অর্থনীতির চোখে মেয়েদের বিয়ের বাজার

IMG-20240430-WA0003
নাজমুল হোসেন
হিউমারিস্ট

বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ওই দিকের কিছু অঞ্চলে মেয়েদের প্রথমবার পিরিয়ড হলে বাসায় পায়েস বা সিন্নি টাইপ কিছু রান্না করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা টুকটাক দেখতেও আসে। নতুন জামা দেয়। এই সংস্কৃতিটা জানার ও দেখার পর আমি পুলকিত অনুভব করেছিলাম। এরপর বিষয়টি মূল খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়ে বড় হয়েছে, ভালো পাত্র থাকলে জানাবেন—মূলত আত্মীয় ও প্রতিবেশিকে এই বার্তাটি দেয়ার জন্যই পিরিয়ড নিয়ে এত আয়োজন। 

এই অঞ্চলে মেয়েদের বড় করা হয় একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এই উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বিয়ে। এখানে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে পরিবার ও সমাজের প্রতিটি বিনিয়োগই হয় বিয়েকে কেন্দ্র করে।  


জন্ম থেকে শুরু  

একসময় কারও কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে আত্নীয়স্বজনরা নতুন বাবাকে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিতো। মেয়ে বড় হবে, মেয়ের সাথে সাথে গাছও বড় হবে। বিয়ের বয়স হলে এই গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে। মূল উদ্দেশ্য মেয়ের জন্য সেভিংস করা। সরি, মেয়ের জন্য না; বাক্যটা হবে, মেয়ের বিয়ের জন্য সেভিংস।

কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই এই অঞ্চলে বিয়ের ঝনঝনানি শুনবেন। গায়ের রঙ কালো হলে শুনবেন, বিয়ের দিতে খবর আছে। টাকা বেশি করে জমাও। 

গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সমস্যা। তখন শুনতে হয়–এত সুন্দর মেয়ে। মা গো মা। এই মেয়ের জন্য জামাই পাওয়া যাবে না।  

এই অঞ্চলে দাদিদের অন্যতম অবসর বিনোদন হচ্ছে বিয়ে দেয়া। সিরিয়াস বিয়ে না। খেলনা বিয়ে। বেশিরভাগ দাদিকেই দেখবেন, অবসরে বসে নিজের বাচ্চাবাচ্চা নাতি-নাতনীদের বিয়ে ঠিক করছে। প্রিয় পাঠক, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ছোটবেলায় আপনার দাদি কোন কাজিনের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছিল?  

ছোটবেলায় দাদির দেয়া এই কাজিন ম্যারিজ থেকে অনেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, চট্টগ্রামবাসী আর বের হতে পারেনি! 

পড়ালেখাটাও বিয়ের জন্যই   

ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম। আমার মতে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক আছে। তবে মেয়েদের জীবনের লক্ষ রচনায় একটা উদ্দেশ্যই থাকা উচিৎ, বড় হয়ে বউ হতে চাই। কেন, বুঝিয়ে বলছি। 

এই অঞ্চলে মেয়েদের পড়ালেখার একটা অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিয়ের বাজারের জন্য তাকে প্রস্তুত করা। একটু টেকনোলজির ভাষায় বললে, মেয়েদের পড়ালেখা এখানে বিয়ের জন্য একটা এক্সক্লুসিভ ফিচার। গ্রামে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেয়েদের চাহিদা বেশি, এজন্য দেখবেন মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী। বাজার চাহিদার যোগান দিতে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে একটা বড় অংশের বিয়ে হয়ে যায়।  

বাংলাদেশের বিয়ের বাজারে নবম-দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। বেশিরভাগ পুরুষই স্ত্রী হিসেবে অধিনস্ত একজনকে চায়, যে তার কথায় উঠবে আর বসবে। তারা মনে করে, মেয়ে স্কুল ছেড়ে কলেজে গেলে একটু চালাক হয়ে যায়, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও চালাক। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর বিয়ের বাজারে প্রচলিত আছে, বেশি শিক্ষিত মেয়ে জামাইকে দাম দেয় না, মুখের উপর কথা বলে। সোজা কথায়, বেশি শিক্ষিত মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা পুরুষের জন্য চ্যালেঞ্জের। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে দেশি পুরুষের প্রথম পছন্দ নবম ও দশম শ্রেণীর কনে। আর একটা ফিচার অবশ্য তাদের আছে। এই ধরনের মেয়েরা সন্তান-সন্ততির প্রাথমিক শিক্ষার কাজটুকু সারতে পারবে।  

যারা মনে করে সংসার সামলানোর জন্য একটু চালাক মেয়ের দরকার আছে, তাদের পছন্দের শীর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে। এখানে একটা বিশাল অংশ সোল্ড আউট হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আর একটা বড় অংশকে ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা অনার্সে ভর্তি করিয়ে রেখে বাবা-মা বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে। বিয়ের পর্বটা সেরে ফেলতে পারলে চুকে যায় পড়ালেখার পর্বটাও। যেন বিয়ে করাই ছিল পৃথিবীতে মেয়েটির জন্ম নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য।

আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে, গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে একটু খোঁজ নিলে দেখবেন একজন শিক্ষক আছেন যিনি শিক্ষতার পাশাপাশি পার্ট টাইম ম্যাচ মেকিং এর কাজও করেন। কোনো বিবাহযোগ্য পাত্রের বাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সোর্সও তিনিই বটে।   

বিয়ের জন্য প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট  করা

‘কনে দেখা আলো’ বলে দারুণ একটা জিনিস আছে বাংলা ভাষায়। জিনিসটা শুনতে ব্যাপক রোমান্টিক মনে হলেও এই ‘কনে দেখা আলোর’ মিনিং কিন্তু আবার ভিন্ন। মূলত শেষ বিকেলের বা গোধূলির সূর্যের কমলা রঙের আলোকে কনে দেখা আলো বলে। কারণ এই আলোতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বেড়ে যায়। অনেক আগে গ্রামে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাদেখির কাজটা হতো উঠানে। বিকেলের এই কমলা রঙা আলোটা কনের গায়ে এসে পড়লে কনেকে উজ্জ্বল দেখাতো। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের কী ডেডিকেশন দেখুন, প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করে ফেলেছি। প্রকৃতি বাদ দিলেও মেয়ের বিয়ের জন্য হুজুর, ওঝাদের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ আনার গল্প তো বেশ পুরোনো নয়। কোথাও কোথাও এখনও এমন হয় না, এমনটাও বলা যায় না।  

আর্থিক বিনিয়োগ কেমন?  

ছেলের বিয়ের জন্য বাপ-মা টাকা জমাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে শোনা যায় না। তবে গ্রাম থেকে শহর, বস্তিবাসী থেকে গুলশানবাসী–প্রত্যেকটা বাবা-মাকে দেখবেন মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে। বিনিয়োগের পরিমাণটাও একদমই ফেলে দেয়ার মত না। পরিবারের আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ ও তারও বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয় শুধু মাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য।  

এই বিনিয়োগটা তো শুধু মেয়ের বিয়ের দিনকে কেন্দ্র করে না। বাংলাদেশের সামাজিক কালচারে এই বিনিয়োগ চলে মেয়ের বিয়ের পর বাকি জীবন। প্রথম এক বছরকে ধরা যেতে পারে গোল্ডেন পিরিয়ড। এই এক বছরে প্রতিটি সামাজিক, ধর্মীয় উৎসব, এমনকি ঋতু পরিবর্তন হওয়াকে কেন্দ্র করেও মেয়ের শশুর বাড়িতে উপহার পাঠাতে হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিষয়টার গুরুত্ব এতটাই যে, মেয়ের বাবা রীতিমত আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে মেয়ের শশুর বাড়িতে কোরবানীর ইদের গরু উপহার পাঠায়। চট্টগ্রামের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এমন অন্তত একটা ঘটনা সে আপনাকে জানাতে পারবে। ব্যাংকগুলো চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই সম্পর্কিত একটা লোনের ব্যবস্থাও করতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে কিছু না জেনেও চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম, ব্যবসায় সবুজ বাত্তি। পরে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েন।    

এখানে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে পরিবার ও সমাজের প্রতিটি বিনিয়োগই হয় বিয়েকে কেন্দ্র করে
অলঙ্করণঃ রিসাদ

মাইক্রো ক্রেডিট এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের শশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর ঘটনাও আমি দেখেছি। এই সংক্রান্ত একটা দারুণ পরিহাসও আছে। একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন নিয়ে এনজিওগুলো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, আবার অন্যদিকে সেসব এনজিওর মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের বাবা-মা মেয়ের শশুর বাড়িতে বাধ্যতামূলক উপহার পাঠাচ্ছে। এনজিওগুলো এইসব জানেন না নিশ্চয়ই। ওনারা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণ দেন। অবশ্য বিয়েতে এই বিনিয়োগের গুরুত্ব বিবেচনা করলে সেটা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার চেয়ে কম না।   

মেয়ের বিয়ের জন্য ভিক্ষা করার ঘটনা তো শহরের লোকাল বাসে কিংবা গ্রামের কোনো রাস্তায় নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। দু-এক টাকা দিয়েছেনও হয়তো। গ্রামে প্রচুর দেখা যায়। হিসেব করলে বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ের এই বাজারে এই অধমেরও হাজার খানেক টাকার বিনিয়োগ আছে। গ্রামের দিকে কিন্তু কোনো মেয়ের জন্য টাকা দেয়াটা এক ধরনের সমাজসেবা। কোনো সমাজসেবক এলাকায় কতটি মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য করেছে–এটা সমাজসেবকদের পোর্টফোলিও মাপার অন্যতম নিয়ামক।    

এই ব্যাপারটায় ছেলেদের জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোসই লাগে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে দায়িত্ববান বাবা-মা বলবে, কিছু টাকা পেয়েও যাবেন। কিন্তু ছেলের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে ‘হাহা’ রিএ্যাক্ট দেবে। 


স্কিল বিনিয়োগ 

বাংলাদেশে একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে যে সকল স্কিল শেখে বা তাকে শেখানো হয় সেখান থেকে কয়েকটি স্কিল কি দেখানো যাবে, যেগুলো বিয়েকে উদ্দেশ্য করে শেখা না! আমি অন্তত খুব একটা দেখি না। রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চাকাচ্চা পালা, পিঠা-পুলি বানানো সবকিছু শেখানো হয় বিয়েকে উদ্দেশ্য করে। বিয়ের পর যেন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ইমপ্রেস করা যায়। এর মধ্যে অনেক পরিবার মেয়েকে কিছু ক্রিয়েটিভ স্কিলও শেখায়। নকশিকাঁথা সেলাই, কালাভূনা রান্না কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে একটু গানের গলা থাকা। মেয়েদের এইসব স্কিল বিয়ের বাজারে অনেকটা এক্সট্রা একটা এমবিএ ডিগ্রির মত কাজ করে।  চট্টগ্রামে ব্যাংকের মত স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও এমন ইন্সটিউটিউট গড়ে উঠতে পারে। যারা মেয়েদেরকে নানান স্কিল শেখানোর মাধ্যমে বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।  

চলুন একটা মেয়ের গল্প শুনে লেখাটা শেষ করে ফেলি। লাপাত্তা লেডিস (২০২৩) সিনেমার একটি চরিত্র জয়া। থাকে ভারতের একটি গ্রামে। স্মার্ট, আধুনিক, বুদ্ধিমান। বাবা কৃষক হওয়ায় কৃষি কাজটা আয়ত্ত করে ফেলেছে বেশ। তার স্বপ্ন অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে পড়াশোনা করার। বাবা-মাকে জানিয়েছে, দেরাদুনে পড়তে যাবে। জয়ার বাবা জয়ার জন্য বিনিয়োগ করবে বলে একটা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বিনিয়োগটা কিসের জন্য বলুন তো? না, অর্গানিক ফার্মিং এর জন্য না, জমি বিক্রি করা হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। জামাইকে যৌতুক দেয়ার জন্য। মা জয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বিয়ের পর জামাইকে রাজি করাতে পারলে পড়ালেখা করবে, নইলে করবে না।      

জয়ার এই গল্প আসলে উপমহাদেশের অধিকাংশ মেয়েরই গল্প। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করা, গয়না বিক্রি করা, সম্পদ বন্ধক দেয়া বাংলাদেশেরই নিয়মিত ঘটনা। মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ ঠিকই আছে, শুধু বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা ঠিক নাই। 

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন