নারীর ‘নিখুঁত’ গড়নের সংজ্ঞা যুগে যুগে যেভাবে বদলেছে 

আচ্ছা, একজন মানুষকে ‘সুন্দর’ বলতে গেলে কোন দিকগুলো আমরা বিবেচনা করি? সৌন্দর্যের মাপকাঠি আজকের দিনে যেমন, অতীতের দিনগুলোতেও তেমনই ছিলো- এমন ধারণা ভুল। নারী (কিংবা পুরুষের) ‘নিখুঁত’ অবয়বের সংজ্ঞা যুগে যুগে বদলেছে, যদিও বিবর্তনের ধারায় নারীর শারীরিক গঠনে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি।  কখনো নিজের দেহের গড়ন নিয়ে দ্বিধা বা সংকোচ হলে, তাই, মনে রাখবেন যে, ‘নিখুঁত’ দৈহিক গঠন একটি পরিবর্তনশীল ধারণা- যুগ আর প্রজন্মের সাথে সাথে বদলায় ‘আকর্ষণীয়’ দেহের সংজ্ঞা।  

প্যালিওলিথিক যুগ 

মানবজাতির ইতিহাসের একদম প্রথম দিকের একটি শিল্পচর্চার নিদর্শন হলো উইলেনডর্ফের ভেনাস (Venus of Willendorf), যা একটি আদিম নারীমূর্তি। খৃষ্টপূর্ব ২৪,০০০ থেকে ২২,০০০ সালের মাঝে নির্মিত এই নারীর অবয়ব—যা উর্বরতার প্রতীক হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিলো- দেখতে মোটেই বর্তমান যুগের মডেলদের মতো নয়।  এই নারীর আদলকে কোন রাকঢাক না করেই সরাসরি স্থূল বলা যায়। স্ফীত বক্ষযুগল, চওড়া নিতম্ব আর মেদবহুল উদরের এই মূর্তি দেখে ধারণা করা যায়, অধিক সন্তান জন্মদানের জন্য উপযোগী দেহই ছিলো সে যুগের আকর্ষণীয় নারীদেহের পূর্বশর্ত। প্রতিমাটি নির্মাণের সময় এর চোখ, ঠোঁট কিংবা মুখাবয়ব নিয়ে কোন কাজই করা হয় নি, মনে হতে পারে- কারিগরের চোখ মুখ নিয়ে কোন মাথাব্যাথাই ছিলো না। তবে স্বাভাবিকভাবেই সে যুগে নারী কিংবা পুরুষ- কারো জন্যই ক্ষীণকায় দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো না। বেঁচে থাকতে হলে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কোন বিকল্প ছিলো না। তাই মুখাবয়বের সৌন্দর্য নিয়ে কারো মাথাব্যাথা ছিলো না। কারণ সুন্দর চোখের ঝলক দেখিয়ে আর যাই হোক- হিংস্র সিংহের আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব ছিলো না, দরকার ছিলো পেশীর জোর।   

শিল্প যে সবসময় বাস্তবের মতোই হতে হবে, এমন কোন দায়িত্ব শিল্পীর ঘাড়ে থাকে না। উইলেনডর্ফের ভেনাস যে সমসাময়িক নারী আদলের নির্ভুল প্রতিকৃতি- এমনটি আশা করা ভুল। তবুও, ২৫০০০ বছর আগে সুডৌল আর স্বাস্থ্যবান নারীদেহই ছিল কামনীয়- এই ধারণার প্রমাণ পাওয়াই যায়।  

প্রাচীন গ্রিস 

গ্রিকরা আক্ষরিক অর্থেই সৌন্দর্যের সংজ্ঞায়ন করছিলো।  প্রাচীন গ্রিসে নারীদের সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রীক সাহিত্যিক হেসিয়ডের (খৃষ্টপূর্ব ৮-৭ শতক) লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম নারীর সৃষ্টি হয়েছিলো ‘কালন কাকন’ (Kalon Kakon) রূপে, যার মানে হলো ‘অশুভ-সুন্দর’। সুন্দর বলেই প্রথম নারী ছিল অশুভ, আর অশুভ বলেই প্রথম নারী ছিলো সুন্দর।’ তবে কি সেই যুগে পুরুষের সৌন্দর্য ছিলো সৌভাগ্য, আর নারীর সৌন্দর্য অলুক্ষুণে ব্যাপার? হতেও পারে! প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর্যগুলোতে নারীদের যেই আদর্শ আদল শিল্পীর ছোঁয়ায় গড়া হয়েছিলো- সেখানে তাদের চওড়া কোমর, ভরাট স্তন আর কিছুটা মেদযুক্ত উদরের অধিকারী দেখানো হতো। তবে গ্রীকরা সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বের করার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে ছিলোঃ তারা আবেদনময়তার অঙ্ক বের করার সংকল্প নিয়েছিলো।    


গোল্ডেন রেশিও বা সোনালী অনুপাতের ধারণাটি প্লেটোর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেলেও এটি মূলত তার সহকর্মী পীথাগোরাসের মস্তিষ্কপ্রসূত (হ্যাঁ, জ্যামিতি বইয়ের সেই পীথাগোরাস)। প্রকৃতি কিংবা মানুষের মুখাবয়ব- সবখানেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে বেছে নেয়া হয় গোল্ডেন রেশিওকে। এই গোল্ডেন রেশিওর হিসেবে একজন নারীর চেহারা তখনই সুন্দর বলা যাবে, যখন তার মুখের প্রস্থ তার দৈর্ঘ্যের দুই-তৃতীয়াংশ হবে, এবং মুখমন্ডলের দুইটি দিকেই প্রতিসমতা থাকবে। এই প্রতিসম মুখমন্ডল সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে আজও বিবেচিত হয়। ‘আজ দেখতে ভালো না বলে…’- এরকম হতাশা যদি আপনার থাকে, তাহলে পীথাগোরাসকেই দোষারোপ করতে পারেন!   

রেনেসাঁ যুগের প্রাথমিক পর্যায়  


মধ্যযুগের প্রচলিত রক্ষণশীল চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো রেনেসাঁ যুগের শিল্পীরা। ১৩০০ থেকে ১৫০০ খৃষ্টাব্দে চলমান রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে নগ্ন বক্ষের নারীদের দেখা যেত উর্বরতা ও বাসনার প্রতীক হিসেবে। 

রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত শিল্পী রাফায়েলের চিত্রকর্মে নারীদের আদর্শ অবয়ব ছিলো সুডৌল, কিছুটা ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণের, এবং তাদের মুখ গোলগাল নরম আর রক্তিম আভায় রাঙানো। রাফায়েল নিজেই বলেছিলেন, তার ছবিতে তিনি বাস্তব নারীর আদলে আঁকেন নি, বরং তার কল্পনায় সুন্দর নারী যেমন ভাবতেন- তেমন করেই এঁকেছেন। অনেক চিত্রশিল্পী এমন স্টাইলেই ছবি আঁকতেন। রেনেসাঁ যুগ শৈল্পিক ধারায় এক নতুন যুগ ছিলো, যেখানে নারীদের নিছক জন্মদাত্রীর বদলে কামনা ও বাসনার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো।   

এলিজাবেথীয় যুগ 

রানী এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৫৫৮ সালে, আর তখন থেকেই শুরু হয় মেকআপ ব্যবহারের সূচনা। সেই আমলে মুখে মেকআপ করা নারীদের মনে করা হতো ‘শয়তানের অবতার’। আর এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন রানী এলিজাবেথ- মুখে সাদা মেকআপ আর তার বিখ্যাত ঠোঁটে লাল রং মেখে। বলা চলে, তার এই মেকআপের কারণেই সে আমলে পুরো ট্রেন্ড বদলে যায়। সেই যুগে সাদা আর ফ্যাকাশে গায়ের রং ছিলো সামাজিক উচ্চতার প্রতীক, কারণ অভিজাত শ্রেণী ঘরে বসেই জীবনযাপন করার বিলাসিতা করতে পারতো। রোদে পুড়ে তামাটে হওয়া গায়ের রংকে ধরা হতো দারিদ্রের লক্ষণ, খেটে খাওয়া মানুষের পরিচয়। 

নিজের কুমারী ও রাজকীয়তার পরিচয় দিতে (পরবর্তীতে নিজের গুটিবসন্তের দাগ লুকাতে) রানী এলিজাবেথ মুখে সাদা সীসার পাউডার মাখতেন, এবং ঠোঁট রাঙাতেন লাল রঙে। তার এই ট্রেন্ড অনুসরণ করতে শুরু করে অভিজাত সমাজ, এমনকি সংবাদপত্রে বলা হতো যে ঠোঁটে লিপস্টিক জাদুর মতো কাজ করে- এমনকি মৃত্যুকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। নিয়তির পরিহাসই হয়তো বলা যায়, মৃত্যুর সময় রানীর ঠোঁট রাঙানো ছিলো আধ-ইঞ্চি লাল রঙের প্রলেপে। 

নিখুঁত’ দৈহিক গঠন একটি পরিবর্তনশীল ধারণা- যুগ আর প্রজন্মের সাথে সাথে বদলায় ‘আকর্ষণীয়’ দেহের সংজ্ঞা  
অলঙ্করণঃ রাজিব

ফরাসী বিপ্লব-পরবর্তীকাল থেকে শুরু করে ১৮ শতকের শেষভাগ 

১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে মানুষ অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সকল প্রতীক থেকে সরে আসতে চেয়েছিলো। অতিরিক্ত মেকআপের বদলে তখন অনাড়ম্বর প্রসাধনই বেশি প্রচলিত হওয়া শুরু করে, অভিজাতদের বিশাল ফোলানো গাউনের পরিধিও ছোট হয়ে আসতে শুরু করে। 

ফরাসী বিপ্লবের আগে মেকআপ ছিলো নারী-পুরুষ সবার প্রসাধন। কিন্তু এই বিপ্লবের পর থেকেই কৃত্রিমতা হয়ে উঠে ঘৃণ্য একটি ধারণা, যার কারনে হালকা প্রসাধনের ‘ন্যাচারাল লুক’-এর প্রতি সবার আগ্রহ বেড়ে যায়। কিন্তু উনবিংশ শতক থেকে বিপ্লবের স্মৃতি ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে, নারীদের মাঝে আবার মেকআপের আধিক্য জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।  

এ নিয়ে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, বারবনিতারা মেকআপ আর পোশাকের মুন্সিয়ানা দেখাতো মূলত পুরুষের মন জয় করতে। কিছু কিছু অভিজাত নারী রীতিমতো আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের অনাবৃত হওয়ার প্রদর্শনীর আয়োজন করতো দর্শনার্থীদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের কাছে এই ট্রেন্ড যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলো। তবে পুরুষদের  মেকআপ করার রীতির প্রচলন তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি, এটি নারীর ভূ্যণ হিসেবেই তকমা পেয়ে যায়। নারীদের সৌন্দর্যবর্ধন আর আবেদনময়ী হিসেবে দেখানোতেই প্রসাধন ব্যবহার করা হতো বেশি।  

ভিক্টোরিয়ান যুগ

১৮৩৭ সালে যখন রানী ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন, ব্রিটিশ লাইব্রেরির রিপোর্টের মতে, সেই আমলে পরিমিতিবোধই ছিলো সৌন্দর্যের প্রতীক। আর বিবিসির বর্ণনায় জানা যায়, সেই যুগে ঘরে বসে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার মাঝেই নারীদের জীবনের পরিপূর্ণতা নিহিত ছিলো বলে ভাবা হতো। শক্ত-সামর্থ্য নারীদের চেয়ে যেন ক্ষীণ, দুর্বলতাই ছিলো নারীদের প্রকৃত সৌন্দর্যের প্রতীক। শিল্পী এবং গবেষক এলেক্সিস কার্ল বলেন, ‘নারীদের ক্ষীণকায়ার মাঝেই প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায় বলে ধারণা করা হতো।’ কে জানতো, রোগা আর শীর্ণ দেহও আবেদনের প্রতীক হিসেবে ভাবা যেতে পারে?   

সেই যুগে মেকআপের সামগ্রী ব্যবহার করাও ছিলো বিপদজনক ব্যাপার। সীসা, এমোনিয়া, পারদ আর নাইটশেডের মতো বিষাক্ত উপাদান ব্যবহার করা হতো প্রসাধনে, এগুলো বিপদজনক- এ কথা জানা সত্ত্বেও তারা এসব ব্যবহার করতো। সৌন্দর্য বাড়াতে বিষাক্রান্ত হতেও অনীহা ছিলো না ভিক্টোরিয়ান যুগের নারীদের। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নমনীয় নারীদের মাঝেই এই ট্রেন্ড ফলো করার ঝোঁক ছিলো বেশি, তবে সব নারী আবার শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য মৃত্যুবরণ করতে রাজি ছিলো না।  

বিশ শতকের শুরুতে 

১৮৯০ সালে জনপ্রিয়তা পায় চার্লস গিবসনের আঁকা ‘গিবসন গার্ল’ ছবিটি, যা ছিলো সেই আমলের সুন্দর নারীর সংজ্ঞা। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত সেই চিত্রকর্মের নারীর মতোই হতে চেষ্টা করতো অনেক নারী। গিবসনের এই ছবিতে ফর্সা রঙের এই মেয়েটির পরিধান ছিলো আঁটসাঁট করসেট, যার ভাঁজ থেকে দেহের গড়নও স্পষ্ট দেখা যেতো। 

চওড়া কটি, নরম এবং সুডৌল গঠন তখনও সবার আকাঙ্ক্ষিত ‘বডি স্ট্যান্ডার্ড’ হলেও সেই আমল থেকেই শুরু হয় কিছুটা সরু গঠনের দেহের জনপ্রিয়তা। যদিও ‘গিবসন গার্ল’ একটি কাল্পনিক নারীর আদলেই আঁকা হয়েছিলো, তবুও ইতিহাসের প্রথম সুপারমডেল এভেলিন নিসবেটের গড়ন ছিলো সেই গিবসন গার্লের অনেকটা কাছাকাছি। তবে ঘুরেফিরে সৌন্দর্যের এই মাপকাঠি এসেছিলো একজন পুরুষের কল্পনা থেকেই, কোন সত্যিকারের নারীদেহের উপর ভিত্তি করে আসে নি। 

এভেলিন নিসবেট। যদিও ‘গিবসন গার্ল’ একটি কাল্পনিক নারীর আদলেই আঁকা হয়েছিলো, তবুও ইতিহাসের প্রথম সুপারমডেল এভেলিন নিসবেটের গড়ন ছিলো সেই গিবসন গার্লের অনেকটা কাছাকাছি।

১৯২০-এর দশক 

১৯১০-এর দশকের পরপর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর তখন অনেক নারীই পুরুষের সাথে সমান তালে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়া শুরু করে। আর যুদ্ধের পর তারা তাদের এই স্বাধীনতার স্বাদ ভুলে যায় নি। ১৯২০-এর দশকে পশ্চিমা নারীরা ভোট দেয়ার অধিকার অর্জন করে, এবং এতদিন ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেয়া সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড বর্জন করা শুরু করে তারা। কিছুটা সংক্ষিপ্ত পোশাক আর ছোট চুলের একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, আর যেসব নারী এমন ট্রেন্ড অনুসরণ করতেন, তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয় ফ্ল্যাপারস (Flappers) বলে। প্রথমবারের মতো সুডৌল দেহাবয়বের বদলে একহারা গড়নকে নিজেদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে তারা। ছোট চুলকে বেশ ফ্যাশনেবল বলেই মনে করা হতো।  

স্কার্টের পাশে থাকা হেমলাইন বা চিরের উচ্চতা তখন অনেকটা বেড়ে যায়, যাতে করে নারীরা আরও বেশি স্বাচ্ছ্যন্দে চলাফেরা করতে পারতো, মনের আনন্দে নাচতে চাইলে পা বেঁধে যেত না স্কার্টের ঘেরে। তবে এই আমলের একটি নেতিবাচক দিক হলো, একহারা সরু দেহের এই ট্রেন্ড নারীদের দেহের মেদ আর প্রস্থ নিয়ে অনেকটা হীনমন্যতায় ফেলে দেয়। ১৯২০-এর দশকের আগে নিজের ওজন মাপা একটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিলো, এমনকি পুরো দেহ দেখা যায় এমন আয়না বিলাসী দ্রব্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। সেই সময়ের আগে শুধু ধনীরাই নিজেদের পুরো অবয়ব আয়নায় দেখার সুযোগ পেত। কিন্তু এই ১৯২০-এর দশকে দেহের ওজন মাপার মেশিন হয়ে যায় সহজলভ্য, চাইলেই যে কেউ কিনে তার বাথরুমে রেখে দিতে পারতো। আর নিজের ওজন কতো, বেড়ে গেল কিনা- এমন ভাবনা বিভোর করে রাখতো সে সময়ের নারীদের। আর সে সময় অলিতে গলিতে গড়ে উঠতে শুরু করে অনেক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর- যেখানে চাইলেই নারীরা নিজেদের পুরো আকার দেখতে পেতেন লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আর নিজেদের এই প্রতিচ্ছবিতে নিজ দেহের খুঁতগুলোই সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে তাদের চোখে ধরা দিতো। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিলো নারীদের ‘বডি অবসেশন’। 

তিরিশ ও চল্লিশের দশক 

১৯২০-এর দশকের শেষদিকে শুরু হয় ‘মহামন্দা’র যুগ। তখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ফ্যাশন নিয়ে ভাবনার সুযোগ তেমন ছিলো না। বেশিরভাগ নারীই আগের দশকের একহারা গড়নের এই ফ্যাশন নিয়ে ভাবা ভুলে যায়, আর তখনকার আমলে ভরাট নারীদেহই বেশি প্রচলিত হতে শুরু করে।    

যুদ্ধ ও অন্যান্য দুঃসময়ে অভাব নারীদেরকে নিজেদের পোশাক নিয়ে আরও সৃজনশীল হতে বাধ্য করে। পুরুষের পুরোনো স্যুট কেটে নারীরা নিজেদের পোশাক বানানো শুরু করে তখন। চওড়া কাঁধ আর সরু কোমরে অনেকটা বালুর ঘড়ির মতো আদল নারীদের মাঝে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। যেহেতু এর আগের বছরগুলোতে অভাবের দুঃসময় কাটিয়ে আসতে হয়েছে, কেউ আর শীর্ণ দেহে নিজেকে দেখতে চাইতো না, কারণ তা বিগত অভাবের দিনের কথাই মনে করিয়ে দিতো। তাই বলে ১৯১০-এর দশকের গিবসন গার্লের মতো সুডৌল গড়ন হতে হবে- এমনটাও কেউ আশা করতো না। 

পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের শুরুর বছরগুলো

এই সময়টিতে গ্রেট ডিপ্রেশন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করেছিলো সবাই। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, এই সময় ধনী হতে শুরু করে। সবার মাঝেই কাজ করতো ফুর্তির মেজাজ, আর সেখান থেকেই আরেকটু ভরাট দেহ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।  

অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, ৫০’এর দশকের আবেদনময়ী নারীদেরকে আজকের যুগে ‘প্লাস সাইজ’ হিসেবে ধরা হবে। যদিও একালের মডেলদের তুলনায় তাদেরকে সামান্য ভারী বলা যায়, সিনেমার তারকা অভিনেত্রীরা কিন্তু বেশ ছিপছিপে গড়ন অধিকারী ছিলেন। তথ্যমতে, সে আমলে বেশিরভাগ রূপালি পর্দার নারীদের বিএমআই ছিলো ১৮.৮ থেকে ২০.৫ এর মাঝামাঝি, যা গড়পড়তা নারীদের ২৩.৬ মাত্রার চেয়ে বেশ কম ছিলো। তাই আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ভরাট গড়নের দেহকেই নারীদের জন্য আদর্শ বলা হলেও, সাধারণ নারীদের দেহের গড়নের সাথে এই মাপকাঠির ভালো রকমের অসামঞ্জস্যতা ছিলো বলা যায়। এই দশকের একটি নিউজরিলে দেখা যায়, আমেরিকার একটি শহরে আয়োজিত হয়েছিলো ‘মিস ফ্যাট অ্যান্ড বিউটিফুল’ প্রতিযোগিতা। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন আয়োজন করে কোন নারীকে ‘মোটা’ উপাধি দেয়া হচ্ছে- এমন কথা কল্পনাই করা যায় না। আর সেই ৫০’এর দশকের এই প্রতিযোগিতায় যেসব নারী অংশ নিয়েছিলেন, বর্তমান যুগের স্ট্যান্ডার্ডে স্থুল হিসেবে বিবেচনাও করবে না কেউ! এ থেকেই প্রমাণিত হয়, ছিপছিপে দেহ অনেক দিন ধরেই ছিলো নারীদের জন্য আরাধ্য বিষয়।  

৬০ এর দশকের শেষ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত 

ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও জীবনধারায় পরিবর্তন আসা শুরু করে। বাড়ি গাড়ি পেয়ে ঘরে বসে থাকা গৃহিণীর জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলো না পশ্চিমের নারীরা। ৫০’এর দশকের রক্ষণশীল জীবনধারার বাইরে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো সে সময়ের তরুণেরা। এই যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ছিলো টুইগি- আর তা থেকেই বোঝা যায়, ছিপছিপে একহারা গড়ন আবার হয়ে উঠে ফ্যাশনেবল। 

সত্তরের দশকে নারী স্বাধীনতার স্রোত আরও জোরে বইতে শুরু করলেও, পাতলা গড়নের প্রতি মোহ তখনও চলমান ছিলো। টুইগির চেয়ে ফারাহ ফসেটের গড়ন সামান্য চওড়া হলেও দিনশেষে তিনিও ছিলেন ক্ষীণ গড়নের একজন নারী- আর তিনি ছিলেন এই সত্তরের দশকে সবচেয়ে আবেদনময়ী একজন নারী। মেকআপ আর ফ্যাশনে প্রাধান্য পেত ‘ন্যাচারাল লুক’। ষাটের দশকে যেমন প্রকট সব ফ্যাশন ট্রেন্ড চালু হয়েছিলো, এই দশকে তেমনটি ছিলো না। নারীদের মধ্যে লম্বা চুল খোলা রেখে দেয়ার প্রবণতাই ছিলো বেশি। 

আশির দশক নিয়ে আসে ‘সুপারমডেল’-দের যুগ। তামাটে, লম্বা, পাতলা কিন্তু সুগঠিত দেহই ছিলো নারীদের ‘আদর্শ’ দেহের আদল। ক্ষীণকটি কিন্তু ভরাট বক্ষযুগলবিশিষ্ট দেহ তখনও ছিলো আবেদনময়তার মাপকাঠি। অভিনেত্রীদের দেখে নয়, বরং মডেলদের ফ্যাশন আর দেহের গড়ন দেখেই সেই সময়ের নারীরা বেশি অনুপ্রাণিত হতেন। যদিও গড়পড়তা নারী আর ফ্যাশন মডেলের দেহের প্রস্থে ছিল বিস্তর ফারাক! 

চিকন দেহের এই প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যায় ৯০’এর দশকে। ব্রিটিশ মডেল ‘কেট মস’-এর গড়ন সেই ষাটের দশকে ক্ষীণদেহের জন্য বিখ্যাত মডেল ‘টুইগি’কেও প্রায় হার মানিয়ে দিয়েছিলো। কেট মসের বিএমআই ছিলো মাত্র ১৬, আর তার মাধ্যমেই এই দশকে ‘হিরোইন শিক’ বা হাড্ডিচর্মসার গড়নের ট্রেন্ড জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মজার ব্যপার হলো, ৯০’এর দশক আর ভিক্টোরিয়ান যুগের মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল আছে- তা হলো এই দুই সময়েই মৃত্যুপথযাত্রীদের সাথে তুলনীয় দেহের গড়নকে সুন্দর বলে ধরা হতো! ভগ (vogue) ম্যাগাজিনের পাতা ঘেঁটে বলাই যায়, আদর্শ নারীদেহের গড়ন সবচেয়ে বেশি সরু ছিলো এই নব্বইয়ের দশকেই। 

‘নিখুঁত’ মানে আসলে কী?  

সৌভাগ্যের বিষয় হলো, আমরা এমন একটি যুগে প্রবেশ করছি যখন গণমাধ্যমে জাতি কিংবা গড়ন নির্বিশেষে সৌন্দর্যের প্রশংসা করা হয়- যদিও আরও অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি। ২০১৭ সালে ‘নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উয়িক’ শুরু হওয়ার আগে আমেরিকার ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাউন্সিল সকল ডিজাইনারের কাছে একটি বার্তা পাঠায়- যেখানে তারা ডিজাইনারদের মনে করিয়ে দেয় ‘নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করে নানা জাতির নানা গড়নের বৈচিত্র্যময় সব মানুষ। আমরা চাই আমাদের এই আয়োজনে এই বৈচিত্র্যের উদযাপন হোক।’ তার জন্যেই তারা ডিজাইনারদের উৎসাহিত করেছিলো বিভিন্ন গড়ন আর জাতির মডেলদের সাথে কাজ করতে।    

এও মনে রাখা দরকার যে ইতিহাস জুড়ে আমরা বেশিরভাগ সময়েই নারীর যেই ‘আদর্শ’ গড়নের রূপ দেখেছি- তা এসেছে কোন পুরুষের কল্পনা থেকেই। বর্তমানে ফটোশপ করার প্রবণতাও যেন সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশাই প্রতিষ্ঠা করছে। ফটোশপের ডিজিটাল জাদু দিয়ে অসম্ভব বডি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দেয়া হচ্ছে- যা বাস্তবে কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। কল্পনার নারীদেহের অবয়ব কিংবা ডিজিটালি বদলে দেয়া ছবির মতো দেহ বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিবর্জিত। সময়ের সাথে স্ট্যান্ডার্ড যে বদলেই চলেছে, তা হয়তো এতক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছি। তাই ‘বডি স্ট্যান্ডার্ড’ আসলে একটি ক্ষনস্থায়ী ব্যাপার, সময়ের সাথে বদলেই চলবে। 

হতে পারে এ সময়ের মাপকাঠিতে আপনার দেহ ‘আদর্শ’ নয়, তাতে কী আসে যায়? ‘নিখুঁত’ বা ‘আদর্শ’ হচ্ছে একটি রূপকথা, যা বাস্তবের সাথে কখনোই মিলবে না। সে কারণেই নিজের এই খুঁতে ভরা সুন্দর  দেহটিকে নিয়েই চলুন খুশি থাকি, জীবনের উৎসবে মেতে থাকি। 

[নর-নারীর সৌন্দর্য যে স্থিরনির্দিষ্ট কিছু নয়, যুগের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত– এটি কমবেশি আমরা সবাই জানি। বর্তমান লেখাটিতে ‘পার্ফেক্ট’ নারীদেহের গড়ন বিষয়ে মূলত পাশ্চাত্যের  ধারণা রূপান্তরশীল ইতিহাসের কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই সৌন্দর্যবোধ প্রাচ্যের সৌন্দর্যবোধের চেয়ে অনেক দিক দিয়েই ভিন্ন। সেমসেম- এ পরবর্তীতে নারী-পুরুষের প্রাচ্যের সৌন্দর্যবোধ নিয়েও ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হবে। — সম্পাদক ]     

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন