হোয়াইট সুপ্রিমেসি ও ক্যাপিটালিজম যেভাবে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে প্রভাবিত করে

হ্যালো, আমার নাম জেসিকা ডিফিনো। আমি একজন বিউটি রিপোর্টার আর আমার উদ্দেশ্য হলো বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করা।  

একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল মনে হয়। তবে আমি যে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করতে চাই তা সত্যি। আর সেই প্রচেষ্টায় আমি টিন ভোগ-এর জন্য নতুন মাসিক কলাম ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যুজ’ লিখছি।   

আমার মতে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে, বা বলা যায় সারা বিশ্বে, যত সমস্যা আছে তার মূলে রয়েছে বিউটি স্ট্যান্ডার্ড। এই বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ধরে সেক্সিজম, বর্ণবাদ, শ্রেণীবাদ, বয়সবাদ, প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্য এবং জেন্ডার ভিত্তিক অসমতাকে জোরাল করা হয়েছে। আমাদের সমাজে এই অবাস্তব স্ট্যান্ডার্ডগুলো তৈরি করে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এই স্ট্যান্ডার্ডগুলোই আমাদের উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, ডিসমরফিয়া, ইটিং ডিসঅর্ডার এবং আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভূমিকা রাখে। এমনকি ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ কথাটা শুনলেই আমার বিরক্ত লাগে।  

মানে, ভাবুন তো, সৌন্দর্যের মতো অপরিমেয়, বায়বীয়, আবেগগত অথচ প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা একটি কনসেপ্টকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডে সীমাবদ্ধ করার কথা? কেন? কী কারণে? কার জন্য?         

এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ কী সেটা নির্ধারণ করতে হবে। বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হলো আদর্শ  মেয়েলি সৌন্দর্যের যোগ্যতা যা নারীয়া ব্যক্তিগত এবং পেশাগত পর্যায়ে সফল হওয়ার জন্য পূরণ করবে বলে আশা করা হয়। (‘নারী’ এবং ‘মেয়েলি’ শব্দগুলি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে কারণ বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বাইনারির উপর ভিত্তি করে বানানো – যা পিতৃতন্ত্রকে সমর্থন করে এবং নারী, পুরুষ ও নন বাইনারি ব্যক্তিদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু সে আলাপ অন্য একটি কলামের জন্য।) এই যোগ্যতাগুলো প্রতিনিয়ত ফিল্ম, টেলিভিশন, সাহিত্য, ম্যাগাজিন, স্কুল সিস্টেম, চিকিৎসা ব্যবস্থা, রাজনীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সোশ্যাল মিডিয়া, আইন এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রদর্শন করা হচ্ছে। মনে হয় যেন আমাদের ব্রেইনওয়াশ করা হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীদের যুক্তি অনুসারে, সমাজ আমাদেরকে যা সুন্দর বলে তা থেকে আমরা স্বতন্ত্রভাবে যা সুন্দর বলে মনে করি তা আলাদা করা অসম্ভব।       

‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ আর ‘আদর্শ মেয়েলি সৌন্দর্য’ উভয়ই চলমান নিশানা। এগুলো সময়ের সাথে সাথে এবং এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে পশ্চিমা উপনিবেশের  বদৌলতে  ইউরোসেন্ট্রিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ডই বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের মান হয়ে উঠেছে। নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন ‘দ্য বিউটিওয়েল’ প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা, আমিরা আদাওয়ে টিন ভোগকে বলেন, ‘আফ্রিকায় আমার গবেষণার সময় আমি কসমেটিক ডিলারদের সাক্ষাৎকার নিই। তাদের মতে, আফ্রিকা এবং এশিয়া পশ্চিমাদের অনুসরণ করে থাকে। আমরা এখন আমেরিকায় যে বিউটি ট্রেন্ডগুলো দেখছি তিন বছরের মধ্যে তা আফ্রিকা এবং এশিয়ায় পৌঁছে যাবে।’ পশ্চিমা বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হলো ক্যাপিটালিস্ট, কলোনিয়ালিস্ট, পুরুষতান্ত্রিক, সাদা আধিপত্যবাদী সমাজের পণ্য, যা তৈরি হয়েছে আমাদেরকে গ্রাস করে রাখার জন্য।    

নাওমি উলফ তার বই দ্য বিউটি মিথ -এ লিখেছেন, ‘বিউটি মিথের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো ঐতিহাসিক বা জৈবিক ব্যাখ্যা নেই।’  তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সমাজের আদর্শগুলো যে সঙ্গী নির্বাচনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া থেকে এসেছে তারও কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি নৃবিজ্ঞানীরা। 

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কালচারাল স্টাডিজের লেকচারার ড. হান্নাহ ম্যাকক্যান একমত জানিয়ে লেখেন, ‘যারা বলে যে সৌন্দর্য্যের সর্বজনীন আদর্শ আছে যা সবধরণের সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে যায় তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ যে সৌন্দর্যের এই আদর্শগুলো বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে।’  

সৌন্দর্যের কনসেপ্ট আমাদের মধ্যে সবসয়ই উপস্থিত ছিল – কিন্তু শুরুর দিকে সৌন্দর্যের ব্যাপারটা শারীরিক সম্পর্কে কম এবং আত্মার সাথে বেশি সম্পৃক্ত ছিল। সৌন্দর্যবিদ Władysław Tatarkiewicz বিশ্লেষণ করেন যে গ্রেকো-রোমানরা সৌন্দর্যকে কীভাবে ঐশ্বরিক এবং ভালোর সাথে সংযুক্ত করত। প্রাচীন মিশরীয় সৌন্দর্যেরও একটি আধ্যাত্মিক গুণ ছিল। মেকআপ তখন সাজসজ্জার এমন একটি রূপ ছিল যা দেবতাদের অনুকরণ এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করা হতো।  

মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের উত্থানের পর থেকে সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সংযোগ যেন হারিয়ে যেতে শুরু করে। মার্ক টুংগেট তার বই ব্র্যান্ডেড বিউটি-তে লিখেছেন, ‘[নারীদের] উৎসাহিত করা হয়েছিল পবিত্র এবং কুমারী দেখাতে, যেন তারা চির-তরুণী!    

স্বর্ণকেশী, নীল নয়না এবং ফর্সা ত্বককে মানা হতো ‘ঈশ্বরের জ্যোতি’র মতো সুন্দরের প্রতীক হিসেবে।  অ্যাডাওয়ের মতে, ‘১৫ শতকের দিকে কলোনাইজাররা আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় গিয়ে এই ধারণা প্রচার করে যে সাদা হওয়াই ভাল, সাদার চেয়ে সুন্দর আর কিছুই না। শুধুমাত্র সাদারাই অর্থনৈতিকভাবে ভালো ছিল, তাদের ভালো চাকরি আর শিক্ষা অর্জন ছিল।’  

চামড়ার রঙের সঙ্গে সমাজে শ্রেণী নির্ধারণের বিষয়টা জড়িত ছিল। প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমান সমাজে হালকা গায়ের রঙের মানুষদের উচ্চ শ্রেণীর অন্তর্গত করা হতো। কারণ হিসেবে টুঙ্গেট লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই ফর্সা চামড়ার একজন মহিলা ব্রোঞ্জ রঙের শ্রমিকের থেকে আলাদা জীবনযাপন করেছে।’  কিন্তু কলোনাইজাররা এই ধারণাটাকে সমস্ত জাতির মধ্যে প্রয়োগ করে।      

অ্যাডাওয়ে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের সময় এই একই ধারণা অনুসরণ করা হয়েছিল। যারা কালো রঙের ছিল তারা বাইরে মাঠে কাজ করত। আর যাদের গায়ের রঙ ফর্সা ছিল, তারা বাড়িতে কাজ করত। ফর্সা ত্বকের মানুষেরা সুন্দর বলে বিবেচিত হতো আর এই ধারণাটি এখনও আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন যে কলোনাইজাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেলেও, দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, এই ধারণাটা রয়ে যায়। ‘কলোনাইজাররা চলে গেলেও তারা একটি উত্তরাধিকার রেখে গেছে: সাদাচামড়ার উত্তরাধিকার। এটি আমাদের মানসিকতার একটি চলমান উপনিবেশ।’  

উপনিবেশি এই মানসিকতা আজও টিকে আছে। এই মানসিকতা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতায় প্রতিফলিত হয় যেখানে দেখা যায় প্রতিটি মুখ প্রায় একচেটিয়াভাবে সাদা। এমনকি মেকআপ ইন্ডাস্ট্রিতে ইনক্লুসিভ শেডস যোগ করার উপর ফোকাস থাকা সত্ত্বেও গায়ের সাদা রঙের জন্য ১০ ধরনের ফাউন্ডেশন শেড পাওয়া যায় আর কালো গায়ের রঙের জন্য মাত্র দুই ধরনের।  এই একই অবস্থা কসমেটিক কর্পোরেশনগুলোর, যারা এশিয়ায় গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্রিম বিক্রি করছে — যদিও সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে এখন এই পণ্যগুলোর নাম কম বর্ণবাদী। 

অলঙ্করণঃ ঈহা

  

ক্যাপিটালিজমকে এভাবেই উপনিবেশ দারুণ এক ব্যবসায়িক মডেল উপহার দিয়েছে: এটি দেখিয়ে দিল, সারাজীবন অন্যের কাছে নিকৃষ্ট বোধ করা থেকে জন্মানো হীনমন্যতা থেকে মুক্তি লাভ করা কতটা সহজ। এভাবেই ইতিহাস জুড়ে কলোনিয়ালিজম আমাদের সবার মধ্যে হীনমন্যতা বীজ বপন করে গেছে। আমাদের দেহ সম্পর্কে আমরা যা বিশ্বাস করি তার বেশিরভাগই মার্কেটিং-এর ফলাফল, যা বিউটি ব্র্যান্ডগুলো শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করে থাকে।   

লেখক লিন্ডি উডহেড ওয়ার পেইন্ট বইয়ে কসমেটিক উদ্যোক্তা হেলেনা রুবেনস্টাইনের কর্মজীবন ডকুমেন্ট করেন। লিন্ডি লিখেন, ‘তিনিই প্রথম সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ যিনি ১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে ত্বককে ‘শুষ্ক,’ ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘তৈলাক্ত’ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন এবং এই শ্রেণীবিভাগগুলোকে ব্যবহার করে তার ফেস ক্রিম ‘ভেলেজ’ বিক্রি করেছিলেন।  তখনই নারীরা তাদের ত্বকের স্বাভাবিক দিক যেমন বলিরেখা, দাগ, তৈলাক্ত ভাব, মৃত কোষ ইত্যাদি লক্ষ্য করতে শুরু করে এবং এগুলো ঠিক করার জন্য ক্রিম কিনতে শুরু করে।   

ঠিক একইভাব বর্তমান সময়ে চুলের যত্নের জন্য একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নয় বরং —সারপ্রাইজ! –পরামর্শ দেয় একজন মার্কেটার। ১৯৩৮ সালে লরিয়ালের প্রতিষ্ঠাতা ইউজিন শ্যুলার যখন এই ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু বের করেছিলেন, তখন তিনি একটি স্ট্যান্ডার্ড চালু করেছিলেন। টুঙ্গেটের ভাষ্যমতে ইউজিন শ্যুলার বলেন, ‘ফ্রান্সে ৪৩ মিলিয়ন মানুষ আছে। যদি এই ৪৩ মিলিয়ন মানুষ সপ্তাহে একবারও তাদের চুল ধোয়, তাহলে আমরা বর্তমানে বিক্রি করা ইউনিটের ২০ গুণ বিক্রি করব।’    

শ্যুলারের মার্কেটিং পদ্ধতি ছিল: ‘লোকদের বলুন তারা নোংরা, তাদের থেকে দুর্গন্ধ বের হয় আর তারা আকর্ষণীয় নয়।’  তবে এগুলো বলতে হবে খুব নম্রভাবে। মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশরের উপর ভিত্তি করেই বিউটি মার্কেটিং-এর গঠন। আর এই পদ্ধতি শুধুমাত্র পণ্য বিক্রির জন্য নয়, পিতৃতন্ত্র বজায় রাখার জন্যও আদর্শ।    

উলফ দ্য বিউটি মিথ-এ লিখেছেন, ‘নারীরা পুরুষের সংস্কৃতিতে নিছক ‘সুন্দরী’ যাতে সংস্কৃতিকে পুরুষ শাসিত রাখা যায়।’  তিনি যুক্তি দেন যে, নারীবাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ‘নারীদের অগ্রগতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র’  হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আর ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে যখন নারীবাদী আন্দোলন চলছিল ঠিক সেই সময়ে নারীদের চেহারার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। নারীবাদীদের বার্তাকে দুর্বল করার জন্য তাদেরকে ‘কুৎসিত’ হিসাবে স্টেরিওটাইপ করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে মহিলাদের ম্যাগাজিনে ডায়েট নিয়ে আর্টিকেলের সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে, জেরক্স একজন মহিলার ওজনের উপর ভিত্তি করে চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছিল। ১৯৬০ এবং ৭০ এর দশক জুড়ে আদালত ধারাবাহিকভাবে নারী কর্মচারীদের উপর চেহারার উপর ভিত্তি করে নীতি প্রয়োগ করেছে।  রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আইনগতভাবে একটাই বার্তা ছিল: বাইরের জগতে এবং কর্মক্ষেত্রে, উভয়ক্ষেত্রে  নারীদের মূল্য তাদের সৌন্দর্যের সমান।      

‘দেখতে সুন্দর লাগা’ কর্মজীবী নারীদের জন্য দ্বিতীয় জব হয়ে উঠেছিল — কিন্তু সৌন্দর্য কিছুক্ষেত্রে তাদের কর্মজীবনকে অগ্রসর করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জন্য বাধা হয়ে রেনি এবেগেল, পিএইচডি, মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, তার বিউটি সিক বইয়ে লেখেন, ‘আমরা সৌন্দর্যের জন্য ব্যয় করা সময় এবং অর্থের মধ্যে জেন্ডাররের ব্যবধান বিবেচনা করি না। কিন্তু সময় আর অর্থের মূল্য আছে। এগুলো হচ্ছে শক্তি, ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার প্রধান উৎস।’ 

বিউটি ইন্ডাস্ট্রি সৌন্দর্যের সাধনাকে ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন হিসেবে রিব্র্যান্ডিং করে। যেমন ধরুন, ল’ওরিয়ালের বিখ্যাত স্লোগানটি  Because, I’m worth it, যা ১৯৭৩ সালে একজন পুরুষ কপিরাইটার দ্বারা লেখা হয়। টুঙ্গেট লিখেন, ‘এটা সেই সময়ের জন্য একটা আদর্শ অনুভূতি ছিল যখন নারীরা সমতার দাবি করছিল।’  ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বড় পরিবর্তন আসে: অন্যের জন্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করা থেকে নিজের জন্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে চাওয়ার পরিবর্তন। এবেগেল যেমন বলেছেন, ‘আমরা এক সংস্কৃতি থেকে সরে—যেখানে আপনার শরীরকে পর্যবেক্ষণ করা হতো—এমন আরেক সংস্কৃতিতে এসেছি যেখানে আপনিই আপনার নিজের শরীরের পর্যবেক্ষক।’  অথবা লেখক গ্লেনন ডয়েল যেমন বলেছেন, ‘নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো নারীদের নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাজি করানো।’     

আজ ‘আত্ম-ক্ষমতায়নের’ বার্তা নারীবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি বিকশিত হচ্ছে — কিন্তু ক্ষমতায়নের সকল মার্কেটিং হীনমন্যতাকে কেন্দ্র করেই হয়। (কর্পোরেশনগুলো ভোক্তাদের পণ্যের মাধ্যমে তখনই  ‘ক্ষমতায়ন’ করতে পারবে যখন ভোক্তারা পণ্য ছাড়া ক্ষমতাহীন হবে।) এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো Dove-এর রিয়াল বিউটির জন্য ২০০৪ সালের ক্যাম্পেইন, যেখানে মডেলদের পরিবর্তে সাধারণ নারীরা অংশগ্রহণ করে। টুঙ্গেটের মতে, যদিও এই সিরিজটি বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বিউটি মিডিয়া এবং ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছে, প্রাথমিক বিজ্ঞাপনের সাথে যে পণ্য জড়িত ছিল তা একটি স্কিন-ফার্মিং ক্রিম ছিল যা সেলুলাইট কমানোর দাবি করে।       

বলা দরকার যে, ত্বকে সেলুলাইট হওয়া প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর সত্যিটা আমাদের শরীরে যা যা পরিবর্তন করতে বলা হয় তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা আমাদের ত্বককে ফর্সা বা কালো করার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের চুলের রঙ আর গঠন পরিবর্তন করি। আমরা বার্ধক্যকে থামাতে এবং  উল্টামুখী করতে চেষ্টা করি।  আমরা আমাদের পেট ও বাহু থেকে চর্বি নিয়ে সেটা স্তন এবং নিতম্বে যোগ করি। আমরা আমাদের পা এবং বগল থেকে চুল সরিয়ে সেগুলো আমাদের চোখের পাপড়ির জন্য ব্যবহার করি এবং আমাদের ভ্রুর হাড়ে উপর ট্যাটু করি।    

আমরা যে সৌন্দর্যকে আদর্শ বলে বিশ্বাস করি তা অর্জন করা শারীরিকভাবে অসম্ভব, তাই এর পেছনে যে সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে হয় তার কোনো শেষ নেই।

২০১৮ সালের টক্সিক বিউটির ডকুমেন্টারিয়ান ফিলিস এলিস টিন ভোগ-কে বলেন, ‘মূল উদ্দেশ্য হলো সবসময় পণ্য বিক্রি করা। যদি আমরা মনে করি বিউটি ইন্ডাস্ট্রি অন্য কিছু সম্পর্কে, এটা আমাদের ভুল ধারণা। কিন্তু সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষকে লজ্জিত করার ব্যাপারে আমি সংবেদনশীল এবং সচেতন। এটা মাস্কারা পরার জন্য কাউকে খারাপ বোধ করানোর বিষয় মাত্র না। বরং আমি যা জানতে বেশি আগ্রহী তা হচ্ছে কেন।’  

এই ‘কেন’-কে আমি প্রতি মাসে বিশ্লেষণ করব ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যুজ’-এ, যেখানে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের পচা শিকড়গুলোকে খুঁজে বের করে ছিঁড়ে ফেলা হবে আর ভালো কিছু পুনর্নির্মাণ করা হবে।   

এমন এক ইন্ডাস্ট্রি যা ক্ষমতায়ন বেচার করার নামে ইনসিকিউরিটির শিকার করে না।

সৌন্দর্যের এমন এক সংজ্ঞা যা পিতৃতন্ত্রের সংজ্ঞার সাথে সুবিধাজনকভাবে মিল রাখে না। 

এমন এক বিশ্ব যেখানে ব্ল্যাক বিউটি ব্র্যান্ডের হেডলাইন তৈরি করার জন্য কালো বর্ণের নারী ও পুরুষদের হত্যা করা লাগে না।  

আমি বিশ্বাস করি, বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ধ্বংস করা হচ্ছে মুক্তি, সমতা এবং সুস্থতার কাজ। নিজের ও  কমিউনিটির যত্ন নেওয়া। এটা আধ্যাত্মিক। রাজনৈতিক। অপরিহার্য। কারণ যখন বিউটি স্ট্যান্ডার্ড বদলাবে, তখন বিশ্বও বদলাবে।

[ ভোগ-এ প্রথম প্রকাশিত এই লেখাটি সেমসেম-এর জন্য অনুবাদ করেছেন ফাবিহা জাবিন]   

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন