মিম বৃত্তান্ত

KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি
বাংলাদেশে শীতকালীন মিমের আইকনিক চরিত্র শামসুল সাহেব। তার 'শীতের সোদনে দাঁড়াতে পারছি না' ডায়লগ দেশে শীতকালীন মিম দুনিয়ার জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছে।

আপনার বয়স চল্লিশের বেশি হয়া থাকলে মিম জিনিসটার সাথে পরিচয় থাকাটা বিরল। আর বয়স পঁচিশের কম হইলে পরিচয় না থাকাটাই বরং বিরল অর্থাৎ  মিম কী জিনিস ব্যাখ্যা না করলেও চলে। তাছাড়া জোক, স্বপ্ন বা টিনেজ কালচার ব্যাখ্যা করার মতো, মিম ব্যাখ্যা করাও বেশ ‘আনকুল’ ব্যাপার। ব্যাখ্যায় আয়াস লাগে; অথচ যে আর্ট ফর্ম ‘অনায়াস’ দেখাইতে সদা সচেষ্ট, তারে ব্যাখ্যা করা আর রামগরুরের ছানা হওয়া একই কথা। তবে রামগরুরের ছানা বা অতিশয় সিরিয়াস হইতে আমার আপত্তি নাই। সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার একটা চালু তরিকা আছে। যেমনঃ প্রবন্ধের চাবি-শব্দ ধরে কিছুক্ষণ বাতেলা দিতে হবে। কই থেকে শব্দটা আসলো? আদি উৎস থেকে কীভাবে শব্দটার বিবর্তন ঘটছে? অভিধানে একটু ঘোরাফেরা করে এসে হালকা পাণ্ডিত্য জাহির করা আরকি। সেই তরিকা অনুসরণ করা যাক।           

মিম জিনিসটা ইন্টারনেটের বাইরে কল্পনা করা কঠিন অথচ মিমের ধারণা ও মিম শব্দটার বয়স কিন্তু ইন্টারনেটের চাইতেও বেশি! দুনিয়া অবারিত তথ্যের এক সমুদ্র। তথ্য বা আইডিয়া এইখানে মানুষের জিনের মতো আচরণ করে। আইডিয়া ছড়ায়, আইডিয়া অন্য আইডিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, ফলে বদলায় এবং নতুন নতুন আইডিয়ার জন্ম দেয়। কিভাবে সাংস্কৃতিক তথ্য বৃহত্তর সমাজে ছড়ায়ে পড়ে, আর বদলাইতে থাকে, তা ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। তার মতে, ‘সকল প্রাণীর কেন্দ্রে তপঃ নাই, নিঃশ্বাসের উত্তাপ নাই, জীবনের স্ফূরণও  নাই। মৌল বিষয় হইতেছে তথ্য, শব্দ, নির্দেশনা।’  ডকিন্স আরও বলতেছেন, ‘জীবনরে বুঝতে চাইলে, জীবন্ত, ছটফটানো জেলি ও পিছ্লা ভ্রুণের কথা ভাইবেন না, চিন্তা করেন তথ্যের প্রযুক্তির কথা।’         

যেহেতু কোনো কনসেপ্ট— একটা আইডিয়া, স্টাইল বা যেকোনো ধরণের আচরণ— যা কোনো সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে; যেহেতু প্রক্রিয়াটা মানুষের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য ট্রান্সমিশনের মতই, ডকিন্স একাক্ষরের একটা শব্দ খুজতেছিলেন যা জিন -এর সাথে অন্তমিল রাখে। এক পর্যায়ে  তিনি গ্রিক শব্দ mimeme (যা অনুসৃত হয়) খুজে পান আর তার বিখ্যাত বই সেলফিশ জিন-(১৯৭৬) এ রিচার্ড ডকিন্স ‘মৌল’ এই বিষয়টার নাম ডকিন্স দিছেন, mimeme। কথাটারই সংক্ষিপ্ত রূপ তথা meme (আমার অনুমান ‘সেলফিশ জিন’ বা ‘রিলিজিওসিটি’ ধরণের নামকরনের চাইতে ভবিষ্যতের মানুষ ডকিন্সরে মনে রাখবে মূলত ‘মিম’ শব্দটার উদ্ভাবক হিসেবেই)। পরে মাইক গডউইন ১৯৯৩ সালে  মেসেজবোর্ড, ইউজারনেট বা ইমেইলে ছড়ানো মিম ব্যাখ্যা করতে গিয়া ইন্টারনেট মিম কথাটা চালু করেন।  

এই লেখায় কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমরা বিস্তারিত জানা-বোঝার চেষ্টা করবো।
মিম কিভাবে কাজ করে?
মিমের স্বভাব-চরিত্রই বা কেমন? 
মিমের সামাজিক প্রভাব—বিশেষত পপুলার কালচারে—কীরকম?
জোকের সাথে মিমের মিল-অমিল থাকলে সেগুলোই বা কেমন?
অনাগত দিনগুলিতে মিমের স্বভাব-চরিত্রের গতিপথ কোন দিকে যাইতে পারে?

আসেন, শুরু করি।    

মিম কী? 
মিমের একখানা সংজ্ঞা একান্ত দিতে হইলে এইভাবে বলা যায়: মিম, মোটাদাগে, দৃশ্য মাধ্যমের এক ধরণের ইনসাইড জোক। চিকনদাগে আরও অনেক কিছু, কিন্তু মোটাদাগের সংজ্ঞাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে। তো, আর্টফর্ম হিসেবে ইন্টারনেট মিম মূলত ভিজুয়াল জোক বা দৃশ্য মাধ্যমের কৌতুক। আর ভিডিও মিম হইতেছে অডিও-ভিজুয়াল জোক। এইভাবে দেখলে মিমের সোশ্যাল বা রাজনৈতিক মাত্রা ও পরিণাম শনাক্ত করা সহজ। জোকে, যেমন– ১টা প্রেক্ষিতবিন্দুর (রেফারেন্স পয়েন্ট) সাথে আরেকটা প্রেক্ষিতবিন্দু জাক্সটাপোজ করা বা একসঙ্গে বসানো হয়, মিমেও সেইটা হয়। ২টা ভিন্ন প্রেক্ষিতের তাৎক্ষণিক বা অভাবনীয় মিলন মজাটা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন প্রসঙ্গে বলছেন কিন্তু হাস্যরস মৌলপ্রবণতা সম্পর্কে তার অনুমানও কাছাকাছি:  ‘হাস্যরসের প্রধান দুইটি উপাদান অবাধ দ্রুতবেগ ও অভাবনীয়তা’ (রবীন্দ্রনাথ: ছন্দ |বাংলা ছন্দে অনুপ্রাস)। এই অভাবনীয়তা প্রেক্ষিতগত সার্প্রাইজ বা চমক থেকে তৈরি হয়। মিমের ক্ষেত্রে জোকের সাথে তফাৎ হইতেছে মিমে টেক্সটের পাশাপাশি ইমেজ বা (ভিডিও মিমের ক্ষেত্রে) মুভিং ইমেজ যুক্ত হয়ে বৈচিত্র্য ও পরিসর আরও বাড়ায়ে দেয়।  

জোকের যে পলিটিক্স বা সামাজিক পরিণাম থাকে মিমের ক্ষেত্রেও তেমনই থাকে। মিমের ক্ষেত্রে, বিষয়টা—এহেম —মিমেটিক অর্থাৎ সাধারণ জোকের চেয়ে লোকের মধ্যে ছড়ায়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে ভাইরাল বা পপুলার ইমেজের মিমেটিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু শেষপর্যন্ত মিম জোকই—পুনরাবৃত্তিযোগ্য এবং পুনরায় নির্মাণযোগ্য জোক। এ কারণেই মিম একটা হাইব্রিড মিডিয়াম— যেখানে সাধারণত ২টা মিডিয়াম (টেক্সট ও ইমেজ/মুভিং ইমেজ) একত্রে হাস্যরস সৃষ্টি করে। এইখানে ভিজুয়াল বা ইমেজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, টেক্সটের চাইতে। কেন?  কারণ, আপনি টেক্সট ছাড়াও মিম বানাইতে পারবেন কিন্তু ইমেজ ছাড়া খালি টেক্সট দিয়া মিম বানাইতে পারবেন না; সেইটা লিখিত জোক হবে।   

জোকের সাথে মিমের মাত্রাগত ভিন্নতাও আছে দৃশ্য মাধ্যমের বইলা টেক্সটের চাইতে মিমে স্বাভাবিক নমনীয়তা বেশি। অবশ্য জোকের বা মিমের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনা যেমন আছে, ডমিন্যান্ট মতাদর্শের পলিটিক্সের বাহন হওয়াও আছে (জোকের বড় একটা অংশ মূলত শ্রেণিবিদ্বেষ ধারণ করে)।   

মজার কোনো ইমেজে উইটি ক্যাপশন থেকে ভাইরাল চ্যালেঞ্জ, চলতি বুলি (ক্যাচফ্রেজ) এমনকি নাচও মিম হইতে পারে। ইন্ডিয়ার সোহম ও মিমি চক্রবর্তী অভিনিত ‘বোঝে না সে বোঝে না’ (২০১২) মুভির ‘নারে নাহ, নারে না ’ নামে একটা হিট গানে নির্দিষ্ট ঢংয়ে নাচের ভঙ্গিটাও আসলে একটা মিম। একইভাবে ইউটিউবের প্রথম গ্লোবাল হিট সং সাই-এর গ্যাংনাম স্টাইল-এর ড্যান্স মুভও মিম। মোদ্দাকথা, সাংস্কৃতিক পরিসরে যার ব্যাপক পুনরুৎপাদন ও পুনর্নিমাণ ঘটে, তারেই মিম বলা যায়।   

মিমের স্বভাব-চরিত্র  

একের সাথে অন্যের মিলমিশের, প্রত্যয়গত (কনসেপ্টুয়াল) ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে এমনকি বিপরীত প্রেক্ষিতের আইডিয়ার মিশেল অর্থাৎ নানান অদ্ভুতুড়ে রিমিক্সিং মিম কালচারের মূল বৈশিষ্ট্য। কালচারে মোটাদাগে এই প্রবণতারে অনেক ক্রিটিক বলেন ‘মেটামডার্নিজম’। মানে হইতেছে মডার্ন সিরিয়াসনেসের সঙ্গে পোস্টমডার্ন আইরনি বা পরিহাসময়তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। ফলস্বরূপ আশা ও নিরাশা, এমপ্যাথি ও এপ্যাথি, একত্ব ও  বহুত্বের পরিষ্কার অবস্থান দেখা যায় না, চলতে শুরু করে অবিরাম ভাব ও ব্যাঞ্জনাগত দোলাচাল। ইন্টারনেটের দুনিয়া কালচারের এই মেটামডার্ন সেন্সিবিলিটি দিয়া ব্যাপকমাত্রায় প্রভাবিত হয়।              

আর মেটামডার্নিস্ট কালচারের নিখুঁত নমুনা হইতেছে মিম। যেমন, মুভি থেকে একটা স্ক্রিনশট নিয়া, ক্যাপশন যোগ করে সম্পূর্ণ নতুন মানে সৃষ্টি করা। সৃষ্টির এই এপ্রোচ মেটামডার্নিস্ট এপ্রোচ। গ্রেগ ডেমবার এক প্রবন্ধে মেটামডার্নিজমের ১১টা এপ্রোচের কথা বলছেন। মজার বিষয় ঐ ১১টা এপ্রোচের সবগুলাতেই মিমরে বসায়ে দিলে হুবহু মিলে যায়।     

মিমেটিক ছবির একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হইতেছে ফ্রেমের দুই বা ততোধিক উপাদানের মধ্যকার বা টেক্সট ও ইমেজের মধ্যকার অসামঞ্জস্য। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা প্রায়শ দেখি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না, ‘যায় না’, অদ্ভুত লাগে। যেহেতু  মিমেটিক ছবি প্রসঙ্গের বাইরের (আউট অব কন্টেক্সট) বিষয়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসে (জাক্সটাপৌজ), অন্যান্য প্রেক্ষিতে তাদের পুনরায় ব্যবহারকে মোটামুটি স্বাভাবিক লাগে। তাছাড়া ফ্রেমে অরিজিনাল মিমেটিক ইমেজের তীব্র ভিন্নতর সহাবস্থানের পাশাপাশি মনে হয় ফটোশপড, রিপার্পাসড। ফলে আরও নতুন নতুন রাস্তা খুলে দেয় আর অরিজিনাল মিমেটিক ফটোর অসামঞ্জস্যতাকে আরও হাস্যকর রকম অসামাঞ্জস্যপূর্ণ করে ফেলা হয়। নমুনা হিসাবে বিখ্যাত ‘ডিজাস্টার গার্ল’ মিমের কথাই ভাবেন। সে খালি ঘরেই আগুন লাগায় নাই, বরং টুইন টাওয়ারে হামলারও মাস্টারমাইন্ড সে!    

মিমের আয়ুষ্কালের প্রধান নির্ধারণী ভূমিকা রাখে তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা
ডিজাস্টার গার্ল, যাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য মিম

ইন্টারনেট মিমের অন্য দুইটা মূল প্রবণতা হইতেছে— সৃজনশীল পুনরুৎপাদন ও ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি।  

সৃজনশীল পুনরুৎপাদন মানে বোঝায় মিমের প্যারডি আর নকলের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠা, যা ঘটতে পারে মিমিক্রি বা রিমিক্সের মাধ্যমে। অন্যদিকে, ইন্টারটেক্সুয়ালিটি বলতে বিষয় বা কালচারের বিভিন্ন অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিক ও প্রেক্ষিতবিন্দু পাশাপাশি থাকা। যেমন, ‘শীতের সোদন’খ্যাত শামসুল ইসলামের মিমটা দেখেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ছবিটা শীতকালের জাতীয় ছবি হয়ে উঠছে। অরিজিনাল ভাইরাল ছবির সঙ্গে কালো চশমা যুক্ত হইছে, ঠোটে জয়েন্ট ধরায়ে এক ধরণের থাগলাইফ-সুলভ ‘কুল’ ভাব এনে দিছে। এর সঙ্গেই আবার Winter Is Here কথাটা যুক্ত হয়ে এনে দিছে গেইম অভ থ্রোনজ এর রেফারেন্সের ব্যাঞ্জনা।            

মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা! 
তুর্কি কবি নাজিম হিকমত লিখছিলেন, প্রেমের আয়ু বড়জোর এক বছর। একই ভঙ্গিতে বলা যায়, মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা। পুঁজিবাদের ত্বরিত গতির দুনিয়ায় যেকোনো ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে যা সত্য, মিমও স্বল্পায়ু। প্রতিটি আলোচিত ঘটনা এখন অজস্র মিমের জন্ম দেয়। আপাতভাবে এইসব মিমের মৃত্যুও হয় খুব দ্রুত। সফলতম মিমগুলারও আয়ু বড়জোর কয়েক মাস। বেশিরভাগ মিম এক সপ্তাহ টিকলেই সেটা অনেক বড় ঘটনা। অধিকাংশ মিম বানানো হয় তাৎক্ষণিকতার বিবেচনায়। বিভিন্ন ও বিচিত্রভাবে বদলে নেওয়ার সুযোগ যত বেশি মিমে থাকে, সেই মিমের আয়ুষ্কাল বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ে।        

মিমের আয়ুষ্কালের প্রধান নির্ধারণী ভূমিকা রাখে তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কৃতি টুকরা এবং সাংস্কৃতিক রেফারেন্সের বাইরে মিম অর্থবহ হইতে পারে না। আগেভাবে বলে দেওয়া যদিও কঠিন, ভাইরাল হয়া যাওয়ার পরে, কোনো মিম কেনো দর্শক-শ্রোতাদেরকে স্পর্শ করতে পারলো বা জনপ্রিয় হতে পারলো তা বোঝা কঠিন নয়। বিরাজমান সাংস্কৃতিক বাস্তবতারে, ও তার সত্যিগুলোরে স্পর্শ করলে তার আয়ুষ্কাল বেশি হওয়া সম্ভাবনা বাড়ে।               

এই ব্যাখ্যা কিন্তু আমাদেরকে অদ্ভুত এক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়ঃ ‘ব্যাড টেক্সটস মেইক গুড মিমস’। অংশগ্রহণমূলক কালচারের নিয়ম যেহেতু ইউজারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অসম্পূর্ণতা বরং পরবর্তী আরও বাহাসের হুক হিসেবে কাজ করে আর মিমের ছড়িয়ে পড়ায় ভূমিকা রাখে। এ কারণে দেখবেন অসম্পূর্ণ, অমার্জিত, আনাড়ি-সুলভ, এবং উইয়ার্ড টেক্সট, ইমেজ বা ভিডিও মানুষরে যেন শূন্যস্থান পূরণ করতে কিংবা ধাঁধার সমাধান বা ক্রিয়েটরকে মক করতে আমন্ত্রণ জানায়। এই আলাপ ‘শূন্যস্থান হিসেবে কন্টেন্টের ছড়িয়ে পড়া বা বিস্তারযোগ্যতা’ নামে হেনরি জেনকিন্স ও তার সহকর্মীদের দেওয়া তত্ত্বের সাথে মেলে।     

স্প্রেডেবল মিডিয়াঃ ক্রিয়েটিং ভ্যালু এন্ড মিনিং ইন আ নেটওয়ার্কড কালচার বইয়ের প্রচ্ছদ

জন ফিস্কের ‘প্রোডিউসারলি টেক্সট’- কথাটার মূল আইডিয়াও একই। মিডিয়া প্রোডাক্ট এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে অসামঞ্জস্যের শুন্যতা পূরণ করতে আমন্ত্রণ জানায়, এবং দর্শক-শ্রোতা নিজেরা যেন সেই শুন্যতা পূরণ করে, ফলে অর্থবহ হয়ে ওঠে।       

মিম ও পপুলার কালচার  

মিডিয়া তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহানের বিখ্যাত উক্তি ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ’। অর্থাৎ বিষয়বস্তু অনেকাংশেই প্রভাবিত হয় সেটি কোন এবং কেমন মিডিয়ামে হাজির হয় তার প্রযুক্তিগত শর্তসমূহ দিয়া। কাঠামোর দিক দিয়া ইন্টারনেট অন্য সকল মিডিয়ার—- টিভি, রেডিও, খবরের কাগজের— চেয়ে আলাদা।  অন্য মিডিয়াতে তথ্যের একমুখী প্রবাহ ঘটে। এইসব মিডিয়ায় শেয়ার করা আইডিয়া আমজনতার কাছে ছড়ায়ে পড়তো। কী ছড়াবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতো একটা ছোট্ট গ্রুপ— সম্পাদকীয় বোর্ড, মালিকপক্ষ বা ছোট এলিট। কিন্তু ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহের এই নিয়ন্ত্রণ কোনো এলিট গোষ্ঠীর হাতে নাই। ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট মিমের মতো বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রাউড। 

জনগনের একটা বড় অংশ কোন জিনিসটা ফানি, ইন্ট্রেস্টিং বা বিরক্তিকর মনে করেছে— তার একটা রোডম্যাপ পাওয়া যায় মিমের ডেটাবেজে। এই দিক দিয়া know your meme কিংবা বাংলায় memelate ধরণের সাইট এই বিবেচনায়,  টাইম ক্যাপসুলের কাজ করে। ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি দেখতে পারে যে ২০২৪ সালে কী কী বিষয় ভাইরাল হইছিলো—আমরা কেমন ছিলাম সে ব্যাপারে তাদের স্পষ্টতর ধারণা হবে।  ইন্টারনেট কালচারের মানচিত্রও বলা যায় মিমরে।  

মানুষের আচরণ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে মিম।  যতক্ষণে মিম একটা বড় অডিয়েন্সের কাছে পৌছায়, ততক্ষণে শত শত পুনঃপ্রেক্ষিতকরণের (রিকন্টেক্সটচুয়ালাইজেশন) ভেতর দিয়ে গেছে। অরিজিনাল ইমেজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাগলাইন ও প্রেক্ষিত থেকে নতুন মিম বানায়, স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান যেমন পুরনো জোকরে নতুন প্রেক্ষিতে হাজির করে। আর যে ভার্শনটা ভাইরাল হয় সেইটা প্রকাশ করে আমাদের ঠিক কোন জিনিসটা স্পর্শ করে।  

ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের ভূমিকা বুঝতে, আমাদেরকে প্রথমে বোঝা দরকার, মিমে সমকালীন পপুলার কালচারের প্রতিফলনই মূলত ঘটে। ফলে এর মধ্যে সামাজিক প্রথা, যৌথ অভিজ্ঞতা ও ক্রমপরিবর্তনশীল ট্রেন্ড চলে আসে। অধিকাংশ ইন্টারনেট মিমের উৎপত্তি পপুলার কালচারে। ক্লাসিক মুভি, টিভি সিরিজ, মিউজিক এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাও মিম সৃষ্টির মূল হিসেবে কাজ করতে পারে। পপুলার কালচারের আইকনিক ক্যারেক্টার, চলতি বুলি, ও স্মরনীয় মুহূর্ত ইন্টারনেট মিমে নতুন জীবন পায়। একটা উদাহরণ ‘ডিস্ট্র্যাকটেড বয়ফ্রেন্ড’ মিম এ দেখা যায় এক  পুরুষ অন্য নারীর দিকে তাকাচ্ছে, আর পাশেই তার প্রেমিকা সেটে দেখে রেগে আছে। ইউজাররা এই ইমেজটা আদি প্রেক্ষিতের বাইরেও অজস্র প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে। ফলে মিমের ভাইরাল টেমপ্লেট হয়ে উঠেছে।  

মানুষ রিলেট করতে পারে বা যারে ঘিরে তারা বন্ধন তৈরি করতে পারে—এমন যৌথ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পপ কালচার।
মিম এই যৌথ অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে এবং এক ধরণের আত্মীয়তার বোধ জাগায়। একটা প্রিয় মুভি হোক, বিখ্যাত মিউজিশিয়ান বা রিয়ালিটি শো’র মুহূর্ত হোক, মিম যৌথ সংস্কৃতির এই স্পর্শবিন্দুকে স্পর্শ করে মানুষকে একত্র করে। মিম কেবল পপ কালচারের প্রডাক্ট নয়; মিম সেই কালচারের ক্রিটিক ও ভাষ্য রচনার হাতিয়ারও। ট্রেন্ড, সেলেব্রিটি বা সামাজিক ইস্যুতে স্যাটায়ারিকাল ও ক্রিটিকাল পার্স্পেক্টি হাজির করে। বিজ্ঞাপনের এবসার্ডিটি বা সেলেব্রিটি স্ক্যান্ডাল নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মিম একটা পরিসর হাজির করে যেখানে আইরনি ও হিউমারের মাধ্যমে কালচারাল ও পলিটিকাল ডিস্কোর্সে অংশ নিতে পারে।      

মিমের দ্রুত চেহারা বদল 

ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের প্রভাব ডাইনামিক ও ক্রম-বিবর্তনশীল। পপ কালচাররে নতুন ঘটনা অনুযায়ী মিমও এ্যাডাপ্ট করে নেয়। কোনো নতুন স্ট্রিমিং সিরিজ, রাজনৈতিক ঘটনা, ক্যাচি টিউন জনপ্রিয়তা পাইলে, ইন্টারনেট দ্রুত এইসব সাংস্কৃতিক মুহূর্তকে মজাদার ও রিলেটেবল মিমে রূপান্তরিত করে।  

পপ কালচার আর মিম কালচার বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই সাংস্কৃতিক চক্র সৃষ্টির মাধ্যমে  কাজ করে। মিম পপুলার কালচার থেকে যেমন প্রেরণা নেয়, অন্যদিকে পপ কালচারের বিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। মিম পুরনো মিডিয়ায় আগ্রহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ক্লাসিক ফিল্ম বা মিউজিকরে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে, এবং অবশ্যই ব্র্যান্ড ও সেলেব্রিটিদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজিতে ভূমিকা রাখতে পারে।  


মিমের ভবিষ্যৎ  

ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা কঠিন। ভবিষ্যত নিয়া আসে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা। এইটা ক্রমশ বিবর্তমান প্রযুক্তি, কালচার, ও সামাজিক গতিশীলতা দিয়া প্রভাবিত হয়। তবে প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি দেখে অদূর ভবিষ্যতের মিমের প্রবণতা সম্পর্কে মোটাদাগে কিছু মন্তব্য করা সম্ভব। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের পরে, আমরা এআই জেনারেটেড মিমের আধিক্য ভবিষ্যতে দেখতে পারি। এখন বেশিরভাগ মিমের কন্টেন্ট কোনো নাটক-সিনেমা বা বাস্তবজীবনের ভাইরাল ছবি থেকে করা হয়। কিন্তু এআইএর ফলে অরিজিনাল ইমেজটাই কৃত্রিমভাবে নির্মিত হইতে পারে। মিম বানানোর ক্ষেত্রে, আগামী দিনগুলিতে ডিপফেইক প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চয়ই বাড়বে। ফলে বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য আরও কমে আসবে।   

বিশাল ফলোয়ারওয়ালা এআই জেনারেটেড ক্যারেক্টারগুলো, যাদেরকে বলা হয় ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার, মিমরে তাদের কন্টেন্টে নিয়া আসতে পারে। ফলে তৈরি হবে ইন্টারনেট মিমের নতুন ধরণের ভ্যারিয়েশন। ইন্টারনেট বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ানোর ফলে, আমরা হয়তো আরও বেশি বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রেফারেন্স মিমে দেখবো; বৈশ্বিক ফিউশন একই মিমের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে। আর এর ফলে প্রকৃত বৈশ্বিক মিম কালচারের উত্থান দেখবো। মিম কালচারের ক্রমবর্ধমান জটিল অবস্থা ও সচেতনতার ফলে, আমরা এমন মিমও হয়তো দেখবো যে মিম নিজেই মিম-কালচার ও মিমের প্রকৃতি নিয়া কমেন্ট করবে, চুটকি করবে, বা মিম ট্রেন্ড এনালিসিসও মিমের মধ্যে ঢুকে পড়বে। এরে মেটামিম বলা যাইতে পারে। যত রকম পরিবর্তনই আসুক না কেন, মিম যে বড় একটা সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে থেকে যাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। যতদিন দুনিয়াতে ইমেজের প্রতি নির্ভরতা থাকবে, ভার্চুয়াল ও রিয়ালের মধ্যে ব্যবধান কম থাকবে, ততদিন মিমও আমাদের নিত্যদিনের এক্সপ্রেশনের অন্যতম ফিচার হিসেবে থাকবে। 

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন