এক গল্পের বিপদ

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

আমি একজন গল্পকার। আমার ব্যক্তিগত কিছু গল্প আপনাদের সাথে আজ আমি শেয়ার করতে যাচ্ছি। আমি এর নাম দিয়েছি, ‘এক গল্পের বিপত্তি’। আমার বেড়ে ওঠা পূর্ব নাইজেরিয়ার এক ভার্সিটি ক্যাম্পাসে। মা বলেন, আমি নাকি সেই ২ বছর বয়স থেকেই বই পড়া শুরু করেছিলাম। আমি অবশ্য মনে করি এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। যতদূর মনে পড়ে আমি ৪ বছর বয়স থেকে বই পড়া শুরু করি। মোটকথা, অন্য শিশুদের তুলনায় বেশ দ্রুত পড়তে শিখে গেছিলাম। ব্রিটিশ আর আমেরিকান বইগুলো বেশি পড়া হতো তখন। লেখালেখিটাও আমার বেশ অল্প বয়স থেকে শুরু হয়। ৭ বছর বয়সে ক্রেয়ন রঙে আঁকিবুকির সঙ্গে পেন্সিল দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে গল্প লিখতাম। সেই দূর্বোধ্য গল্পের একমাত্র পাঠক ছিল আমার বেচারি মা।  সেসময় আমি তেমন গল্পই লিখতাম যা আমি পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমার সব চরিত্র ছিল ফর্সা বর্ণের আর তাদের চোখের রঙ ছিল নীল। তারা তুষার বরফে খেলতো, আপেল খেত, আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতো, আর কথা বলতো মেঘ সরে গিয়ে সূর্য তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়ার চমৎকার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। আমি তখনও নাইজেরিয়ার বাইরে যাইনি। নাইজেরিয়ায় কখনো তুষারপাত হতো না। আম ছিল আমাদের খুব পছন্দের। আর আবহাওয়া নিয়ে কখনো আমাদের কথা বলার প্রয়োজনই হয়নি। আমার গল্পের চরিত্রগুলো জিঞ্জার বিয়ার খেতো, কারণ ওইযে, ব্রিটিশ বইয়ের ওরাও খেতো বলে। যদিও জিঞ্জার বিয়ার যে আদতে কী তা-ই আমার জানা ছিল না। এমনকি কিছু বছর পর আমার জিঞ্জার বিয়ার টেস্ট করার বেশ শখও জেগেছিল। সে এক অন্য গল্প। আজ এই গল্পেই থাকি। এই সামান্য গল্পগুলো আমার ওপর, বিশেষভাবে আমার মত শিশুদের ওপর তখন এক অদৃশ্য প্রভাব ফেলছিল। ছোটবেলায় আমার পড়া বইগুলোর সকল চরিত্র ছিল বিদেশি। বিদেশি বইয়ের প্রভাব এতটাই ছিল যে আমি বিশ্বাস করতাম, বিদেশি চরিত্র ছাড়া কোনো বই-ই নেই এই পৃথিবীতে। আর বইয়ে এমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার সঙ্গে আমি নিজের কিংবা আমার চারপাশের মিল খুঁজে পেতে পারি। বইয়ের দুনিয়াটা বুঝি যথারীতি আমার দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে। আমি জানলাম, আমার মতো যাদের চকলেট বর্ণের গায়ের রং আর কোকড়া চুল, তারাও হতে পারে গল্পের অংশ, তাদেরও স্থান আছে সাহিত্যে। তাই সেই দেখাদেখি আমিও লিখতে শুরু করলাম নিজের পরিচিত দুনিয়া নিয়ে। আমি সেই আমেরিকান আর ব্রিটিশ বইগুলোকেও সমানভাবেই ভালোবাসতাম। আমার কল্পনার জগতের ঢাকনাটা যে তারাই খুলে দিয়েছিল। নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করি আমি তাদের হাত ধরেই। তবে তার অনিচ্ছাকৃত ফল হলো আমার মতো মানুষরাও যে সেই দুনিয়ার অংশ হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তাই আফ্রিকান বই আমাকে যা দিয়েছে তা হলো ‘বই কী’ সেই বিষয়ে পুরোপুরি এক ভিন্ন ধারণা, আর পরিচয় করিয়েছে আমার পরিচিত বইয়ের দুনিয়ার সঙ্গে।  

আমি খুবই সাধারণ, মধ্যবিত্ত নাইজেরিয়ান পরিবার থেকে এসেছি। আমার বাবা প্রফেসর ছিলেন। আমার মা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। আর পাঁচজনের মত আমাদের বাড়িতেও গৃহকর্মী রাখা হতো। আমার বয়স যেবার আট হলো, আমাদের বাড়িতে এক নতুন কাজের ছেলে আসে, নাম ফাইদ। মা তার সম্পর্কে শুধু একটাই কথা বলেছিল যে, ফাইদের পরিবার খুব গরিব। মা প্রায়ই ফাইদের বাড়িতে মিষ্টি আলু, ভাত এবং আমাদের পুরানো কাপড় পাঠাতো। আর আমি কখনো খাবার প্লেটে রেখে উঠে যেতে গেলেই মা বলতেন, ‘এক্ষুনি খাবার শেষ করো। দেখতে পাওনা ফাইদের মতো পরিবারগুলোর যে কিছু নেই?’ আমার ফাইদের পরিবারের জন্য প্রচুর করুণা হতো। তারপর এক শনিবার আমরা তার গ্রামে বেড়াতে যাই। এবং ফাইদের মা তার ভাইয়ের বানানো রঙ্গিন রাফিয়া দিয়ে তৈরি সুন্দর ডিজাইনের এক ঝুড়ি দেখান আমাদের। আমি চমকে উঠি। আমার কখনো মনেই হয় নি যে তার পরিবারের কেউ আসলে কিছু করতে পারে। আমি তাদের সম্পর্কে শুধু এটাই শুনেছি যে তারা কতটা গরিব। তাই তাদেরকে দরিদ্র ছাড়া অন্য কিছু হিসাবে কল্পনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দারিদ্র্য ছিল তাদের নিয়ে আমার জানা একমাত্র গল্প, একমাত্র ধারণা, একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গী।    

অনেক বছর পর ফাইদের গল্পটা আমার আবারও মনে পড়লো যখন আমি নাইজেরিয়া ছেড়ে আমেরিকার এক ভার্সিটিতে পড়তে আসি। আমি তখন ১৯ বছরের তরুনী। আমার মার্কিন রুমমেট তো আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর একেবারে হতভম্ব! জিজ্ঞেস করে বসেছিল, কোথা থেকে আমি এত ভালো ইংরেজি বলতে শিখেছি। তবে সে আরও জোরদার হতভম্ব হলো যখন জানতে পারলো নাইজেরিয়ার দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি। এরপর সে কৌতুহলবশত আমাদের ‘আদিবাসি গান’ শুনতে চাইলো। বেচারি আমি মারিয়া ক্যারের গানের ক্যাসেট  বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো তার ‘আদিবাসি গান’ শোনার বাসনায় আমি পানি ঢেলে দিয়েছি! এমনকি সে ভাবতো যে আমি বুঝি চুলাও জ্বালাতে জানি না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বহু আগেই আমার প্রতি তার ডিফল্ট প্রতিক্রিয়া ছিল করুণা, যদিও তা নেতিবাচক করুনা নয়, উদ্দেশ্য তার ভালোই ছিল। আমার রুমমেট আফ্রিকা সম্বন্ধে একটি গল্পই জানতো। আফ্রিকার বিপর্যয়ের গল্প। এই গল্পে আফ্রিকান কোনো মানুষের সঙ্গে তার মিল থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমার জন্যে করুণা ছাড়া অন্য কোন জটিল অনুভূতির জায়গা ছিল না তার। আমাকে তার সমানভাবে দেখারও কোন সম্ভাবনা ছিল না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আমি নিজেকে সেভাবে আফ্রিকান ভাবতাম না। কিন্তু সেখানে আফ্রিকার নাম এলেই মানুষ আমার দিকে ফিরে তাকাতো। আমি অবশ্য আমার এই নতুন পরিচয়টাকে আপন করে নিতে শিখেছি। আমি নিজেকে এখন আফ্রিকান বলেই মনে করি। যদিও আফ্রিকাকে দেশ বললে আমি এখনও বেশ বিরক্ত হই। একটা উদাহরণ দিই। দুইদিন আগে লাগোস থেকে ফেরার সময় ফ্লাইটে ‘ভারত, আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশের’ দাতব্যমূলক কাজের বর্ণনা দিচ্ছিল। 

তবে আফ্রিকান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বছর কাটানোর পর আমার প্রতি সেই রুমমেটের প্রতিক্রিয়া আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, আমি  যদি নাইজেরিয়ায় বেড়ে না উঠতাম, তবে আমিও ভাবতাম আফ্রিকা মানে সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা এক স্থান যেখানে সুন্দরসব প্রাণী আর অসংখ্য মানুষের বাস, যারা প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছে অর্থহীন যুদ্ধ, মরছে এইডস কিংবা দরিদ্রতায় ভুগে। নেই তাদের নিজেদের হয়ে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য। তারা তাই অপেক্ষা করছে কবে এক সহৃদয়, শ্বেতাঙ্গ বিদেশি ব্যক্তি এসে রক্ষা করবে তাদের। ছোটবেলায় নাইজেরিয়াতে না থাকলে আমি ফাইদের পরিবারকে যেভাবে দেখতাম, ঠিক সেভাবেই দেখতাম আফ্রিকানদেরও। আমার মনে হয় আফ্রিকানদের প্রতি এই একতরফা ধারণাটা এসেছে পশ্চিমা সাহিত্য থেকে। ১৫৬১ সালে পশ্চিম আফ্রিকা পাড়ি দেওয়া বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাবসায়ী জন লক ব্ল্যাক আফ্রিকানদের সম্বোধন করেছিলেন ‘গৃহহীন জানোয়ার’ হিসেবে। ‘মুণ্ডুহীন মানুষ, যাদের চোখ আর মুখ থাকে তাদের স্তনে/বুকে’, এভাবেই জন লক বর্ণনা করেছেন আফ্রিকানদের। জন লকের বর্ণনা আমি যতবার পড়ি, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। সত্যিই জন লকের কল্পনা করার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। এমন সব লেখা দিয়েই শুরু হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বে আফ্রিকান গল্পের চল। তাই সাব-সাহারান আফ্রিকাকে সকলে এক অদ্ভুত অন্ধকার জায়গা আর এর বাসিন্দাদের রুডইয়ার্ড কিপলিং এর ভাষায় ‘হাফ ডেভিল, হাফ চাইল্ড’ (অর্ধেক শয়তান আর অর্ধেক শিশু) হিসেবেই দেখতো। ফলে আমিও বুঝতে শুরু করলাম আমার সেই রুমমেটও বোধহয় সারাজীবন আফ্রিকানদের বিষয়ে এমন এক ধরনের গল্পই শুনে গেছে ভিন্ন আদলে কিংবা ভিন্ন আঙ্গিকে। শুধু আমার রুমমেট নয়, এমন এক গল্পের বিপত্তির স্বীকার হয়েছিলেন আমার এক প্রফেসরও। সেই প্রফেসর আমার উপন্যাস পড়ে বলেছিলেন তা নাকি ঠিক ‘খাঁটি আফ্রিকান’ উপন্যাস হয়নি। যদিও ‘খাঁটি আফ্রিকানত্ব’ কীভাবে অর্জন করা যায় বা ইহা যে আসলে কি জিনিস তাই আমার জানা ছিল না। শেষমেশ প্রফেসর জানালেন, আমার গল্পের চরিত্র নাকি এক সাধাসিধে, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত লোক, যিনি অনেকটা তার মতো। আমার চরিত্রদের নিজস্ব গাড়ি ছিল। তারা না খেতে পেয়ে মরছে না বলে নাকি তারা খাঁটি আফ্রিকান নন!   

তবে আমিও যে এই এক গল্পের বিপত্তিতে পড়িনি তা কিন্তু নয়। কয়েক বছর আগে আমি মেক্সিকো ঘুরতে যাই। তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল বেশ উত্তপ্ত, অভিবাসন নিয়ে চলছিল নানা তর্ক-বিতর্ক। আর তখন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর/অভিবাসনের মানেই ছিল মেক্সিকান। মেক্সিকানদের ঘিরে ছিল লুকিয়ে সীমান্ত পার করা, সীমান্ত পার করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার গল্প। আমার মনে আছে, প্রথমদিন মেক্সিকোর গুয়াদালাজারায় ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সেখানে মানুষ গতানুগতিকভাবে কাজে যাচ্ছে, বাজারে টর্টিলা তৈরি হচ্ছে, কেউ বা ধূমপান করছে, কেউ বা প্রাণখুলে হাসছে। তৎক্ষণাৎ এমন চিত্র দেখে কিছুটা অবাক হলেও, পরমুহূর্তেই আমি লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আমেরিকায় মেক্সিকান অভিবাসীদের ওপর মিডিয়া কাভারেজ দেখতে দেখতে আমিও তাদের শুধুমাত্র দুঃস্থ অভিবাসী হিসেবেই দেখা শুরু করেছিলাম। আমি নিজেও মেক্সিকানদের এক গল্পে, এক পরিচয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাই এভাবে শুধু এক গল্পের মাধ্যমে মানুষকে দেখলে, চিনলে আর এক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলো বারবার শুনতে থাকলে, সেই গল্পের বাইরে মানুষগুলোর অস্তিত্ব চিন্তা করা প্রায় কঠিন হয়ে যায়। এক গল্প সম্পর্কে কথা বলতে গেলে ক্ষমতার প্রসঙ্গ আসেই। একটা ইগবো শব্দ আছে ‘এনকালি’ (nkali) মোটাদাগে যার অর্থ ‘অন্যের চেয়ে মহৎ’। বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে ভাবতে গেলেই শব্দটি আমার মনে পড়ে। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুনিয়ার মতো, গল্পগুলাকে এনকালির নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায়। গল্প কে বলছে, কীভাবে বলছে, কখন বলছে, কতগুলি গল্প বলছে, সবকিছুই ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। ক্ষমতা শুধু অন্য ব্যক্তির গল্প বলে দেওয়ার ক্ষমতা না, একটি গল্পই ব্যক্তির চূড়ান্ত গল্প বলে প্রতিষ্ঠা করা। ফিলিস্তিনী কবি মুরিদ বারঘুতি লিখেছেন যে, আপনি যদি কাউকে অধিকারচ্যুত করতে চান, সহজতম উপায় হচ্ছে তাদের গল্প বলা এবং ‘দ্বিতীয়ত’ দিয়ে শুরু করা। 

ব্রিটিশদের আগমনের বদলে নেটিভ আমেরিকানদে তীর-ধনুক দিয়ে শুরু করুন, দেখবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর হারিয়ে যাওয়ার গল্পকে প্রতিস্থাপন করুণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় কলোনিগুলির ইতিহাস থেকে, পাবেন ভিন্ন স্বাদের গল্প।  

আমি সম্প্রতি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলতে গেছি। একজন শিক্ষার্থী আমাকে বলেন, নাইজেরিয়ার সকল পুরুষই যে শারীরিক নির্যাতনকারী তা জেনে সে খুবই হতাশ হয়েছে। কারণ আমার লেখা বইটির বাবা চরিত্রটি ছিল শারীরিক নির্যাতনকারী। তখন আমি তাকে বললাম, ‘আমি সবেমাত্র ‘আমেরিকান সাইকো’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। ‘সেই উপন্যাসের চরিত্রের মত আমেরিকার তরুনরাও সবাই সিরিয়াল কিলার সেটি জানতে পেরে আমিও বেশ হতাশ হলাম’ অবশ্যই কথাটি আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আর কিছুটা মজা করেই বলেছি। একটি মার্কিন উপন্যাসের চরিত্র সিরিয়াল কিলার ছিল বলে আমি নিশ্চয়ই সকল আমেরিকানকে সিরিয়াল কিলার ভাবছি না। এমন নয় যে আমি সেই শিক্ষার্থী থেকে ভালো মানুষ বলে আমেরিকানদের নিয়ে আমি এভাবে ভাবছি, বরং এক গল্প পড়েই আমেরিকানদের সিরিয়াল কিলার না ভাবার কারণ বিশ্বজুড়ে তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিস্তৃতি। আমি আমেরিকার আরও অনেক গল্প পড়েছি, পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তাই আমার তাদেরকে এক গল্প দিয়ে বিচার করতে হয়নি। আমি টাইলার আর আপডাইক যেমন পড়েছি, তেমনি পড়েছি স্টেইনব্যাক কিংবা গ্যাটস্কিল। আমেরিকা নিয়ে আমার একটি নয়, অনেক গল্পই জানা ছিল, একটি নয়। 

কয়ের বছর আগে আমি জানতে পারি শৈশব সুখের হলে নাকি সফল লেখক হওয়া যায় না! এরপর থেকে আমার বাবা-মা কীভাবে ছোটবেলায় আমার সঙ্গে কী কী বাজে ব্যবহার করেছে তার স্মৃতি খুড়তে শুরু করি। কিন্তু আদতে আমার ছেলেবেলা ছিল আমার ছোট্ট পরিবারের সঙ্গে খুব হাসিখুশি আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তবুও কঠিন সময় যে যায়নি তা কিন্তু নয়। শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন আমার দাদা মারা গেছিলেন। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাবে আমার চাচাতো ভাই পল মারা যান। আমার বন্ধু ওকোলামা মারা যায় প্লেন দূর্ঘটনায়। আমি যেই সামরিক সরকারের শাসনে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে শিক্ষার মূল্য ছিল না, প্রায়ই আমার বাবা-মা বেতন পেতো না।  হুট করেই কোন একদিন সকালে উঠে দেখতাম নাস্তার টেবিল থেকে জেলির বয়াম উধাও হয়ে গেছে। কোনদিন আবার হয়তো মার্জারিন উধাও হয়ে যেত, আস্তে আস্তে পাউরুটির দাম বাড়তে লাগলো, এরপর দুধ আগের মত যত ইচ্ছে খাওয়া যেত না, বুঝেশুনে নিতে হতো। আমাদের জীবনে খুব সাধারণভাবেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্থিরভাবে বিরাজমান ছিল। এই গল্পগুলোই আজ আমাকে আমি করে তুলেছে। কিন্তু শুধু এই অসুন্দর গল্পগুলো দিয়ে আমাকে বিচার করা যাবে না। এক গল্প খুব সহজেই স্টেরিওটাইপ তৈরি করে ফেলে। এই বাঁধাধরা কিংবা স্টেরিওটিপিকাল গল্পগুলো সত্য, তবে পুরোপুরি নয়। এক গল্পের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে যাওয়া মানে সেটাকেই একমাত্র গল্প বলে মেনে নেওয়া। কিন্তু তার বাইরেও যে অসংখ্য গল্প আছে।  

আফ্রিকাতে একের পর এক বিপর্যয় লেগেই ছিল, আছে, থাকবে। আফ্রিকা ঘিরে যেমন আছে দগদগে ক্ষত রেখে যাওয়া কঙ্গোর সেই ভয়ানক ধর্ষণের কাহিনী, তেমনি আছে নাইজেরিয়ায় একটি মাত্র চাকরির জন্য ৫০০০ মানুষ আবেদন করার মত হতাশাজনক কাহিনী। কিন্তু আফ্রিকা মানেই কী শুধু দুঃসংবাদ? বিপর্যয়ের গল্প ছাড়াও নিশ্চয়ই আফ্রিকার আরও গল্প আছে। আর সেগুলো নিয়েও কথা বলা সমান গুরুত্বপূর্ণ।    

আমি মনে করি কোনো জায়গা বা মানুষ সম্পর্কে তার সকল রকমের গল্প না শুনে সেই স্থান বা মানুষের সঙ্গে মেশা প্রায় অসম্ভব। আমার মনেহয় এক গল্প দিয়ে মানুষকে বিচার করা মানে তার মর্যাদা কেড়ে নেওয়া/ তার সম্মান কেড়ে নেওয়া। এক গল্প দিয়ে বিচার করলে আমরা তখন সেই মানুষটাকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখি না। সেই মানুষটার সঙ্গে আমার মিল খোঁজার বদলে সে কীভাবে আমার থেকে অন্যরকম সেদিকে আমাদের নজর চলে যায়। যদি আমি মেক্সিকোতে ঘুরতে যাওয়ার আগে আমেরিকা-মেক্সিকোর অভিবাসন দ্বন্দ্ব উভয় দিক থেকে পর্যবেক্ষন করতাম কিংবা যদি আমার মা ছোটবেলায় আমাকে বলতো ফাইদের পরিবার গরীব কিন্তু তারা কঠোর পরিশ্রমি কিংবা যদি থাকতো কোন আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে দেখানো হতো আফ্রিকার বিচিত্র সব গল্প, তাহলে হয়তো নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবের ভাষায় ‘গল্পের মাঝে সমতা’ খুঁজে পেতে আমাদের এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না। 

আমার সেই রুমমেট নাইজেরিয়া সম্পর্কে যদি  অন্য গল্পগুলো জানতো তবে আমায় দেখে হয়তো তার করুণা হতো না। সে যদি জানতো নাইজেরিয়ান প্রকাশক মুক্তা বাকারার কথা, যিনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে প্রকাশনী সংস্থা খুলে বসেন। তখন খুব প্রচলিত ছিল যে নাইজেরিয়ানরা তেমন পড়ুয়া নন, তাই সাহিত্য তাদের জন্য নয়। কিন্তু মুক্তা বাকারা বেঁকে বসেছিলেন। তিনি মনে করতেন হাতের কাছে নিয়ে গেলে আর সহজলভ্য করলে যাদের পড়ার তারা ঠিকই পড়বে। তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর আমি লাগোসে এক সাক্ষাৎকার দিতে যাই।  সেখানে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করা এক মহিলা এসে আমাকে বলেন, ‘আপনার উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু শেষটা ভালো লাগেনি। আপনার একটা সিক্যুয়েল লেখা উচিৎ যেখানে আপনি এসব জিনিস লিখবেন…’। এরপর তিনি বলতে লাগলেন কীভাবে সিক্যুয়েলটা লিখতে হবে। এ ব্যাপারটায় যে আমি শুধু মজা পেয়েছি তা না, আমি বেশ মুগ্ধও হয়েছি। এক সাধারণ নাইজেরিয়ান মহিলা, যার হয়তো বা আমার বইটা পড়ার কোনো কথাই ছিল না, সে আমার বইটা পড়ে আমি বইয়ের সিক্যুয়েলে কী লিখতে পারি তা নিয়েও নিজের মত জানিয়ে গেছেন। এভাবেই আমার রুমমেট যদি আরও জানতো আমার লাগোসের দুঃস্বাহসী বন্ধু ফুমি ওন্ডার কথা, নিজের টিভি শো’তে সে প্রতিনিয়ত এমন সব গল্প তুলে আনে যা আমরা ভুলে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদি সেই রুমমেট শুনতো জে-জি থেকে ফেলা, বব মার্লে থেকে তার আগেকার প্রজন্ম, সকলের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংরেজি, পিজিন, ইগবো, ইয়োরুবা আর ইজো ভাষায় গাওয়া নাইজেরিয়ার সমসাময়িক গানগুলো। যদি আমার রুমমেট জানতো সেই নাইজেরিয়ান মহিলা আইনজীবীর কথা, আদালতে নারীদের পুনরায় পাসপোর্ট করতে হলে যিনি স্বামীর সম্মতি নেওয়ার মতো হাস্যকর নাইজেরিয়ান আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিংবা যদি আমার রুমমেট জানতো নলিউড সম্পর্কে, যেখানে অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েও গুণীসব মানুষ বানিয়ে চলছেন অসাধারণ সিনেমা। যদি সে জানতো আমার হেয়ার ব্রেইডার কীভাবে নিজস্ব হেয়ার এক্সটেনশনের ব্যবসা শুরু করেছে কিংবা যদি জানতো আরও লাখ লাখ নাইজেরিয়ানদের গল্প যারা নিজ উদ্যোগে ব্যাবসা শুরু করে, ব্যর্থ হয়, কিন্তু তবুও হাল ছাড়ে না।  

আমি প্রতিবার বাড়িতে ফিরলেই নাইজেরিয়ানদের দেখি আমাদের ব্যর্থ সরকার, অবকাঠামো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে। কিন্তু এই ব্যর্থ সিস্টেমের মধ্যে থেকেও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত পৌঁছে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। আমি প্রতি বছর গ্রীষ্মে লাগোসে লেখালেখির ওপর একটা কর্মশালা নেই। সেই কর্মশালার প্রতি সকলের আগ্রহ দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবি, কত মানুষ গল্প লিখতে চায়, নিজের গল্পগুলো বলতে চায়। নাইজেরিয়ান সেই প্রকাশক আর আমার এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, নাম ফারাফিনা ট্রাস্ট। আমাদের স্বপ্ন হলো বিশাল বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করা, আর পুরোনো লাইব্রেরিগুলো সংস্কার করা। এছাড়াও যেসব সরকারি স্কুলের লাইব্রেরিতে কোনো বই নেই তাদের জন্য বই দেওয়া। আর নিজেদের গল্পগুলো বলতে যারা মুখিয়ে আছে তাদের জন্য বই পড়া ও লেখালেখির ওপর অসংখ্য অসংখ্য কর্মশালার আয়োজন করা। গল্প বলাটা খুব দরকার। আর অনেক ধরণের গল্প বলা আরও বেশি দরকার। কষ্ট, উৎখাত কিংবা অপমানের গল্প তো অনেক বলা হলো। গল্প যে দিতে পারে সাহস, ক্ষমতা আর জাগ্রত করতে পারে মনুষ্যত্বকেও। গল্পগুলো যেমন হতে পারে মানুষের সম্মান, মর্যাদা কেড়ে নেওয়া নিয়ে, তেমনি হতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরে পাওয়ার।   

আমেরিকান লেখক এ্যালিস ওয়াকার তার দক্ষিনের আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কের বলেছিলেন যারা উত্তরে চলে এসেছে।  দক্ষিনের জীবন-যাপন বিষয়ক একটি বইয়ে তাদেরকে হাজির করেছেন এ্যালিস। ‘তারা গোল হয়ে বসতো,  পরস্পরকে বই পড়ে শোনাতো, আমার বই পড়া শুনতো, এবং এক ধরণের স্বর্গ যেন সেখানে নেমে আসতো’। 

আমি কথা শেষ করার আগে শুধু এটি বলবোঃ একটামাত্র গল্প প্রত্যাখ্যান করলে, যখন আমরা বুঝতে পারি যে কোনো স্থান নিয়ে একটামাত্র গল্প কোনোকালেই ছিল না, আমরা এক ধরণের স্বর্গ খুঁজে পাই। ধন্যবাদ। 

[ বর্তমান লেখাটি ২০০৬ সালে চিমামান্দার ‘ডেঞ্জার অফ ওয়ান স্টোরি’ শীর্ষক টেড টক- এর বঙ্গানুবাদ। সেমসেমের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাবিহা শারমিন ইভা।]

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন