মানব সমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে: পুরনো বয়ানকে চ্যালেঞ্জ 

IMG-20240308-WA0035-01
অর্নি শওকত
john-gray profile pics
জন গ্রে
দার্শনিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

আমরা বর্তমানে আটকে আছি কোথায়? প্রয়াত ডেভিড গ্রেবার এবং তার সহ-লেখক ডেভিড ওয়েনগ্রোর মতে, একে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে ধরা যেতে পারে। ‘মানুষের বিস্তৃত সামাজিক অভিজ্ঞতা’ অর্জনের জন্য, আমরা মূলত উপভোগ করেছি ‘তিনটি আদিম স্বাধীনতা’: ‘চলবার স্বাধীনতা, অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি বা রূপান্তর করার স্বাধীনতা’। আজ আমরা যাকে অসমতা বা অরাজকতা হিসাবে বর্ণনা করবো, আদিম মানব সমাজের অস্তিত্ব কিন্তু এই অসমতা ছাড়া ছিল না, এমনকি তাদের আধিপত্যের জোরের অভাব ছিল যার মিল আমরা পাই শ্রেণিবদ্ধ সরকারের সাথে। বলা যেতে পারে মানবজাতি সবসময় একটি শান্তিপূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করত।     

তারপর কিছু ‘ভয়ংকর ভুল’ হলো।  

স্পষ্ট যে মানব সমাজে কিছু  পরিবর্তন সত্যিই ঘটেছে এবং তা ঘটেছে গভীরভাবেই। তিনটি মৌলিক স্বাধীনতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে, যেখানে আজ বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে কিভাবে মানবজাতি একটি সামাজিক ব্যবস্থার ভেতর বাস করতো। আসলে কিভাবে ঘটেছে? আমরা কিভাবে আটকে গেলাম? এবং ঠিক কিভাবে আমরা ভিন্ন এক পথে চলে এলাম?       

লেখকদের এই প্রশ্নগুলি কেবল তাদের পাণ্ডিত্যের প্রচেষ্টা থেকে এসেছে এমন নয়। গ্রেবার লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স (এলএসই) এর নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে, ওয়েনগ্রো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে, এমনকি একজন কর্মী হিসাবে গ্রেবারের ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকেও এই প্রশ্নগুলো এসেছে।  গ্রেবার ২০১১ সালের সেই কিশোর বয়স থেকেই একজন অরাজপন্থী (এনার্কিস্ট) গ্রেবার, ২০১১ সালের ওকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তার একাডেমিক কাজ এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত ছিল, যা তার কর্মজীবনে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারে। ১৯৬১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে একটি শ্রমিক ​​পরিবারে তার জন্ম। ফিলিপস একাডেমি অ্যান্ডোভারে পড়াশুনা শেষ করেন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল রিসার্স চালিয়ে যান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। ছাত্রদের কাছ থেকে শক্তিশালী সমর্থন এবং তার কর্মক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাকে মেয়াদের জন্য আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য একাডেমিক অবস্থান খুঁজে পেতে তিনি অক্ষম হয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতটা বিবাদী মনের ছিল না। ২০০৮ সালে তিনি লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে এলএসই’র অধ্যাপক হন।      

দুই ডেভিড: গ্রেবার ও ওয়েংগ্রো। ফটো ক্রেডিট: কল্পেশ লাথিগ্রা

একাডেমিতে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐক্যমত্য এবং তার ফলস্বরূপ যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে বলে বিশ্বাস — গ্রেবারের কাজ উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করে।  ২০০৪ সালে তিনি ফ্র্যাগমেন্টস অভ এ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপলজি নামে  ছোট একটি বই প্রকাশ করেন। একে বলা যেতে পারে ওয়েনগ্রোর সাথে দশ বছর ধরে সহলেখক হিসেবে লিখিত আরও পদ্ধতিগত গবেষণার বই ডন অভ এভ্রিথিং– এর একটি মুখবন্ধ। অন্যান্য বইয়ের  মধ্যে রয়েছে ডিরেক্ট অ্যাকশন: অ্যান এথনোগ্রাফি (২০০৯), ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ডেট: ফার্স্ট ৫০০০ ইয়ার্স  (২০১১) এবং বুলশিট জবস: এ থিওরি (২০১৮)। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেক্রোটিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে আকস্মিকভাবে গ্রেবার মারা যান। তার অকাল প্রয়াণ আমাদেরকে একজন প্রতিভাধর এবং মৌলিক চিন্তাবিদ থেকে বঞ্চিত করেছে।          

লেখকদের মতে, ১৮ শতকের জেনেভান দার্শনিক জ্য জাক রুশোর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ডন অফ এভরিথিং-এর বেশিরভাগ অংশই পড়া যেতে পারে, যার ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অ্যান্ড দ্য ফাউন্ডেশন অফ ইনইকুয়ালিটি অভ হিউম্যানিটি। তাদের বিশ্বাস যে ১৭৫৫ সালে রচিত রুশোর এই তত্ত্ব  সমাজ-তাত্ত্বিকদের বিভ্রান্ত করেছে। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ থমাস হবস, বিখ্যাত বই লেভিয়াথান (১৬৫১)-এ  ঘোষণা করেছিলেন যে ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ জীবন ছিল ‘নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত’। হবস ও রুশো উভয়ের মতকেই তারা বিশেষ আপত্তিকর বলে মনে করে।  হবস এবং রুশো একমত হয়ে যান। তাদের মতে দমনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে পরবর্তীরা বিদ্রোহ করেছিল যা হবসের মতে সভ্য জীবনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর মতে, নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে হবস এবং রুশো উভয়ের তত্ত্বই প্রত্যাখ্যান করা উচিত কারণ তারা প্রাথমিক মানব ইতিহাসের যে বিবরণ দিয়েছে তা কেবল সত্য নয়, তার ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এবং অতীতকে করে নিস্তেজ।    

তত্ত্বগুলি মারাত্মক অকেজো হওয়ার কারণে হবস এবং রুশোর তত্ত্বগুলি নিয়ে লেখকদের নিন্দা বেশ লক্ষ্য করার মতো। যদি তাদের ভুল প্রমাণ করা যায়, তাহলে এই বিষয়টির এখানেই শেষ হওয়া উচিত কেননা মানব ইতিহাস সম্পর্কে আসল সত্য অনুপ্রেরণামূলক, বা উত্তেজনাপূর্ণ হবার প্রয়োজন নেই। সত্য সর্বদা চিরন্তন।  এটিকে অনুসরণ করা হলে তখন  তা সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করে।   

হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, লেখকের মানবতার নতুন ইতিহাস রুশোর সামাজিক বৈষম্যের অরিজিনের গল্পের মতো শোনাচ্ছে, যা এমন অনেকের দ্বারা গৃহীত হয়েছে যারা তার লেখার একটি শব্দও পড়েননি। রুশোর বিবরণে, মানুষ তাদের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে শিকারী-সংগ্রাহকদের ছোট সমতাবাদী দলে বসবাস করেছিল। তারপর তারা কৃষক হয়ে ওঠে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, শহরগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অসমতা এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের সাথে সাথে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। 


গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো রুশোর বয়ানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেন। মানুষ তাদের বিবর্তনের বেশিরভাগ সময় ছোট ছোট দলে বসবাস করেনি;  সামাজিক বিবর্তনে কৃষি একটি পরিবর্তনীয় পর্যায় ছিল; এবং আদি শহরগুলি কখনও কখনও দৃঢ়ভাবে সমতাবাদী ছিল।  তখন আদি মানুষেরা সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। রুশোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা যেতে পারে, সমাজের তখন কোন ‘প্রকৃত রূপ’ ছিল না।  

১৮ শতকের দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষ যত বেশি সভ্য হয়ে উঠছে তারা তাদের নিজস্ব প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ হারিয়েছে এবং একে অপরকে অনুকরণ করতে শুরু করেছে। রুশোর জন্য, এটি ছিল মানুষের আদিপাপ – যে ত্রুটি থেকে সমাজের সমস্ত ত্রুটিগুলি সৃষ্টি হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, হবসের মতে, মানুষ প্রথমে একটি প্রাক-সামাজিক অবস্থায় বাস করেছিল। তারপর তারা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল যা ইতিহাস তৈরি করেছে।  অন্যদিকে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর বিশ্বাস প্রকৃতির এমন প্রাক-সামাজিক অবস্থা কখনও ছিলই না কেননা মানুষ মূলত সামাজিক জীব। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, লেখকরা যাকে তাদের আদিম স্বাধীনতা বলে মনে করেন তারা কেন তা ত্যাগ করলেন?     

প্রাচীন মিশর থেকে নিকটবর্তী প্রাচ্য, ভারত এবং চীন পর্যন্ত একটি সমীক্ষায় গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো দেখান যেখানে তারা বিশেষত আমেরিকার আদিবাসীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। এই নিবন্ধনে সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি বিশাল বৈচিত্র্য ছিল। বছরের সময়ের উপর নির্ভর করে কিছু গোষ্ঠীতে শাসনের বিভিন্ন রূপ ছিল—গোষ্ঠীগুলো  শিকারের মৌসুমে আরও দৃঢ়ভাবে সংগঠিত থাকতো। অন্যথায় তারা থাকতো অত্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত। তাদের ভেতর কেউ কেউ দাস রাখতো, কেউ রাখতো না। চোরাচালানকারীরা তখন হয়তো ছোট দলে সংগটিত হতো কিন্তু তাদের ছিল দূরবর্তী নেটওয়ার্ক। সে সময়ে অনেক ধরণের প্রাচীন সমাজ ছিল, মানুষের প্রয়োজন এবং পরিস্থিতির সাথে সাথে তা পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের সবকটিতেই রাষ্ট্রের স্থায়ী শ্রেণিবিন্যাস ছিল না।       

   

এই পর্যায়ে এসে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর সভ্যতার নতুন ইতিহাস নিয়ে হওয়া বিড়ম্বনার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও তাদের যুক্তি এমন যে রুশোর আদিম সমাজের ধারাবাহিক বিবরণ ভুল ছিল। রুশোর বয়ান প্রত্যাখ্যান করার পরে, তাদের এখন নিজেদের একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন যা দিয়ে তারা মানবতার দাসত্বের হদিস ব্যাখ্যা করবেন কিন্তু এটি পাওয়া যায় না। সাহসী এবং চিন্তায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই বইটির শেষের কয়েক পৃষ্ঠা আগেও তাদের প্রশ্ন : ‘রাষ্ট্রহীন সমাজগুলি যদি নিয়মিতভাবে নিজেদেরকে এমনভাবে সংগঠিত করে যে রাষ্ট্র প্রধানদের কোন জবরদস্তি করবার ক্ষমতা থাকে না, তবে তখন সমাজে বা রাষ্ট্রে কী হতে পারে?’       

দ্য ডন অফ এভ্রিথিং বইয়ের প্রচ্ছদ

   

ইতিহাস সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্তসারের বিষয়টি তাদের কাছে রুশোর বয়ানের চেয়ে ‘আরও দুঃখজনক’ বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানবসমাজ আসলে কেমন তা নিয়ে আমরা আমূল ভিন্ন ধারণার অধীনে আমরা বসবাস করতে পারতাম। অর্থাৎ গণদাসত্ব, গণহত্যা, কারাগার, এমনকি পিতৃতন্ত্র বা মজুরি শ্রমের শোষণ কখনও ঘটবার ছিলো না। আবার অন্যদিকে, এখনও যে মানুষের ইতিবাচক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি—সে ইশারাও দেয়।    

অন্যভাবে বললে, যেকোনো বিবেচনায় প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে বড়সড় একটি ভুল ছিল। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই অরাজপন্থী, কিন্তু গত কয়েক হাজার বছর ধরে অধিকাংশ মানুষই দাসত্বের মধ্যে বসবাস করছে। ২১ শতকের সামাজিক আন্দোলনে, আমরা মানবজাতি সবচেয়ে মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃআবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এসেছি যা ‘সামাজিক বাস্তবতার নতুন এবং বিভিন্ন রূপ তৈরি করার স্বাধীনতা’ হিসেবে জায়গা পেয়েছিল। লেখকদের মতে, ‘আমাদের সংশোধনবাদী ইতিহাসের অনিবার্য প্রভাব এই সামাজিক আন্দোলন।’          


লেখকদ্বয় আমাদেরকে জানান, আদিম স্বাধীনতাকে যে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে, বিশেষভাবে তারা, যারা আনুগত্যের জন্য প্রশিক্ষিত নয় (যেমন এই বইটি পড়ার জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই ছিল)। এখানে তারা পৃষ্ঠপোষকতামূলক ঘৃণার সাথে পৃথিবীর নিপীড়িত ও হতভাগাদের মুক্তি দেবার প্রস্তাব করেন যা উগ্র তাত্ত্বিকদের বৈশিষ্ট্য। মানবজাতির জনসাধারণ, যাইহোক, হুইপেট নয়: তারা বোঝে, আদর্শগত স্বপ্নদর্শীদের চেয়ে, বিরোধপূর্ণ চাহিদাগুলি যে জটিল এবং প্রায়শই পরস্পর-বিরোধী বিশ্বে তারা বাস করে সেখানে স্বাধীনতাকে রূপ দেয়।  

নতুন এই ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রুশোর অসমতার ইতিহাসের মতোই, এর বেশিরভাগই অত্যন্ত অনুমানমূলক। লেখকরা এটি স্বীকার করেছেন: ‘অধিকাংশ মানববেতিহাস আমাদের কাছে অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে। আমাদের প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স, অন্তত ২০০০০০ বছর ধরে বিদ্যমান ছিল, কিন্তু সেই সময়ের বেশিরভাগ সময় কি ঘটছে তা আমরা জানি না।’  কিন্তু ইতিহাসে যদি এত খালি পাতা থাকে, তাহলে তারা কীভাবে নিশ্চিত হবে যে মানুষ সহজাতভাবেই অরাজপন্থী? পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায় হবস-সুলভ চিন্তার আবির্ভাবকেও তারা প্রমাণ হিসেবে উপেক্ষা করেন।   


তাদের বই পড়লে আপনার মনে হবে হবসীয় চিন্তাভাবনা ছিল পশ্চিমা মননের অদ্ভুত এক বিকৃতি। অথচ চীনা আইনবিদ হান ফেই প্রায় ২ হাজার বছর আগে একই ধরণের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন এবং একই সময়ে ভারতীয় লেখক কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র বইয়ে রাজনৈতিক বাস্তববাদের একটি সাদৃশ্যপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। এই লেখাগুলি ইশারা দেয় যে হবস যে রাজনৈতিক বিষয়গুলি মোকাবেলা করেছিলেন – মানবপ্রকৃতি, স্বাধীনতা, যুদ্ধ, নিরাপত্তা, ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র – তা ‘মালিকানামূলক ব্যক্তিবাদ’ (‘পজেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিজম’) দিয়ে জর্জরিত প্রাথমিক আধুনিক পশ্চিমা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, যেমনটি মার্কসবাদী স্কলার সি বি ম্যাকফারসন এক সময়ের প্রভাবশালী রচনায় দাবি করেছিলেন। ১৯৬২ সালের এই গবেষণাকর্ম  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো উৎসাহের সঙ্গে উদ্ধৃত করেন।    

রুশোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা যেতে পারে, সমাজের তখন কোন ‘প্রকৃত রূপ’ ছিল না
অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

হবস বিশ্বাস করতেন যে মানুষ ‘ক্ষমতার পরে ক্ষমতার জন্য অস্থির  ও অনন্ত এক আকাঙ্ক্ষার দ্বারা আবিষ্ট হয় যা শুধুমাত্র মৃত্যুতে থেমে যায়’। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা সম্পত্তি জমা করার প্ররোচনা দ্বারা চালিত হয় না, যেমন গ্রেবার এবং ওয়েংরো দাবি করেন, বা প্রধানত অহংবোধ দ্বারা চালিত হয়, যেমন হবস নিজেই কখনও কখনও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা যে প্ররোচনা দ্বারাই চালিত হোক না কেন – হিংসাত্মক মৃত্যুর বিপদ, জীবনযাত্রার একটি উপায় সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বা প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন – মানুষ অন্য মানুষের থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশ নেয়। আগ্রাসী লোভ নয়, ভয়ই প্রকৃত হবসীয় আবেগ।       

এই হবসিয়ান আবশ্যিকতা ‘রাষ্ট্র-ছাড়া-সমাজ’ গঠনের আধুনিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প অরাজপন্থার (এনার্কিজম) চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। খুব কমই নির্ভরযোগ্যভাবে অকার্যকর। অরাজপন্থীদের সবচেয়ে মারাত্মক শত্রুরাও অত্যাচারী নয় যাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিল। যদি বিপ্লবগুলি প্রায়শই এমন শাসনের পরিণতি ঘটায় যেগুলি উৎখাত হওয়া শাসনের চেয়ে বেশি দমনমূলক, তবে একটি বড় কারণ হল ক্ষমতার জন্য বাধাহীন লড়াই যা সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্লবী আন্দোলনগুলির মধ্যে ঘটেছিল।

অরাজপন্থী আন্দোলনগুলি ২০ শতকে মাত্র দুই বার বড় আকারের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিলুপ্ত হয়েছিল। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে, রাশিয়ার অরাজপন্থী  কৃষ্ণাঙ্গ বাহিনী নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং বলশেভিকরা প্রতি-বিপ্লবী শ্বেতাঙ্গদের দমনে রেড আর্মিকে সাহায্য করার পর তাদের কমান্ডারদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে, অরাজপন্থী মিলিশিয়ারা প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারপর সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত সামরিক ইউনিট দ্বারা শোষিত হয়। রাষ্ট্রহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা নিয়মিতভাবে পরাজিত হয়েছে উন্নততর সংগঠিত এবং আরও নির্মম বিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্রের মতো কাজ ক’রে। 

রাষ্ট্রহীন একটি অঞ্চল সৃষ্টি হলে, তখন রাষ্ট্রটির টিকে থাকা তার চারপাশের রাজ্যগুলির উপর নির্ভর করে। উত্তর সিরিয়ার কুর্দি রোজাভা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ঘটনা এমন। ২০১৪ সালে গ্রেবার এই অঞ্চলটি ঘুরে এসেছিলেন। অঞ্চলটিকে তিনি অরাজপন্থার একটি প্র্যাক্টিকেল এক্সপেরিমেন্ট বলে দাবি করেছিলেন। (এই অঞ্চলটির কারারুদ্ধ নেতা আবদুল্লাহ ওকালান আমেরিকান তাত্ত্বিক মারে বুকচিনের (1921-2006) ‘অনটন-উত্তর অরাজপন্থা’-এর
প্রভাবকে স্বীকার করেছেন। ফলে গ্রেবারের মতের কিছু ভিত্তি রয়েছে।) রোজাভার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ার বাশার আল- আসাদ ও কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের উপর। এই অঞ্চলের এখনও বাশারের বাহিনী ও  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। বুকচিনের অরাজপন্থায়  পরিবেশগত চাহিদার থাকা সত্ত্বেও,  করুণ ব্যাপার হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি হল এই অঞ্চলের প্রধান সম্পদ।                     

রোজাভা এক্সপেরিমেন্ট কীভাবে শেষ হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তেলক্ষেত্র নিয়ে কোনো দ্বন্দ্বে, রোজাভাকেও অপরাপর রাষ্ট্রের মতো, এই অঞ্চলের অন্যদের সাথে জোট গঠন করে, প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, অন্যথায় এটি অদৃশ্য হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, রোজাভা অনিবার্য ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধরত রাষ্ট্রের বিশ্বে শান্তিপূর্ণ অরাজপন্থার (নৈরাজ্যের) কোনো জায়গা নেই।      

খুব সম্ভব, আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকায়, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট দ্বারা তৈরি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ব্যর্থ হয়নি বরং কেবল বিবর্ণ হয়েছে। আমেরিকান শহরগুলিতে সম্প্রতি যে অঞ্চলগুলি আবির্ভূত হয়েছে সেগুলি একটি ভিন্ন গতিপথ অনুসরণ করে। তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া, এবং এই লক্ষ্য অন্তত আংশিকভাবে অর্জনযোগ্য। বাস্তবে, এটি রাষ্ট্রকে বেসরকারিকরনের নব্য উদারনৈতিক কর্মসূচিরই এক ধরণের  সম্প্রসারণ। পুলিশ বাহিনী হারিয়ে যায় না, ক্ষমতাবানদের সেবায় নিয়োজিত সিকিউরিটি কোম্পানিতে পরিণত হয়। বাকিরা পড়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব  নিজেরাই নিয়ে আর সংগঠিত অপরাধচক্র ও গ্যাং শাসনের মানিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে যা যা করতে হয় করে। 

মাঝেমধ্যেই গ্রেবার এবং ওয়েংগ্রো সাম্প্রতিক ইতিহাসের নব্য-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি চলে আসেন। তারা স্পষ্ট অনুমোদনের সাথে খেয়াল করেন যে এখন দুনিয়াজুড়ে আমলাতন্ত্র রয়েছে (সরকারি এবং ব্যক্তিগত, IMF এবং WTO থেকে JP Morgan Chase এবং বিভিন্ন ক্রেডিট-রেটিং সংস্থা)… ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি পর্যন্ত সবকিছুই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছে।       

কিন্তু ইতিহাস চলছে উল্টো পথে। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলি আঞ্চলিক সীমানা পুনঃস্থাপন করছে, সাপ্লাই চেইনের নিরাপত্তার স্বার্থে বৈশ্বিক বাণিজ্য  ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রবণতাগুলি মহামারী দ্বারা ত্বরান্বিত হতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বৃদ্ধি ২০০৭-৮ এ ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন সরকারগুলি বিশ্বব্যাপী আর্থিক পতন রোধ করতে বিশ্ব অর্থনীতিকে সহায়তা করেছিলো। 

গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো নব্য উদারপন্থীদের সাথে কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি চিহ্নিত শত্রুতা ভাগ করে নেন। যেটিকে তারা শ্রমজীবী ​​শ্রেণীর আত্ম-উন্নয়নকে ক্ষুণ্ন করে দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেন। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলি সাধারণ মানুষের জন্য যে সুবিধাসমূহ নিয়ে এসেছিল তারা লক্ষ্য করতে ভুলে যান।  উদাহরণস্বরূপ, অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য দাতব্য এবং বীমার প্যাচওয়ার্কের উপর নির্ভর করা থেকে স্বাধীনতা। মানুষের স্বাধীনতা জটিল বিষয়। এনএইচএস  বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত তৎকালীন শক্তিশালী ব্রিটিশ রাষ্ট্র থেকে, এনএইচএস আবির্ভূত হয়েছিল। অনেক মন্দ রাষ্ট্রের সাথে করে এসেছে, তবে কিছু অত্যাবশ্যকীয় ভালো দিকও রয়েছে। অদ্ভুত লাগলেও সত্যি হচ্ছে এই কারণেই মানুষ রাষ্ট্রের দ্বারা শাসিত হতে ইচ্ছুক।        

লেখকরা অতীত এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন অস্বস্তিকর, দোকানে বিক্রিত মতামত এবং রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর মিথের নিন্দা করেছেন। তারা মনে করেন যে প্রাথমিক মানবসমাজগুলি সাধারণভাবে অনুমিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং কখনও কখনও পরীক্ষামূলক ছিল। তবুও গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো যা করেছেন তা হল রুশো এবং তার অনেক অজান্তে শিষ্যদের দ্বারা প্রচারিত একটি পরিচিত মিথকে পুনরায় সাজানো: এই বিশ্বাস যে মানবজাতি তার ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ‘আটকে’ আছে। স্বাধীনতা এবং মৈত্রীর একটি আসল শর্ত কখনও বিদ্যমান ছিল বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। আমরা সবসময় যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, আমাদের অসুবিধাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি আর কোনো না কোনোভাবে তা কাটিয়ে উঠছি।

[ নিউ স্টেটসম্যান– এ প্রকাশিত লেখাটি সেমসেম-এর জন্য ভাষান্তর করেছেন অর্নি শওকত]       

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন