পুরুষ নজর, নারী নজর: দেখাদেখির রাজনীতি

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

দর্শকরা কীভাবে ভিজুয়াল মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত হয়? তারা কীভাবে ‘দেখে’?

দেখাদেখির বা নজরের রাজনীতি নিয়ে বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকেই তাত্ত্বিকরা ভাবছেন। পুঁজির দুনিয়া সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষকেও কিভাবে কমোডিফায়েড করে তা নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ব্যাপক আকারে তাত্ত্বিক রচনা প্রকাশ করে। পঞ্চাশের দশকে রোলা বার্থ তার ‘মিথলজিস’ এর  চিহ্নগত রাজনীতি থেকে নব্বইয়ের দশকের বদ্রিয়ার ‘সিমুলাক্রা এন্ড সিমুলেশন’ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও দার্শনিকেরা কাজ করেছেন। এই পরম্পরার অংশ হিসেবে দৃশ্য মাধ্যমে চিহ্নের লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেছেন নারীবাদী তাত্ত্বিকরা। 

মেইল গেইজ বা পুরুষালি নজরকে এই চিহ্নবিদ্যার নারীবাদী ভাবনার সম্প্রসারণ।  গেইজ বা নজর দেখাদেখির রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ফিল্ম থিয়োরি ও সমালোচনা থেকে জন্ম নেয়া শব্দটি দিয়ে বুঝানো হয় আমরা কীভাবে এই ভিজুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনকে দেখি, বুঝি। বিজ্ঞাপন, টিভি প্রোগ্রাম ও সিনেমা এর মধ্যে পড়ে। চিত্র সমালোচকরা gaze বা নজর  নিয়ে কথা বলার সময় প্রায়ই male gaze বা পুরুষ নজর-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু পুরুষ নজর বলতে আসলেই কী বুঝায়? আর শব্দটির নারী সমতুল কিছু আছে কি?               

‘মেইল গেইজ’ কথাটা কোথা থেকে এলো?   

ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিয়োরির একটি আইডিয়া হলো এই পুরুষ নজর (male gaze)। পুরুষ নজরের ধারনা স্কলার এবং সিনেমানির্মাতা লরা মালভি তার ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয় প্রবন্ধের বই Visual Pleasure and Narrative Cinema তে হাজির করেন।     

পুরুষ নজর দেখার যৌনরাজনীতি তুলে ধরে। যৌনাত্মক নজরে দেখতে উৎসাহিত করে। পুরুষের  ক্ষমতায়ন করে এবং নারীদেরকে অবজেক্টিফাই করে। এই পুরুষ নজরে দৃশ্য মাধ্যমে নারীকে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর মত করে উপস্থাপন করা হয়। এখানে নারীর অনুভুতি, ভাবনা ও তার নিজের বাসনা পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হিসেবে ‘ফ্রেমবন্দি’ হওয়ার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়।      

মনোবিশ্লেষণের ভাষা ব্যবহার করে মালভি বলেন, বস্তাপঁচা হলিউডি ফিল্মগুলো গভীরে প্রোথিত তাড়না – স্কোপোফিলিয়া বা দেখার মাধ্যমে পাওয়া যৌনানন্দকে কাজে লাগায়। মালভির মতে, জনপ্রিয়তম সিনেমাগুলো পুরুষালি যৌনাকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করতে ধারণ করা হয়। মালভির ধারণাটিকে male gaze বলে মাঝেমধ্যে বর্ণনা করা হলেও, একে আরও নিখুঁতভাবে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ নজর বলা যায়। দৃশ্য মাধ্যম পুরুষ দর্শকদের জন্য নারীকে যৌনায়িত করে পুরুষালি ভয়ারিজম (Voyeurism) ছড়ায়। মালভির মতে, সিনেমায় নারীরা তাদের ‘to-be-looked-at-ness’ বৈশিষ্ট্য দিয়ে পরিচিত; যেন নারী হচ্ছে কেবল দর্শনীয় মনোরম দৃশ্য আর পুরুষ সেই দৃশ্যের দর্শক।       

দ্য পোস্টম্যান অলয়েজ রিংজ টুয়াইস  (১৯৪৬) সিনেমা পুরুষ নজরের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ। চলচ্চিত্রটির মূল নারী চরিত্র কোরা স্মিথের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ক্লোজআপ শট ব্যবহার করে ক্যামেরা দর্শকদের কোরার দেহের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। এভাবে সেক্সুয়াল, ভয়ারিস্টিক এবং পুরুষ চরিত্রের নজর ভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত দেখার একটা মাধ্যম তৈরি করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নায়কের কোরারযে  প্রতি আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা আছে তা কোরা বোঝে কিন্তু শক্তিশালি মেসেজটি হলো কোরা যৌন আবেদনময়ী। দর্শকরা কোরার নাম জানার আগেই জেনে যায় যে কোরা সেক্সি। এমনকি একজন দর্শক যদি বাস্তব জীবনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব নাও করেন তারপরেও দৃশ্যটি বোঝা যায়। সারাজীবন ধরে টিভি, মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন এসবে নারীদেরকে যৌনাবেদনময়ী হিসেবে দেখা আমাদেরকে পুরুষ নজর বা মেল গেজ এর সাথে অভ্যস্ত করে ফেলেছে।         

পুরুষ নজর-এর সন্ধানে 
পুরুষ নজর-এর  অনেক ধরণ আছে কিন্তু একে চেনা যায় এমন পরিস্থিতিতে যেখানে নারী চরিত্ররা নিয়ন্ত্রিত হয় নায়কের দৃষ্টিভঙ্গি ও বাসনা দিয়ে। আর বেশিরভাগ সময়ই তারা নায়কের প্রতিনিধিত্ব করে। বাড বয়েত্তিচা ১৯৫০ এর দশকে কিছু ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন মুভি নির্মাণ করেন। তার মতে, ‘নায়িকা যেটির প্রতিনিধিত্ব করবেন তার থেকে তিনি কী বোঝাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই একমাত্র, ভালোবাসা বা ভয় অথবা দুশ্চিন্তা সে নায়কের মধ্যে সঞ্চালিত করে, নায়ক যেমন আচরণ করছেন তার কারণেই নায়ক এমন। নায়িকার নিজের মধ্যে তার ন্যূনতম গুরুত্ব নেই।’  
  

ক্যামেরা বারবার যেভাবে নারীর শরীরে তাক করে আমাদের দেখাতে চায় এটা বিভিন্নভাবে দেখা যায়। রিয়ার উইন্ডো (১৯৫৪)
এ নারীর শরীরের আক্ষরিক অর্থেই গঠন বা কাঠামোর জন্য কিংবা শি’জ অল দ্যাট (১৯৯৯)- এ নারী পুরোপুরি রুপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। আরো পরের নমুনা হিসেবে, ট্রান্সফর্মার (২০০৬-২০১৪) ফিল্ম সিরিজে নারীদের যৌনআবেদনময়ী,  আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।    


ইদানিং অবশ্য অনেক ফিল্ম নির্মাতা প্রায়ই নারী চরিত্রগুলাকে তাদের জটিল ব্যাকস্টোরি, দৃঢ় ইচ্ছা ও সক্রিয় ভূমিকা বাদ দিয়ে তাদেরকে ‘নিছক’ যৌন আবেদনময়ী বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার বিষয়টি এড়াতে চেষ্টা করেন। এরপরও পুরুষালি  নজর (masculine gaze) অনেক স্বাভাবিক। দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস (২০১২) -এ  ক্যাটওমেন এর ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন আছে। এরপরও তাকে এমনভাবে উপস্থাপণ করা হয়েছে যেন তাকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা লাগে।         

তাকানোর বিভিন্ন ধরন  
চল্লিশ বছর আগে রচিত মালভির প্রবন্ধ এখনও জোড়ালো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই সিনেমায় অবজেক্টিফাই করা হয়—একটা সাধারণ উত্তর। গিল্ডা (১৯৪৬) সিনেমায় জনি ফ্যারেল (গ্লেন ফোর্ড) কি গিল্ডা মান্ডসনের (রিটা হেইওয়ার্থ) মতই সেক্সি নয়?  বিবিসি টেলিসিরিজের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস (১৯৯৫)-এর  ফিটজ উইলিয়াম ডার্সি এলিজাবেথ বেনেটের মতই সুন্দর নয় কি? নিঃসন্দেহে এসব হেটারোসেক্সুয়াল নারী নজরের উপস্থিতির জানান দেয়।  

এ ধরণের আলোচনা নারীদের ক্রমাগতভাবে সেক্সুয়াল অবজেক্টের মত দেখানোকে বিবেচনা করে না। দ্য হকেয়ি ইনিশিয়েটিভ (The Hawkeye Initiative) প্রজেক্টটি কমিকস ও চলচ্চিত্রে পুরুষ এবং নারী সুপারহিরোদের ভিন্নভাবে   উপস্থাপনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিচের ইলাস্ট্রেশনটিতে এভেঞ্জার্স  (The Avengers)-এর  পুরুষ হিরোদের ফিল্মটির একমাত্র নারী চরিত্র ব্ল্যাক উইডোর মত করেই হাইপার-সেক্সুয়ালাইজডভাবে দেখিয়েছে।       

হকাই ইনিশিয়েটিভ এর চোখে পুরুষ নজর এভেঞ্জারের ওপর প্রয়োগ করলে যেমন দেখাতো


ইলাস্ট্রেশনটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে তুলে ধরে। কিন্তু মজাটা আসে পুরুষদের নারীদের মতো যৌনায়িত নজরে দেখায় অনভ্যস্ততা থেকে। আরেকটা আলোচনা হল, সিনেমায় নারীদের পুরুষদেহ আকাঙ্ক্ষা করতে উৎসাহিত করে না বরং নারী দর্শকদের পুরুষ আকাঙ্ক্ষিত নায়িকার সাথে আইডেন্টিফাই করতে বাধ্য করা হয়। এই যুক্তি অনুযায়ী ফিটজউইলিয়াম ডার্সির ভেজা আন্ডারশার্ট নয়, বরং এলিজাবেথের প্রতি ডার্সির তীব্র আকাঙ্ক্ষাই নারী দর্শকদের প্রকৃতভাবে আকর্ষণ করে।   

নারী নজর  (female gaze) বলে কিছু আছে কি?   

অনেক সিনেমা নারীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে non gaze উপায়সমূহের মাধ্যমে। জেন ক্যাম্পিয়নের দ্যি পিয়ানো (১৯৯৩) সিনেমায় নায়িকার তীব্র সেন্টিমেন্টাল প্রকৃতি জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। সোফিয়া কপ্পোলার দ্য ভার্জিন সুইসাইডস (১৯৯৯) সিনেমায় টিনেজ চরিত্রদের জীবন তুলে আনার মাধ্যমে নারীদের অভিজ্ঞতা শব্দ এবং ভিজুয়াল এস্থেটিক্সের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল প্রকাশে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে উষ্ণ টোন (হলুদ, স্যামন), ‘মেয়েলি’ প্রতীক (ফুল, ইউনিকর্ন) এবং গান ব্যবহার করা হয়েছে। কপ্পোলা একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেন ম্যারি অ্যানটোয়েনেট (২০০৬) সিনেমাতেও। তিনি ফ্লোরিড সেট ডিজাইনের মাধ্যমে ভার্সাই শহরে নারীদের আবদ্ধ, দমবন্ধ জীবন দেখিয়েছেন।    

নারীদের আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে ভালো প্রকাশ হয় নজর বা gaze এর পরিবর্তে অনুভূতির মাধ্যমে। এই বয়ান বলে, গতানুগতিক পুরুষালি আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমূলক, অন্যদিকে নারীরা অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু পুরুষের অভ্যন্তরীন জীবন সবসময়ই শব্দ এবং অনুভবের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। যেমন, র‍্যাম্বো (২০০৮) অথবা ক্যাসিনো রয়্যাল (২০০৬) পুরুষের যন্ত্রণা ও আগ্রাসন দিয়ে ভরপুর করে রেখেছে অনুভূতি।           
নারী নজর  (female gaze) কি আছে তাহলে?
অবশ্যই আছে। সিনেমায়  সুদর্শন পুরুষের আধিক্য আছে। কিন্তু নারীদের সমান পুরুষ নজর স্পষ্টত নেই। পুরুষ নজর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। পুরুষ নজর পুরুষতান্ত্রিক স্ট্যাটাস-কো কে সমর্থন করে নারীদের বাস্তব জীবনে যৌনবস্তুকরণকে স্থায়ী করে।  


এ কারণে, নারী নজর, পুরুষ নজর-এর মত হতে পারেনা। বরং নারীদের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে বানানো চলচ্চিত্রগুলো বিধ্বংসী। ফিশ ট্যাংক (২০০৯) চলচ্চিত্রটি সুবিধাবঞ্চিত একজন মেয়ের দুর্বলতা নিয়ে, তার সাবালক হয়ে ওঠার গল্প। ইন দ্য কাট (২০০৩) সিনেমা একজন নারীর যৌনতার অনুসন্ধানের গল্প নিয়ে।     
নারীদের যৌনতা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হওয়ার জন্য সেন্সরশীপের সম্মুখীন হয়। যেমন, দ্য  কুলার (২০০৩), বয়েজ ডোন্ট ক্রাই (১৯৯৯) এবং ব্লু ভ্যালেন্টাইন (২০১০) এর নির্মাতা তাদের সিনেমার  অথবা এন.সি-১৭ এর কাতারে পড়ে নারী যোনীলেহন বর্ণনা  করার জন্য। এরকম দৃশ্য নারীর তৃপ্তির দিকে গুরুত্ব দেয় এবং নারীর to-be-looked-at-ness-কে ছোট করে দেখায়। দ্য পিয়ানো, ইন দ্যা কাট বা ম্যারি অ্যানটোইনেট-এর মত সিনেমা গান, কামোত্তেজক দৃশ্য এবং ভিজুয়াল এসথেটিক্স ব্যবহার করে নারীবাদি নজর প্রকাশ করতে পারে। এভাবে এ সিনেমাগুলো নারীকে অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার না করে সাবজেক্ট হিসেবে দেখিয়ে নজর-এর (gaze) বিরোধিতা করে এবং সিনেমা ও  মিডিয়ায় পুরুষ নজরকে পুরোপুরি অনুকরণ না করে, এগুলো পুরুষালি দুনিয়ার নজর ভঙ্গির প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে।  

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন