মনোযোগের অর্থনীতি যেভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে

অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি

এই লেখা পড়তে পড়তে এই মুহূর্তে  আপনি আর কতগুলো কাজ করছেন? ইমেইল বা টুইটার ফিড চেক করছেন নাকি আপনার ফেসবুক পেজ আপডেট করছেন?    

পাঁচ বছর আগে ডেভিড ফস্টার ‘টোটাল নয়েজ’ সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘প্রতিটি জিনিস ও অভিজ্ঞতার উত্তেজক দৃশ্য আর একজন মানুষের অনন্ত বিকল্প থেকে পছন্দ করার স্বাধীনতা’। এই টোটাল নয়েজ বর্তমান দুনিয়ায় যাপিত-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগামী বছরের মধ্যে এই দুনিয়া হয়তো তার ৮  বিলিয়ন বাসিন্দার প্রত্যেকের জন্য একটি মোবাইল ফোন নিয়ে বড়াই করবে।          

আমরা সকলেই মনোযোগের কাঁচা অর্থনীতিবিদ, কেননা আমরা মুহূর্তগুলো জমিয়ে লেনদেন করছি — অথবা হাজার হাজার ইউটিউব ক্লিপের মধ্যে এই মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেতে দেখছি।  বিনামূল্যে অনলাইন সেবা গ্রহণ করে থাকলে—আপ্তবাক্য মতে—আপনি নিজেই হচ্ছেন পণ্য। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপনি না, বরং আপনার আচরণ ও ব্যস্ততার পরিমাপযোগ্য তথ্য, যা ক্রমাগতভাবে বিক্রির জন্য জমানো ও মেশানো হচ্ছে, আর আপনার প্রতিটি কার্যকলাপ ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে এবং ইউজারদের ধরে রাখার মেকানিজমে পরিণত হচ্ছে।           

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘আপওয়ার্থি’-তে প্রকাশিত স্লাইড শো ‘ওয়েবসাইট ফর ভাইরাল কনটেন্ট’ বিবেচনা করুন। স্লাইড শো’টি অনলাইনে মনোযোগ শিকারের কায়দা-কানুন বিস্তারিত বর্ণনা করে। তারা দেখান যে, সত্যিকার অর্থে ভাইরাল হতে হলে কনটেন্ট হতে হবে এমন যেন লোকে কনটেন্টটিতে ক্লিক করে এবং সবার সাথে শেয়ার করে যারা নিজেরাও কনটেন্টটিতে ক্লিক ও শেয়ার করবে। মানে হলো এমন সব কনটেন্ট বাছাই করা যা মানুষকে তাৎক্ষণিক আকৃষ্ট করবে। সারাংশ, শিরোনাম, উদ্ধৃতি, চিত্র এবং টুইট যেখানে এমন নিখুতভাবে সাজানো থাকে যা কনটেন্টটি ছড়াতে সাহায্য করবে। সহজ ভাষায় এর মানে হচ্ছে একই কনটেন্টের ২৫টি ভার্সন বানানো,  সেগুলোর মধ্য থেকে সেরাটা বাছাই করা এবং সাইটের প্রতিটি জিনিস ক্রমাগত বদলাতে প্রস্তুত থাকা। আপনাকে ক্রমাগত প্রচুর পরিমাণে কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে যেন আপনার কনটেন্ট হিট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে আর একই সাথে ফেসবুকে চোখ রাখতে হবে। এভাবেই আপওয়ার্থি তাদের সবচেয়ে ভাইরাল হিট পেয়েছে। পোস্টটির শিরোনাম ছিল: ‘বুলি কলস নিউজ অ্যাঙ্কর ফ্যাট, নিউজ অ্যাঙ্কর ডেস্ট্রয়স হিম অন লাইভ টিভি’ এবং যা ফেসবুকে ৮০০,০০০ এর বেশি লাইক এবং ইউটিউবে ১১ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।                          

এমনকি আপওয়ার্থির মতো প্রচেষ্টাও শক্তিশালী অ্যালগরিদমিক সাইটগুলোর কাছে তুচ্ছ। এমনই একটি সাইট হচ্ছে ইয়াহু!। আমেরিকান লেখক ও মার্কেটার রায়ান হলিডের মতে, ইয়াহু!র হোম পেজে প্রতি পাঁচ মিনিটে ৪৫,০০০টিরও বেশি শিরোনাম এবং ছবির কম্বিনেশন পরীক্ষা করে। ঠিক যেমন খাবার ও পানীয় স্বাদ, টেক্সচার ও লোভনীয় উপাদান বাড়াতে কর্পোরেশনগুলো যেমন সেগুলো খাওয়া বন্ধ করা কতটা কঠিন তা পরিমাপ করে অনলাইনে প্রতিটি ব্যক্তির কার্যকলাপ মাপে। এক্ষেত্রে অনিবার্য হওয়া মানেই বেশি ভালো: বেশি পাঠক, বেশি দর্শক, বেশি এক্সপোজার, বেশি প্রভাব, বেশি বিজ্ঞাপন, ডেটা সংগ্রহ ও বিক্রির আরও বেশি সুযোগ। 

আমরা এমন জটিল এক পৃথিবীতে আছি যেখানে আমাদের জাগ্রত সময়ের বেশিরভাগ অংশ মিডিয়া দেখা বা মিডিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যয় হচ্ছে
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

মনোযোগ তেল বা সোনার মতো নিষ্ক্রিয় কিন্তু সীমিত এক সম্পদ: এটি লেনদেনযোগ্য সম্পদ যা দক্ষ ম্যানিপুলেটররা সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে নিলাম করে বা যা থেকে লাভের আশা করে। এমনকি সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনের উপমা দিয়ে বিশ্বের ‘পিক অ্যাটেনশন’-এ পৌঁছানোর কথাও বলা হয়েছে, যার মানে হচ্ছে এখন মানুষের কাছে ব্যয় করার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ আর নেই।           

সময়কে বোঝার এটা একটি উপায়। এটা এমন সংখ্যাগত পরিমাপ যা গুণগত দিকগুলোকে চাপা দিয়ে দেয়। আমেরিকান লেখক মাইকেল এইচ গোল্ডহেবার, কয়েক বছর আগে ওয়্যার্ড ম্যাগানিজের এক লেখায় বিষয়টিকে ‘অ্যাটেনশন শপার্স’ নামে শনাক্ত করেন। তার যুক্তি হচ্ছে, ‘মনোযোগ বহু রূপে আসে: প্রেম, স্বীকৃতি, কথা শোনা, আনুগত্য, চিন্তাশীলতা, যত্ন নেওয়া, প্রশংসা করা, দেখাশোনা করা, কারও ইচ্ছার প্রতি খেয়াল রাখা, সাহায্য করা, পরামর্শ দেওয়া, সমালোচনামূলক মূল্যায়ন, নতুন দক্ষতা বিকাশে সহায়তা ইত্যাদি। ম্যাডোনা যে ধরনের মনোযোগ চান, একজন সেনা সার্জেন্ট সৈন্যদের আদেশ দেওয়ার সময় সেই ধরনের মনোযোগ চান না। আমি এই লেখার ক্ষেত্রে যে ধরণের মনোযোগ চাই তিনি তেমনটাও চান না।’ 

আমরা এমন জটিল এক পৃথিবীতে আছি যেখানে আমাদের জাগ্রত সময়ের বেশিরভাগ অংশ মিডিয়া দেখা বা মিডিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যয় হচ্ছে। অথচ মনোযোগ জিনিসটা যে কী তা আমরা ভালো করে বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয় না। মাপামাপির নতুন পদ্ধতি আসার সঙ্গে সঙ্গে, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে সৃষ্ট একটি রিসোর্সের ভিত্তিতে যেখানে আমাদের ব্যবসায়িক ও মানসিক মডেল তৈরি, সেখানে আমরা আসলে কী নিয়ে কথা বলছি?    

ল্যাটিন ভাষায় ক্রিয়াপদ অ্যাটেন্ডার – যা থেকে ‘অ্যাটেনশন’ শব্দটি এসেছে – এর আক্ষরিক অর্থ হল ‘দিকে প্রসারিত করা’। ‘অ্যাড’ (‘এর দিকে’) এবং ‘টেন্ডার’ (প্রসারিত করা)- এর একটি যৌগিক শব্দ, যা একটি প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্রকে আহ্বান করে: এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য, মনো-দৈহিক উভয় দিক দিয়েই তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।  

মনোযোগ প্রত্যাশার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সৈন্যরা মনোযোগকে মূর্ত করতে আর প্রস্তুতি ও সম্মান প্রদর্শন করতে মুহূর্তের মধ্যেই মনোযোগী হয়ে যায়। একে অপরের মন পড়তে অক্ষম হওয়ায় আমরা মনোযোগের বাহ্যিক প্রদর্শনী চাই। অমনোযোগী ছাত্রদের এলোমেলো চিন্তাভাবনা থেকে বাস্তব জগতে ফেরত আনতে শিক্ষকরা চিৎকার করে বলে ‘মনোযোগ দাও!’।  দৈহিক অভিনিবেশ, সময় দেওয়া আর হাজির থাকা আমাদের তরফে বেসিক এমন কিছুর প্রক্সি যা আসলে প্রমাণ করা যায় না। এই বেসিক জিনিসটা হচ্ছে নিজেদেরকে বুঝতে চাওয়া।  

মনে করা হয় সেরা শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঙ্গে চেঁচামেচি করেন না – কারণ তারা ছাত্রদের প্ররোচিত করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা ও আগ্রহ তৈরিতেও দক্ষ। পারসুয়েড করা বা ভজানো বিষয়টা প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে শিক্ষার প্রধানতম অংশ ছিল। ২১০০ বছর আগের অলঙ্কারশাস্ত্রের বই, রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম-এ যেমনটা বলা হয়েছে: ‘আমরা চাই আমাদের শ্রোতারা হবে ভাবগ্রাহী (রিসেপ্টিভ), সুবিবেচক আর মনোযোগী (বিনয়ী, সদয়, মনোযোগী)।’  সভ্য হওয়ার মানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যেমন, আইন ও প্রথা, আনুগত্য ও ন্যায়বিচার—সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো এবং অন্যদেরকে একমত করে তোলে এমনভাবে কথা বলা।      

এতে জোর দেওয়া আদর্শবাদ বা মর্যাদার বিষয় ছিলো না, ছিল পাঁচ-ধাপের বাস্তববাদী এক প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াগুলো হলো মনোগ্রাহী একটা প্রস্তাব হাজির করা, উপাদানগুলোকে সুচারুভাবে সাজানো, স্টাইলকে আরও হৃদয়গ্রাহী করা, মানুষের স্মৃতিতে বা মিডিয়াতে ফলটাকে তুলে ধরা, এবং সর্বোচ্চ প্রভাবের জন্য উপস্থাপন করা। এ যেন প্রাচীন ‘শেয়ার’ বাটনের সংক্ষিপ্ত রূপ! ভাইরাল হওয়ার জন্য আপওয়ার্থির রেসিপির সাথে মিলগুলো বেশ অবাক করা। প্রথাগতভাবে যাকে রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম–এর রচয়িতা ভাবা হয়, সেই সিসেরোও, তার ব্যবসার জন্যে চাটুকারিতা, ঘুষ, পক্ষপাতের তদবির করতে এবং অসত্য বলাতেও আপত্তি করতেন না। আসল ব্যাপার হচ্ছে ফলাফল।     

তবে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ব্যাপারে ব্যক্তির অন্যের কথা শোনার চেয়েও বেশি কিছু আছে। আর পরিমাপ এবং পারসুয়েশন প্রক্রিয়ার কিছু অপ্রীতিকর দিকও আছে। অনলাইনে পুরো বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমি হয়তো সিস্টেমের নিয়ম মেনে খেলতে পারি — লাইক, লিঙ্ক, মন্তব্য, ক্লিক, শেয়ার, রিটুইট করে— অথবা এই সকল সিস্টেমের জন্য অযোগ্য হতে পারি। আমেরিকান লেখক এবং সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী ডেভিড অয়ারবাচ এটিকে n+1 ম্যাগাজিনে ‘দ্য স্টুপিডিটি অফ কম্পিউটারস’ (২০১২) লেখায় উল্লেখ করেন, স্ক্রিনে যা আছে তা আমার জটিলতার মতো কিছুই দাবি করে না: ‘যেহেতু কম্পিউটার আমাদের  কাছে আসতে পারে না এবং আমাদের জগতে আমাদের সাথে দেখা করতে পারে না, তাই আমাদের নিজেদের জগতকেই মানিয়ে নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবন এবং নিজেদের সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিগুলো এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করব যেন একটি কম্পিউটার বুঝতে পারে। যন্ত্রের এই মূর্খতা আমাদের হয়ে যাবে।’   

কম্পিউটিংয়ের ভাষায়, সিস্টেমটি ‘বোঝে না’ এমনভাবে কিছু করা মানে কিছুই না করা। অবোধগম্য, অযৌক্তিক, —-যেমন প্রিন্টারে কাগজের পরিবর্তে কলা ঢোকানোর মতো ব্যাপার। যা গণ্য হয় তা যা গণনা করা যায় তার সমার্থক। এই সবকিছু সিস্টেম আর্কিটেক্টদের হাতে দায়িত্বের পাশাপাশি অপরিসীম ক্ষমতাও দেয়: কোডার, ডিজাইনার, বিজ্ঞাপনদাতা, পেশাদার মিডিয়া ম্যানিপুলেটর এবং সামাজিক মিডিয়া গুরুরা লাভজনক ক্লিক করার জন্য নিবেদিত।  

পাপেটিয়ারের মতো অনায়াসে সকলের মনোযোগ টানার এই কল্পনা—গিকদের ফ্যান্টাসি পূরণ বা প্রাচীনপন্থী প্রযুক্তি-বিরোধীদের যতই মাথাব্যাথার কারণ হোক না কেন— স্পষ্টত সন্দেহজনক। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ চার্লস গুডহার্ট ১৯৭৫ সালে একটি অ্যাফোরিজমে যুক্তি দিয়েছিলেন যা গুডহার্টের আইন হিসেবে পরিচিত, ‘কোনো পরিমাপ যখন একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়, সেটা তখন আর ভালো পরিমাপ থাকে না।’ মনোযোগ অর্থনীতির মৌলিক ত্রুটি সম্পর্কের এর চেয়ে ভালো পর্যবেক্ষণ খুব কমই আছে।  

মনোযোগ-এঞ্জিনিয়াররা যেন ব্যক্তিগত মুদ্রার জন্য ছাপাখানা বিতরণ করছেন— আর প্রত্যেকেই যত বেশি সম্ভব সেই মুদ্রা বানিয়ে নিতে মরিয়া— সেটা যেভাবেই সম্ভব হোক না কেন। মনোযোগের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা ঘটছে সেটি যৌক্তিক ও ন্যায্য বাণিজ্যের চেয়ে বরং নৈরাজ্যকর লুটপাট বলাই শ্রেয়।  

অ্যালগরিদম এবং ফিল্টার যতই ধূর্ত হোক না কেন, মনোযোগ উৎপাদনের সমগ্র ইন্ডাস্ট্রি মুনাফার প্রতিটি সম্ভাবনার সাথে প্রস্ফুটিত এবং বিবর্ণ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে অর্জনগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কম বেতনের কর্মীদের ‘ক্লিক ফার্ম’ থেকে অকৃত্রিম এনগেজমেন্ট কামাই করা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটিদের বিপুল সংখ্যক কেনা ফলোয়ার এবং ভুয়া মাঠকর্মীদের মাধ্যমে পেইড এনগেজমেন্ট। প্রতিটি লক্ষ্য ক্রমাগতভাবে সরানো হচ্ছে, পরিমার্জিত হচ্ছে এবং অবমূল্যায়িত হচ্ছে। কারো কোনো নিয়ন্ত্রণে নেই।    

আর কেই বা বলবে যে কাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত? বিস্তৃত পরিসরে ডেটাকে দেখলে, ডেটার জটিল শৃঙ্খল রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে দেখে আমার সহজেই তথ্যসমুদ্রে দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ এটা বড়জোর একটা ক্যাটাগরি এরর! আর সবচে নিকৃষ্ট হতে পারে বুলশিটে ডুবে যাওয়া: সুবিধাজনক প্রপাগান্ডা এবং সান্ত্বনাদায়ক আত্ম-প্রতারণার মিশ্রণ যা নতুন ধরনের এজেন্সিকে অভ্যর্থনা জানায়, অফারে যা আছে তার বেশিরভাগের তির্যকতা স্বীকার না করেই।    

প্রবন্ধ সংকলন ‘Tremendous Trifles’ (১৯০৯)-এর ভূমিকায়, ইংরেজ লেখক, অনটোলজিস্ট এবং পেশাদার প্যারাডক্স-কারিগর জি কে চেস্টারটন, দুটি ছেলের গল্প বলেছিলেন যাদের প্রত্যেককে একটি ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একজন আকারে দৈত্য হতে চেয়েছে; আরেকজন চেয়েছে আকারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হতে। অবাক করা ব্যাপার হলো, দৈত্য তার পায়ের নিচের সঙ্কুচিত জমিতে উদাস অনুভব করতে লাগল। অন্যদিকে ছোট ছেলেটি আনন্দের সাথে তার সামনের বাগানে যে বিস্ময়ের অন্তহীন জগৎ আছে তা অন্বেষণ করতে রওনা দিল। চেস্টারটনের মতে, এই গল্পের নৈতিক দিকটা ছিল দৃষ্টিকোণ:  ‘যদি কেউ বলে যে আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরি করছি, আমি তা গর্বের সাথে স্বীকার করি। আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরির চেয়ে বেশি সফল এবং ফলপ্রসু রূপ কল্পনা করতে পারি না…সবকিছুর শীর্ষে যাওয়া, সবকিছুকে উপেক্ষা করা, পর্বতারোহণের এই সমস্ত বাস্তব মূল্য সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যিশুকে যখন একটি উচ্চ পর্বতের চূড়ায় নিয়ে তাকে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য দেখিয়েছিল, তখন শয়তান ছিলো আলপাইন গাইডদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু চূড়ায় দাঁড়িয়ে শয়তানের আনন্দ বিশালতায় নয়, বরং ক্ষুদ্রতা দেখার মধ্যে ছিল, কারণ তার পায়ের কাছে সমস্ত মানুষকে পোকামাকড়ের মতো লাগছিলো।’    

বৈশ্বিক জলাধারে জল ছলকে ওঠার উপমায় প্রতিটি জীবন্ত মানুষের মনোযোগকে দেখার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক ব্যাপার আছে। যৌথ নির্মাণ হিসাবে মনোযোগের এই ধারণা যতটা বাজেট খরচার সাথে মেলে, তার চেয়ে সহানুভুতির সাথেই বেশি যেহেতু মেলে, বেখেয়াল মুহূর্তগুলোতে নিজেদের প্রতি, আমাদের পরিপার্শ্বের প্রতি আমরা যখন মনোযোগ দিই, বা না দিই, তখন পরিসরটা আসলে কোথায়?      

অন্যভাবে দেখলে, তথ্য নিজেই সকলের দড়ি টানছে: ফ্রি-রেঞ্জিং মিমের মতো যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল নিজের ছড়িয়ে পড়া এবং যার উন্মত্ত বিবর্তন সমস্ত পূর্ববর্তী হিসাবকে ছাড়িয়ে যায়। এটি চেস্টারটনের শয়তানের পাহাড়চুড়ার দৃশ্য, যা ব্রাউজারের কানে ফিসফিস করে: আপনি যে বাটনে ক্লিক করছেন তার মতো নিজেকে রূপান্তরযোগ্য ভাবুন, যে সিস্টেমে জড়িত আছেন তার মতো নিজেকে স্বয়ংক্রিয় মনে করুন। দূর উচু থেকে দেখলে, আপনি আপনার রেকর্ড করা কর্মের বাইরে কিছুই না। 

টোটালাইজিং সকল ভিশনের মতো, অভিনিবেশ সহকারে দেখলে, এটি একইসঙ্গে যেমন শক্তিশালী, তেমনি বিভ্রান্তিকরও। দূর থেকে দেখা অভিজ্ঞতায় অস্পষ্ট কিছু, কাছে থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা মনোযোগকে ‘সহজে রূপান্তরযোগ্য সম্পদ’-এ পরিণত করতে গিয়ে সময়কে আমরা যতটা অবমূল্যায়ন করছি ততটা অর্থ উৎপাদন করছি না।   

৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপনের মূল্যে আমরা এখন ভিডিও দেখি; আমরা বন্ধুদের এন্ডোর্সমেন্টের অনুরোধ করি, স্টেটাস আপডেট আর গৎবাধা প্রতিক্রিয়ায়, বাক্যের পর বাক্যে, ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা ব্যয় করি। এগুলোর কোনোটিই আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সকে নষ্ট করে না। অথচ এর মোট খরচ, পরিমাপ করা কঠিন হলেও, ঋদ্ধ সম্পর্ক, অমূল্য  অবসর, অর্থপূর্ণ কাজ কিংবা  মানসিক শান্তির মতো এমন অনেক কিছুকে প্রভাবিত করে যা আমরা একটি সুখি জীবনের কেন্দ্রে রাখতে চাই।    

চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রাপ্য বা কী ধরণের মনোযোগ তাদেরকে দেওয়া উচিত? পরিপূর্ণ অর্থে ‘আমরা’ হয়ে উঠতে চাইলে, কী ধরণের মনোযোগ আমরা ডিজার্ভ করি বা কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রয়োজন?  এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে বানানো জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাও দিতে অক্ষম। অবশ্য পরিতৃপ্তি এবং নিয়ন্ত্রণবোধ যদি সাফল্যের আংশিক পরিমাপও হয়, তবে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে খুব সস্তায় বিকিয়েছি।      

আপনি কি এখনও মনোযোগ দিতে পারছেন? আমি লক্ষণগুলো বের করতে পারি, কিন্তু অবশেষে আপনি কী ভাবছেন বা করবেন তার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। আর এখান থেকেই যেকোনো গঠনমূলক আলোচনার শুরু হতে পারে। আপনাকে যে যাই বলুক না কেন, আমাকে উপেক্ষা করার কিংবা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনার আছে।    

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন