কার্ডে তখন তার বয়স ১৭।

অথবা বেছে নিতে পারেন জনতুষ্টির পথ। জনগণকে যে আপনি খুব পাত্তা দেন তা তো না। কিন্তু তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে তাদের খুব বেশি খ্যাপানোও ঠিক হবে না। যেনতেনভাবে সন্তুষ্ট রাখতেই হবে। অগাস্টাস সিজার সৈন্যদের নানানরকম উপহার দিয়ে বাগে এনেছিল, সাধারণ জনগণকে দিয়েছিল সস্তার ভুট্টা ও বিশ্রামের সময়। ফলে কেউ খেয়ালও করেনি যে এসবের ফাঁকে সে সেনেট, প্রশাসন, বিচার-বিভাগ সব নিজের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। জনগণের নজর সরিয়ে রাখার উপায় অনেক আছে। খেলাধুলা, বিনোদন মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগান। মুসোলিনির সময় খেলোয়াড়রা ছিল ইতালীয় পৌরুষের প্রতীক। নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও কাজের মাধ্যমে মুসোলিনির শাসনের প্রতি জনগণের সম্মতি উৎপাদন করে চলেছিল তারা। আফ্রিকান দেশ যাঈয়ে-তে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। তখন মোবুতু প্রচুর পরিমাণে পয়সা খরচ করে মুহাম্মদ আলী আর জর্জ ফোরম্যানকে নিয়ে আসেন দেশে বক্সিং খেলার জন্য। অর্থাৎ জুভেনালের পরামর্শ অনুযায়ী, রুটি ও সার্কাস দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে মানুষকে। আশা করা যায় তাহলেই তারা শান্ত থাকবে। 

দ্য ডিক্টেটর্স হ্যান্ডবুক বইয়ের প্রচ্ছদ
অলঙ্করণঃ রিসাদ হাসান সৌরভ


তবুও যদি কোনোভাবে তারা একত্র হতে শুরু করে, আপনার জন্য ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন নিরুপায় হয়ে কঠোর হতেই হবে। স্বৈরাচারীর প্রকৃষ্ট বন্ধু ম্যাকিয়াভেলি বলে গেছেন, ‘জনগণের কাছ থেকে ভালোবাসা ও ভয় দুটো একইসাথে আদায় করা যেহেতু কঠিন, ফলে শাসকের জন্য জনগণের ভয়ই উত্তম।’ তবে তাই হোক— কায়েম হোক ভয়ের শাসন।  আন্দোলনকারীদেরকে দাগিয়ে দিন অপরাধী হিসেবে। এমন কোনো একটা তকমা দিয়ে দিতে পারেন যার বরাতে তাদের মানবাধিকার নাই করে দেওয়া জায়েজ হয়ে যায়। বলে দেন তারা স্বাধীনতাবিরোধী বা রাজাকার কিংবা টেরোরিস্ট। বেশিরভাগ সময় এসব তকমা বিরোধীমতের লোকদেরকে দেশের উপর কম হকদার প্রতিপন্ন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আপনার বিরোধিতা করা মানে তো আসলে দেশেরই বিরোধিতা করা। তারপর সবলে দমন করুন। নেতাগুলোকে আগে জেলে ভরুন। আন্দোলনকারীদের মেরে ফেলুন, গ্রেফতার করুন, গুম করুন। এদিকে ফাঁকতালে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সাংবাদিকরা যারা আপনার শাসনামলে শনপাপড়ি খেয়ে আসছে তাদের ডেকে নিন, বোঝান যেন তারা কো-অপারেট করে, কারণ আপনি না থাকলে তাদেরও খবর আছে। এদের সহযোগিতায় চালাইদেন যে এরা বিরোধীদলের, বা কোনো জঙ্গীগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট। তদন্তের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করা অনেক সেকেলে। আগে অপরাধী শনাক্ত করে তক্তা বানান, তদন্ত তার পরে। 
এইতো! এই কাজগুলো ঠিকঠাক করতে পারলে আশা করা যায় আপনি হয়ে উঠবেন একজন সফল স্বৈরাচারী। পুরো দেশ থাকবে আপনার হাতের মুঠায়। লেখাটি যদি আপনার কাজে লাগে, ও কখনো যদি ক্ষমতায় চলে আসতে পারেন, তাহলে আশা করি আমাদেরকে আপনার সুনজরে রাখবেন।  

[ সম্পাদকের নোটঃ বিগত দুই দশকে ডিক্টেটরশিপ ও ফ্যাসিবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অনেকগুলো বই। একাডেমিক বই যেমন আছে, আছে সাধারণ পাঠকদেরকে উদ্দেশ্য করে রচিত ননফিকশনও। কার্মাইন ডেলুকা ও র‍্যান্ডাল উড রচিত ‘দ্য ডিক্টেটর্স হ্যান্ডবুকঃ আ প্র্যাক্টিকেল ম্যানুয়াল ফর দি এ্যাস্পায়ারিং টাইরেন্ট’ ধারার বই যেখানে স্বৈরাচারের কর্মপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে ‘হাউ টু’ ঢঙে। বর্তমান লেখাটি বইটির স্যাটায়ারিকাল রিভিউ হলেও হাউ টু ভঙ্গিতে স্বৈরাচারের কর্মপদ্ধতি ও স্বৈরাচারশাসিত সমাজের নানান দিকও তুলে ধরেছে ]    

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন