বিষয় অসমতাঃ সেরা ৭ সিনেমা

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক

বিত্তহীন আর বিত্তবানদের  (পাওয়া না পাওয়াদের) গল্পের বয়স ইতিহাসের বয়সের সমান। যেদিন থেকে মানুষ সমাজে বাস করে আসছে, তখন থেকেই কিছু মানুষের অনেক আছে এবং কিছু মানুষ থেকে গেছে না পাওয়াদের দলে। গত কয়েক বছর ধরেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, সম্পদের বৈষম্য, আয়ের অসমতা, এবং লিঙ্গ, সম্প্রদায় বিষয়ক নানামুখী আলোচনা আমাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু হয়ে এসেছে।          

তারপর সামাজিক বৈষম্য ফুটিয়ে তোলে, এমন অনেক মুভিই আমাদের সামনে এলো। প্রান্তিকীকরণের পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছে- এমন অসংখ্য মুভির জন্য ২০১০ এর দশককে যেতে পারে শ্রেণিযুদ্ধের সিনেমার দশক। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারদের সাথে ফাইট দেওয়া জোকার থেকে শুরু করে ছোট্ট ছেলেটার সাথে নিজেই প্রতারণা করা উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট – শ্রেণি সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুভি-সিনেমার মত যুতসই মাধ্যম আর হয় না।    

অবশ্য, সামাজিক অসাম্য নিয়ে সিনেমা কেবল অতীতের বিষয় না। এক শ’ বছরের বেশি সময়ে, বেশ কিছু দারুণ মুভি তৈরি হয়েছে, যেগুলো উদ্ভাবনী গল্প বলার কায়দায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর ব্যক্তিগত পক্ষপাত নিয়ে দূরদর্শী বার্তা দিয়েছে। হতে পারে সেটা ২০ এর দশকের রাশিয়ার লেবার ইউনিয়ন নিয়ে বলা রূপক কাহিনী অথবা একজন টেলিমার্কেটারকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কমেডি। সামাজিক অসাম্য আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যের পুরোভাগেই আছে আর একই রকম গুরুত্ব পাচ্ছে সিনেমার ফ্রেমেও।    

এই লিস্টে আছে এই সময়ের সবচে আইকনিক, আলোচিত ৭টি সিনেমা। এই লিস্টে অবশ্য কিছু পুরাতন সেরা মুভিও আছে, যেগুলো এই কালচারাল আলাপগুলোকে সিনেমায় স্থান পাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। এখানে সামাজিক অসাম্য নিয়ে সেরা ৭টি  মুভির কথা বলছি। বলা বাহুল্য লিস্টমাত্রই অপূর্ণাঙ্গ ও সাবজেক্টিভ এবং নির্দিষ্ট মাত্রার বায়াস অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেকে যাবেই। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রের মুভি আছে দুটি। এশিয়ার মুভি দুটি, ইউরোপের দুইটি অর্থাৎ কোনো সামঞ্জস্য নাই। কেবল একটি বিষয় সবগুলো মুভির ক্ষেত্রে কমনঃ প্রতিটি সিনেমাতেই সামাজিক অসমতা কেন্দ্রীয় অংশজুড়ে আছে। তবে আমাদের বিবেচনায় সামাজিক অসাম্যের বাইরেও গল্পগুলো গল্প, অভিনয় কুশলতা ও নির্মাণশৈলীর কারণে অনন্য। আসুন দেখে নিই ‘সেমসেম সেরা-৭’ এর প্রথম সিনেমা লিস্ট।   

 ৭.  ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট (২০১৭)  [যুক্তরাষ্ট্র] 

‘দ্য ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট’ সিনেমার পোস্টার

দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট  সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলির হৃদয়-বিদারক চিত্র। দারিদ্র্যে জর্জরিত পরিবার। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের কাছের একটা স্ট্রিপ মোটেলে বাস করা এই পরিবারের আকস্মিক একটা ঘটনা দিয়ে পরিচালক গল্প শুরু করলেও এটা মানুষের মরিয়া হয়ে ওঠা আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে  সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিলতা  আর সংকটকে তুলে ধরে।

 আবার অন্যভাবে দেখলে, সিনেমাটি ছয় বছর বয়সী মুনি এবং তার উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদেরও গল্প। এরা ম্যাজিক ক্যাসল হোটেলে কারো তত্ত্বাবধান ছাড়াই থাকে, হালকা পাতলা দুষ্টামি করে আর পাগলের মত ছোটাছুটি করে। এদিকে তার মায়ের একটা সুস্থির জীবন যাপন করতেই যুদ্ধ করতে হয়। এমন বাজেটে তার সংসার চলে যেখানে একবার বাড়ি ভাড়া দিতে লেট করলেই বাসা ছাড়তে হতে পারে। প্রয়োজন মেটাতে সে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিন্তু হিসাব করা কিছু সিদ্ধান্ত নেয় – যেমন ডিজনী ওয়ার্ল্ডের পাস চুরি করা, গেস্ট রুমের খাবারের চার্জ ধরা এবং এক পর্যায়ে পতিতাবৃত্তিও। শিশুর উচ্ছ্বল আনন্দে ভরা শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি আর করুণ দারিদ্র্যের বৈপরীত্য এমন সব মুহূর্তের বুনন তৈরি করে যা দর্শকদের সহানুভুতি তৈরি করে। নির্মাতা শন বেকারের স্বভাবসুলভ তীর্যক ভঙ্গি এই সিনেমাতেও পাওয়া যাবে।      

৬. রোমা (২০১৮) [মেক্সিকো]

রোমা সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার

‘ই তু মামা তামবিয়েন’ (Y tu mamá también) –এর পর প্রথম আলফোনসো  কুয়ারোনের মাতৃভাষায় প্রথম সিনেমা। ১৯৭০ এর দশকের মেহিকো সিটির কোলোনিয়া রোমা এলাকার এক ডাক্তার পরিবারের এক নারী গৃহকর্মী। নাম ক্লেওদেগারিয়া ‘ক্লেও’ গুতিয়েররেজ। চাকরিদাতা পরিবারের প্রধান কাজের সূত্রে কুইবেক যায় ( পরে প্রকাশ পায় যে সে আসলে পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে চলে যায়)। ক্লেও পরিবারের কাজকর্ম করে অনেকটা অন্তরালে থেকেই। আবার ক্লেও দেখে তার চাকরিদাতার ফ্যামিলি ভেঙে পড়তেছে। অন্যদিকে তার নতুন বয়ফ্রেন্ড ফারমিন-এর সঙ্গে কয়েকটা ডেট করার পরে এক পর্যায়ে ক্লেও আবিষ্কার করে সে প্রেগনেন্ট। অন্যদিকে ফারমিনকে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া এমনকি ক্লেওর সঙ্গে একসাথে থাকতেও ফারমিনের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে ক্লেও তার চাকরীদাতা লোকটাকে জানানোর চাপও বোধ করে। মেহিকোর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের উত্তাল এক সময় ক্লেওর ব্যক্তিগত জীবনে এইসব ঘটনা ঘটে। এবং সময় সময় সেই সংঘাতের উত্তাপ এসে পড়ে ক্লেও ও তার চাকরিদাতার জীবনে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপর নির্বিচার সরকারি আক্রমণ চলে। কুয়ারোনের টেকনিক হচ্ছে  রাজনৈতিক গন্ডোগোল নিম্নবিত্ত এক নারীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন মামুলি ঘটনাবলির পটভূমিকায় হাজির হয়।  

একই সঙ্গে হিউমার ও হররের মিশেল সিনেমায় পাওয়া যাবে কারণ এটা আলফোনসো কুয়োরানের সিনেমা। আপনি ই তু মামা তামবিয়েন (Y tu mamá tambien) দেখে থাকলে আলফোনসের কমেডিক টাইমিং কতটা দুর্দান্ত তা জানার কথা! রোমা সিরিয়াস ও স্যাড সিনেমা কিন্তু অতর্কিতে ও চোরাগোপ্তা হিউমার এখানেও দেখা যায়।  

রোমা এমন এক সিনেমা যা ভাবাবে, কিছু দৃশ্য আপনার মাথায় দীর্ঘদিনের জন্য গেঁথে থাকবে। ফাস্ট এন ফিউরিয়াস ধরণের সুপার-ফাস্ট মুভির দর্শকদের কাছে মুভিটা কিছু স্লো ঠেকতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে একবার কিছুক্ষণ দেখলে, আপনাকে ধরে রাখার নানা ব্যবস্থা মুভিতে আছে। নানান সূক্ষ্ম সৌন্দর্য, ইনট্রিগ ও ভাবনাজাগানিয়া উপাদান রোমা-তে আছে। সেমসেম টিমের পরামর্শঃ গিভ ইট আ ট্রাই!    

৫. বাইসাইকেল থিভস (১৯৪৮) [ইতালি] 

দ্য বাইসাইকেল থিফ সিনেমার পোস্টার

সত্যজিৎ রায় কিংবা অনুরাগ কাশ্যপের মতো বিখ্যাত নির্মাতাদের প্রিয়তম মুভি।   গল্পের কেন্দ্রে বাবা আন্তোনিয়ো রিচ্চি ও আর ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর সম্পর্ক। আবার দারিদ্রের চক্র আর এক ব্যক্তি সেই দুষ্টচক্র এড়াতে কোন মাত্রায় যেতে পারে, কতটা বেপরোয়া হতে পারে– তার হৃদয়বিদারক গল্পও।   

আন্তোনিও যখন পুলিশের কাছে তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল সাইকেল চুরি যাওয়ার রিপোর্ট করে, মানুষ গা করে না। অথচ সেই একই কাজ (চুরি) যখন আন্তোনিও নিজে করে, পুরো শহর যেন তারে থামাইতে উঠে পড়ে লাগে, ছি ছি রি রি পড়ে যায়। ছোট ছেলে, ব্রুনো আতঙ্কিত। তার বাবাকে ঘিরে আছে ক্রুদ্ধ জনতার ভিড়। কারণ তার বাবা একটা বাইক চুরি করেছে। তাকে টেনে হিচড়ে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলে, সাইকেলের মালিক অশ্রুশিক্ত ব্রুনোকে দেখে আর্দ্র হয়ে পড়েন, মমতাবশত ব্রুনোর বাবাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। 

ব্রুনো বাবার হাত ধরে। পিতা যেমন পুত্রকে ক্ষমা করে দেয়, তেমনি এই সিনেমায় পুত্র পিতাকে ক্ষমা করে দেয়। বাপ-বেটায় ভিড়ের মধ্যে হারায় যায়। সুখি সমাপ্তি বলা যায়। এইরকম সহজ সরল এক কাহিনী। বলা যায় এই লিস্টের সবচেয়ে সহজ ও সিম্পল কাহিনী দ্য বাইসাইকেল থিফ-এর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিনেমাটা সাধারণভাবে দেখলে এক রকম অনুভুতি; অথচ  শুরু থেকে ব্রুনোর চোখে দেখলে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    


৪. প্ল্যাটফর্ম (২০২০) [স্পেন]

দ্য প্ল্যাটফর্ম সিনেমার পোস্টার

তিন ধরণের মানুষ আছে পৃথিবীতে: যারা থাকে উপরে, যারা নিচে থাকে আর যাদের পতন ঘটে।  

—ত্রিমাগাসি | প্ল্যাটফর্ম | ২০২০ 

বিশাল এক ভার্টিক্যাল জেলখানা। অবশ্য মালিক কোম্পানির ভাষ্যমতে, এটি জেলখানা না, ‘ভার্টিকেল সেলফ-ম্যানেজমেন্ট সেন্টার।’ তবে কয়েদিরা বলে ‘গভীর গর্ত’। প্রতিটি ফ্লোরে একটা করে ছোট রুমে থাকে দুইজন করে কয়েদি। প্রত্যেকটা রুমের মাঝখান বরাবর বিশাল এক আয়তাকার গর্ত, যা পুরা বিল্ডিং-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চলে গেছে। সেই গর্ত হয়ে উপরে থেকে লিফট টাইপ একটা প্ল্যাটফর্মে করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য নামে। সমস্ত কয়েদিদের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্যই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন যে উপরের লেভেলের কয়েদিরা প্রথমে খাওয়ার সুযোগ পায়। প্ল্যাটফর্মটা কয়েক মিনিট পর পর নিচের লেভেল নামে। তারপর পরের লেভেল, তাদের পরে আরও নিচের লেভেল, এইভাবে। সমস্যা হচ্ছে উপরের লেভেলগুলাতে যারা থাকে তারা প্রয়োজনের চাইতে বেশি খায় বা খাবার নষ্ট করে। ফলে নিচের লেভেল কয়েদিরা পায় না।  

নিচের দিকের লোকগুলা জীবন বাঁচাতে তখন কী কী করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? স্পয়লার দেবো না। 

তবে আপনার অনুমানকে আরও অনিশ্চিত করতে এই জেলখানার আরেকটা মজার বৈশিষ্ট্য বলি। প্রত্যেক মাসে কয়েদিদের সেল বদল হয়। যে এখন আছে, ৪৮ নাম্বার সেলে, একমাস পরে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে ২০২ কিংবা ৮  নাম্বার সেলে। প্ল্যাটফর্ম এক ডিস্টোপিয়ান মাস্টারপিস। 

৩. প্যারাসাইট (২০১৯) [দক্ষিণ কোরিয়া]

প্যারাসাইট সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার


অস্কার পাওয়া প্রথম দক্ষিণ কোরীয় সিনেমা  প্যারাসাইট। তবে কেবল পুরষ্কার দিয়ে  প্যারাসাইটকে বিচার করলে মুভিটার প্রতি অবিচারই করা হবে। 

শ্রেণিসমস্যা ও সমাজ কাঠামোর জটিলতা নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী একজন ফিল্মমেকার বং জুন-হো। প্যারাসাইটের আগের মুভিগুলাও যদি দেখেন, যেমন, স্নোপিয়ার্স, ওকজা বা হোস্ট, একই বিষয়বস্তু ভিন্ন চেহারায় মোকাবেলা করেছেন। প্যারাসাইটকেশ্রেণি বিভাজন ও মানব প্রকৃতি বিষয়ে তার অনুমানের নিখুঁত সিন্থেসিস বলা যায়।  প্যারাসাইট এক কথায় শ্রেণিসংগ্রামের সিনেমা। 

যেকোনো কোরিয়ান সিনেমায় কিম আর পার্ক নাম আপনি ঘুরেফিরে পাবেন– এই মুভিতেও যার ব্যত্যয় ঘটে নি!  
গল্প শুরু হয় কিম ফ্যামিলিকে ঘিরে। বেজমেন্ট ধরণের ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকা একটা পরিবার কোনো মতে টানাটানিতে যাদের সংসার চলে যায়। ফ্যামিলির প্রত্যেক সদস্য নানা ধরণের অড জব করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সবাই পার্ক ফ্যামিলিতে বিভিন্ন ধরণের কাজে নিযুক্ত হয়।  পার্ক ফ্যামিলি আবার কিম ফ্যামিলির ঠিক বিপরীত। বিলাসবহুল বিন্দাস জীবন কাটায়। বেশ বন্ধুসুলভ অথচ শীতল। পার্ক পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখা হয় যে কিম পরিবারের সদস্যরা পার্ক ফ্যামিলির কাছে গোপন রাখে। এক পর্যায়ে তারা পার্ক ফ্যামিলির দখল নেওয়া শুরু করে। দুই পরিবারের মধ্যে পরিষ্কার লড়াই হয়।   


কিম ফ্যামিলি আবিষ্কার করে তারা যা-ই করে না কেন, দুনিয়ায় তারা মিসফিটই থেকে যায়। এই দুনিয়া তাদেরকে ‘অপর’ই করে রাখে। সেই অপরায়নের প্রেক্ষিতে কিম ফ্যামিলির প্রতিক্রিয়ার নিষ্ঠুর কিন্তু দুর্দান্ত ইন্ট্রিগিং সিনেমা প্যারাসাইট। দর্শককে আবিষ্ট করে রাখা টানটান উত্তেজনার এক সিনেমা। ওহ, সম্ভব হলে বং জুন-হো’র মেমরিজ অভ মার্ডার মুভিটাও দেখুন।   

২. শপলিফটার্স (২০১৯) — [জাপান]

শপলিফটার্স সিনেমার পোস্টার

টোকিয়ো শহরের এক কোণে বাস করে দরিদ্র এক পরিবার। বেঁচে থাকার জন্য দোকান থেকে দোকানে চুরি করে বেড়ায়। পরিবারের মোটামুটি সবাই চোর। সে ফ্যামিলিতে এক ছোট মেয়ে ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে।  

শপলিফটার্স জটিল, সূক্ষ্ম ও রহস্যময় ফিল্ম। দারুণ চমকের এন্ডিং। সাইকোলজিকাল রহস্যকাহিনীর মতো টুইস্ট আছে। অথচ জন্রা বিবেচনায় ফিল্মটা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ক্লাসিকাল জাপানি স্টাইলের সূক্ষ্ম ফ্যামিলি ড্রামা,  কোরে-এদা যার একজন ওস্তাদ। আপনি যেন টেরই পাবেন না এমন মৃদু লয়ে এগোতে এগোতে, হুট করে চূড়ান্ত অংশে এসে হাজির হয় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। নিত্য অনটনের শপলিটার্সের ফ্যামিলির তেমন কিছু নাই, তারা বেঁচে থাকতেই হিমশিম খায় অথচ এরকম একটা মুভি দেখে চোখে পানি ধরে রাখা কঠিন। সত্যি বলতে, ডিসফাংশনাল ফ্যামিলির দর্শকদেরকে যা স্পর্শ করে তাই হইতেছে, তাদের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা, দ্বন্দ্ব সংঘাত সত্ত্বেও, প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি তাদের এক হয়ে থাকার চেষ্টা। এক কথায় জাপানিজ ফিল্ম মায়েস্ত্রো হিরুকাজু কোরে-এদা’র মাস্টারপিস।   

১. সুলিভান’স ট্রাভেলস (১৯৪১) [যুক্তরাষ্ট্র]   

সুলিভান’স ট্রাভেলস এর প্রথম অফিশিয়াল পোস্টার

সুলিভান’স ট্রাভেলস মুভি বিষয়ক মেটাকমেন্টারি যা একইসাথে স্ল্যাপস্টিক কমেডি। ত্রিশের দশকে মহামন্দার সময়ে শ্রমজীবী শ্রেণির সংগ্রাম উঠে আসলেও, মূলত একটা মধুর প্রেমের গল্প। প্রেস্টন এমন একটা মুভি বানাতে পেরেছেন যা তার বক্তব্য তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের আজকের পৃথিবীর সংগ্রামকেও যেন স্পর্শ করে। মজার বিষয় হচ্ছে, জ্ঞান দেওয়া মুলক মুভির বিরক্তিকর দিক সম্পর্কে জ্ঞান দেয় অথচ সিনেমাটি মজার। প্যারাডক্সের মতো ঠেকলেও শেষ পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ এমেরিকান মুভি।  


হলিউডের চিত্রনির্মাতা জন সুলিভান (জোয়েল ম্যাকক্রি) ‘সস্তা’ কমেডি বানিয়ে বিখ্যাত ও ধনী হয়েছে। তবে তার আফসোস নিপীড়িত মজলুম মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন ও মহামন্দা বিষয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। সিরিয়াস শৈল্পিক সিনেমা। সিনেমার নামও ঠিক করেনঃ ও ব্রাদার, হোয়্যার আর্ট দাউ?  


কিন্তু স্টুডিয়ো বস মনে করে, এটা বাজে চিন্তা এবং সুলিভানরে চ্যালেঞ্জ জানায়ে বলে যে সুলিভান আসলে গরিবের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু সুলিভান দমার পাত্র নয়। সে পকেটে মাত্র ১০ সেন্ট নিয়ে দেশ ঘুরে দেখের প্রজেক্ট নেয়, যাতে সে গরিবরা কিভাবে জীবন যাপন করে তা দেখতে পারে। যতবারই সে যাত্রা শুরু করে নানা দুর্ঘটনা তাকে লস এঞ্জেলসে ফেরত নিয়ে আসে। 

এরকমই একবার ফেরার সময়, একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় সুলিভানের। মেয়েটা ব্যর্থ অভিনেত্রী, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে হতাশ। এক পর্যায়ে সুলিভান ফাস করে যে এইরকম গরিবি পোশাক সত্ত্বেও সে একজন বিখ্যাত পরিচালক। এবং সুলিভান মেয়েটাকে তার জার্নিতে আমন্ত্রণ জানায়। মিসএডচেঞ্চার চলতে থাকে। শেষদিকে সুলিভান প্রকৃত যন্ত্রণা-দুর্দশা চাক্ষুষ ও উপলব্ধি করতে পারে যে সে এই অভিজ্ঞতার জন্য কতটা অপ্রস্তুত ছিলো! এইসব সত্ত্বেও স্টার্জেসের সিনেমায় কমেডির কোনো ঘাটতি থাকে না।  সুলিভান’স ট্রাভেলস যদি না দেখে থাকেন, অবশ্যই দেখে ফেলুন। বিশ্বসিনেমার অন্যতম সেরা ব্যালান্সড কমেডি। বাস্তবজীবন ঘনিষ্ঠ হয়েও হাস্যরসে ভরপুর। 

[ট্রিভিয়া: নির্মাতা প্রেস্টন স্টার্জেসকে ট্রিবিউট দিতে কোয়েন ব্রাদার্স তাদের বিখ্যাত ও ব্রাদার হোয়্যার আর্ট দাউ?  (২০০০) মুভিটা বানান।]   

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন