সেমসেম সেরা ৭ বাংলা ছোটগল্প 

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণ: সামিউল

 
[ বাংলা ভাষার অজস্র ছোটগল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠতাভিত্তিক কোনো ক্রম তৈরি করা আদৌ এই তালিকার উদ্দেশ্য না। বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের ইতিহাসমোটামুটি দুইশ বছরের। এই দুইশ বছরে বিষয় ও প্রকরণে এত বিচিত্র ও অসাধারণ সব গল্প লিখিত হয়েছে এই ভাষায়, যে তা মাত্র সাতটায় নামিয়ে আনা অসম্ভবই। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, অসংখ্য চমৎকার লেখক ও ছোটগল্প বাদ থেকেই যাবে। তাও, তালিকা বানানোর দস্তুরমত ‘সেরা’ অভিধাটা শিরোনামে ব্যবহার করতেই হলো। পাঠক বুঝে নেবেন যে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই ভাষাটাকে আরো সমৃদ্ধকারী কিছু লেখক ও তাদের লেখাপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াসন্ধানী পাঠকের জন্য এই তালিকাটা তাদের পাঠের কেবল শুরুয়াত হবে, সেই আশায়।     
    

এছাড়া প্রচ্ছন্ন একটা থিমকে কেন্দ্র করে তালিকায় গল্পগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত সাতটি গল্পেই দেখা যাবে প্রধান চরিত্র বা প্রটাগনিস্টরা প্রান্তজন। ‘চোখ’ গল্পের প্রধান চরিত্র, যার বয়ানে গল্পটা আমরা শুনি, একজন ডাকাত। তিনি ধরা পড়েছেন, মানুষ তার কী ভয়াবহ বিচার করবে তা দেখার অপেক্ষায় বসে আছেন। ‘পাদটীকা’ গল্পটা আমাদের বলে সর্বগ্রাসী উপনিবেশের কবলে বিলুপ্তির মুখে আমাদের নিজস্ব এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা। কিংবা শহীদুল জহিরের ‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ গল্পে আমরা দেখতে পাই এই প্রচণ্ড কর্মব্যস্ত দুনিয়ায় একজন জাত অকর্মণ্য অলসের কী দশা হতে পারে।    
আমরা মনে করি, ভালো গল্পের ‘স্পয়লার’ বলতে কিছু হয় না। একটা গল্প কেবল ঘটনাপরম্পরা দিয়ে তৈরি হয় না, কোনো টুইস্টের উপরেও নির্ভরশীল হয় না। তাও, গল্পগুলো প্রধান চমক বাতলে না দিয়ে যতটুকু বর্ণনা পাঠককে আগ্রহী করতে পারবে ততটুকুই খোলাসা করে বলার চেষ্টা করেছি। এবার একটু পড়ে দেখুন, নিজের পছন্দের কোনো গল্প খুঁজে পেয়ে গদগদ হতে পারেন কিনা। বা কোন অসাধারণ লেখককে নজরআন্দাজ করে যাওয়ার অপরাধে রাগও ঝাড়তে পারেন। পাঠকের যা মর্জি।  —-সেমসেম ডেস্ক]  

চোখ | হুমায়ূন আহমেদ | ১৯৯৪

‘নয়ন কখন তুলবেন?’
এরকম আপাত সরল কিন্তু বিস্ফোরক বাক্য শুধু বাংলা না, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। ছোটগল্পে হুমায়ূন আহমেদের ওস্তাদি উপন্যাসের চেয়েও বেশি। খুব অল্প পরিসরে, অল্প কথায় চরিত্রায়ন ও হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে গভীর মানবিক দিকগুলো আপাত হাস্যরসের পোশাকে উঠে আসে। একজন ডাকাত বসে বসে অপেক্ষা করছে কখন তার চোখ তোলা হবে। তাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী। আছরের পর তার চোখ তোলা হবে। বেশ একটা উৎসবের আবহ তৈরি হয়েছে গোটা গ্রাম জুড়ে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও হাজির হচ্ছেন একে একে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলা হবে। এমন ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটে না। কেউ এই দৃশ্য মিস করতে চায় না। নিতসের মতে, মানুষের সকল উৎসবের গভীরে একপ্রকার নৃশংসতা লুকানো থাকে। এই গল্পে খেলাচ্ছলে যেভাবে নিষ্ঠুরতাকে উদযাপন করতে দেখা যায় তা সেই উক্তিরই সম্প্রসারণ। ‘গ্রামের মানুষ খুব সহজ-সরল, নিষ্পাপ হয়’ এ-জাতীয় মুখস্থ ধারণা পোষণকারীরা এ গল্পের সামনে এসে একটা ধাক্কা খাবেন। মানুষ একমাত্রিক না; মানুষ জটিল, বহুমাত্রিক। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এ কথা বারবার প্রমাণিত হয়। আর যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই মতি ডাকাত নির্লিপ্তভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে তাকে ঘিরে ধরা উন্মত্ত জনতাকে, বোঝার চেষ্টা করে মবের মতিগতি। সে বোঝার চেষ্টা করে আসলেই তার চোখ তুলে ফেলা হবে কিনা। তাকে ধরে এনেছে যেই হাসান আলী, সে রসিয়ে সবার কাছে নিজের বীরত্বের গল্প করে শোনায়। গল্পে প্রতিবার নতুন শাখা-প্রশাখা যুক্ত হতে থাকে। মতি নিজেই সে গল্প আগ্রহ নিয়ে শোনে। যে গল্পের উপজীব্য, সে-ই শ্রোতা হয়ে উঠছে।  রোমন্থন করতে চোখ লাগে না, তাই সে স্মৃতি হাতড়ায়। ডাকাতের জীবনে ভালোবাসা কীভাবে আসে, আবার কীভাবে চলে যায়? ঘোর ভেঙে সে দেখে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, যেই ইদরিস আলী তার চোখ তুলবে সে তার দিকে তাকাচ্ছেও না। মানুষের চোখে সে জন্তু হয়ে ওঠে। সে ভয় পায়। তার চোখ কি আসলেই তুলে ফেলা হবে? সে জানে নিষ্ঠুরতার মত মানুষের মনে মমতাও জাগে অকস্মাৎ, অচিন উৎস থেকে। সে অপেক্ষা করে সেখানে কারো মধ্যে মমতা জাগার।  
চোখ গল্পটি পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের ‘এই আমি’ গ্রন্থে।    

কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায় | শহীদুল জহির  

শহীদুল জহিরের গল্পের প্লট ধরে আলোচনা করা মুশকিল। কারণ তার গল্পের মূল মজা গল্পটা বলার কায়দায়। কেবল ভঙ্গিমার জোরে নিতান্ত স্বাভাবিক একটা কাহিনিকেও জহির মনোহর করে তুলতে পারেন। তার কৌতূহলজাগানিয়া লেখার সিগনেচার স্টাইল, চাপা উইট সবই ধরা টের পাওয়া যাবে এই গল্পে।   

গল্পটা ফৈজুদ্দিন ওরফে ফজুকে কেন্দ্র করে। সে একজন দরিদ্র কৃষক। তার মত আর দশটা ভূমিহীন কৃষকের মত সেও রোগা, টিঙটিঙা। ব্যতিক্রম হলো, সে একজন পিপুফিশু, অর্থাৎ অলস। এবং অলস বলেই একটু দার্শনিক গোছের। স্বাভাবিক। আলস্যযাপী না হলে চিন্তা করার ফুরসৎ কীভাবেই বা পাওয়া যাবে? বউ তাকে কাজ করতে তাগাদা দিলে সে বলে, কাজ করে তো তার আর জমিদার হওয়া হবে না, লাভ কী? তাই সে ভিটার সামনে একটা বিচিকলা ঝোপের পাশে একটা বাঁশের মাচান বানিয়ে তাতে শুয়ে থাকে, আকাশ দেখে, ভাবে। তার এই আলস্যের ক্ষতিপূরণ করে তার স্ত্রী গুলনেহার। সে সুহাসিনী গ্রামের মিঞাবাড়ির আবদুল কাদের মিঞার বাড়িতে কাজ করে। এই বৃদ্ধ আবদুল কাদের মিঞা আবার ফজুর পৈতৃক জমি আত্মসাৎ করে বসে আছে। তবু তাকে মেনেই চলতে হয় ফজুর। তার সাথে হাঁটতে বের হয় মাঝেমাঝে। ফজুকে এমন নির্ভার, স্বস্তিতে কর্মহীন দেখে তার বিরক্ত লাগে। এমনকি ভয় হয় ফজুর অকর্মণ্যতা সংক্রামিত হয়ে তার মধ্যেও ঢুকে পড়ে কিনা। সে অকারণেই ফজুকে খাটাতে চায়, যেভাবেই পারে। অন্যদিকে তার বাসায় যে কাজ করে গুলনেহার, তার দিকে ক্রমেই তার বদনজর ঘনিয়ে উঠতে থাকে। ওদিকে বেহাত জমি নিয়ে ফজু ও কাদের মিঞার তর্কাতর্কি। প্রাণের সংশয়। মালিকবর্গের সাথে ফজুর মত ভূমিহীন কৃষকবর্গের বিজয় কী করে হতে পারে? তারপর, জহিরীয় কায়দায় পুনরাবৃত্তি। আবর্তিত হতে হতে ঘটনার চূড়ান্তির দিকে ধেয়ে যাওয়া।     

উৎসব | আখতারুজ্জামান ইলিয়াস | ১৯৭৬ 

ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর– এর দ্বিতীয় গল্প।  ইলিয়াস ছিলেন প্রখর শ্রেণি ও রাজনীতি সচেতন লেখক। তার প্রথম গল্পগ্রন্থেই সেই শ্রেণি-সচেতনতার প্রকাশ পেয়েছে। বড়লোক বন্ধুর বৌ-ভাতের দাওয়াত খাওয়ার পর ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরেন আনোয়ার আলি। ধানমণ্ডির ঝলমলে, আলিশান বাড়ি থেকে ফিরে সে মুখোমুখি হয় নিজ পাড়ার নোংরা গলির। এমনিতে তো এইখানেই সে থাকে, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ারই কথা এতদিনে। কিন্তু ধানমণ্ডির সেই প্রাসাদের সুখস্মৃতির বিপরীতে নিজের এই বিশ্রী বাসস্থান তার মনে বিরক্তি জাগায়। কোথায় ধানমণ্ডির প্রশস্ত ঝকঝকে রাস্তা, আর কোথায় তার বাড়ির এই ঘুপচি গলি যার প্রবেশমুখেই নালা-নর্দমায় গু ভাসতে দেখা যায়! সেসব এলাকার সুরুচিপূর্ণ, তন্বী রূপসীদের তুলনায় তার হোঁৎকা গেঁয়ো স্ত্রী’র দিকে তো তাকানোই যায় না। এমনকি ধনীদের কুকুরেরাও শ্রদ্ধার দাবিদার তার কাছে। সে বলে, ‘কুকুর কি আর ওদিকে নেই? ওদিকেও আছে। বিয়ে বাড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। কি গম্ভীর তাঁর মুখ, কি তাঁর চেহারা!’ একদম চন্দ্রবিন্দু সমেত, ‘তাঁর’। কী সশ্রদ্ধ সম্বোধন!    
বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে ধনী, সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। প্রতিমুহূর্তে সে তাদের সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করে। বন্ধুদের সুন্দরী স্ত্রী’দের সাথে কথা বলতে বেগ পেতে থাকে। খুব স্বাভাবিক কথাও মাথার মধ্যে হাজারবার সাজিয়েও বলে উঠতে পারে না সে। এবং এসবের মধ্যেই সে ভালোমত দেখে নিতে থাকে তাদের শরীর। স্মৃতিতে ছাপিয়ে নিতে থাকে। পরে, রাতে, কাজে দেবে। কিন্তু রাতে ঘরে ফেরার পর, এলাকার জঘন্য পরিবেশ, চারপাশের অশ্লীল গান-বাজনা, নিজের পরিবার সবকিছুর উপর বিতৃষ্ণ হয়ে কিছুতেই নিজের স্ত্রী’র প্রতি মনকে জাগাতে পারেন না আনোয়ার আলি। স্মৃতি হাতড়ে ধানমণ্ডির রূপসীদেরকেও স্মরণে আনতে পারেন না একদম। শেষমেষ যা হয়, তা একমাত্র ইলিয়াসের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব।

তৃতীয় পুরুষের বয়ানে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই গল্পে আনোয়ার আলির মগজে ঢুঁ মেরে মেরে আপাত-গড়পড়তা একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের অভাবনীয় ভাঁজ খুলে দেখান। মধ্যবিত্তের জীবনের অবদমন, হীনম্মন্যতা ও আত্মঘৃণার স্বরূপ কী অভাবনীয় রূপে পেশ করা যায়, তারই এক চমৎকার নজির এই গল্প।  

পাদটীকা | সৈয়দ মুজতবা আলী | ১৯৫২ 

মুজতবা আলীর বিখ্যাত চাচা কাহিনী গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত।  সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বভাবসুলভ বৈঠকি ভঙ্গির গল্প। হাস্যরসে চলতে চলতে গল্পের একদম শেষ লাইনে এসে পাঠককে চমকে দেওয়া এক গভীর দুঃখবোধ। গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। 

এই হলো গল্পের শুরুর লাইন। গত শতক বলতে উনিশ শতক, এই শতক বলতে বিশ শতক। সুরসিক সৈয়দ মুজতবা আলী যে মড়কের কথা বললেন, তা শারীরিক কোনো রোগ নয়। রাজনৈতিক রোগ! 

ইংরেজ আমলের আগে উপমহাদেশে যে মোগল যুগ ছিলো, তাতে মুসলিমরা শিক্ষা নিত মক্তবে, হিন্দুরা টোলে। ইংরেজ আমলে ইংরেজি স্কুলে শিক্ষার যে জয়জয়কার, তার কারণ স্পষ্ট। ওটা শিখেই তো দুটো করে খাওয়া যাবে! তাই পণ্ডিতমশাইদের অবস্থা মড়ক লাগার মতোই। যারা গেছেন তো গেছেন, যারা আছেন, স্কুলে এক্কেবারে পেটেভাতে আছেন। 

এই গল্পেও একজন পণ্ডিতমশাই আছেন। আর লেখক এখানে নাম ভূমিকায়, পণ্ডিতমশাইয়ের প্রিয় ছাত্রদের একজন। হুট করে স্কুলে খবর এল, লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। কী সর্বনেশে কথা! হেডমাস্টার সাহেবের খিটখিটে মেজাজে তখন ছাত্র-শিক্ষক সবার অবস্থা ভাজাভাজা! আর যেদিন লাটসাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন, আলী সাহেবের ভাষায়, ‘হেডমাস্টার ইস্কুলের সর্বত্র চড়কিবাজীর মতন তুর্কি-নাচন নাচছেন। যেদিকে তাকাই সে দিকেই হেডমাস্টার। নিশ্চয়ই তাঁর অনেকগুলো যমজ ভাই আছেন, আর ইস্কুল সামলাবার জন্য সেদিন সব কজনকে রিকুইজিশন করে নিয়ে এসেছেন।’

গল্পের এই পণ্ডিতমশাই বাংলা সাহিত্যিপ্রেমীদের মনে অক্ষয় হয়ে থাকবেন কয়েকটা কারণে। তার একটিও পণ্ডিতমশাইয়ের সংস্কৃতিতে দক্ষতার জন্য নয়। প্রথম কারণটা হলো উর্ধাঙ্গে বস্ত্রে অনভ্যস্ততা। এখন লাটসাহেব মানী মানুষ, তার সামনে তো খালি গায়ে থাকা যায় না! অতএব পণ্ডিতমশাই হলুদ গেঞ্জি কিনলেন, যেহেতু শাস্ত্র অনুযায়ী তাকে সেলাই ছাড়া জামা পরতে হবে। অনভ্যস্ততার ফোঁটা যেমন কপালে চড়চড় করে, পণ্ডিতমশাইয়েরও তাই হলো। এরমাঝেই লাটসাহেব আসলেন, পণ্ডিতমশাইয়ের গায়ে গেঞ্জি পরার চুলকুনি হলো, লাটসাহেব হালকা নড করায় পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভাবোল্লাস হলো, ঘটনাপ্রবাহে আরও অনেককিছুই হলো। ভাবগতিকে মনে হচ্ছিলো লাটসাহেবের সাথে পণ্ডিতমশাইয়ের সাক্ষাতই এই গল্পের মূল আলোচ্য। 

কিন্তু দিনদুয়েক পর পণ্ডিতমশাই নিয়ে আসলেন এক্কেবারে নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে। কোথায় কোন ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছেন লাটসাহেবের নানা গল্প, লাটসাহেবের কুকুরের গল্প। হ্যাঁ, লাটসাহেবের কুকুরও ছিল একটা। তিনঠ্যাঙে কুকুর। পণ্ডিতমশাই হুট করেই তার প্রিয় ছাত্রকে আঁক কষতে দিলেন একটা। আলী সাহেবের ভাষায় আবার যাওয়া যাক, ‘‘বেশ বেশ! তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?’

আমি ভয় করছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’

তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?’

আমি হতবাক। 

‘বল না।’

আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দে।’

শুধু সেদিন না, এই সময়ে এসেও যেন পণ্ডিতমশাইরা হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দে!

পুরো জাতি তখন থাকে নিস্তব্ধ, ঠিক সেদিনের সেই ক্লাসরুমটার মতো। 

প্রাগৈতিহাসিক | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৯৩৭ 

‘অতসী মামী’ গল্পের মাধ্যমে সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদার্পণ ঘটলেও “সিরিয়াস সাহিত্যিক” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটার দ্বারাই। নামেই আভাস পাওয়া যায়, মানিক এই গল্পে ডিল করতে চাচ্ছেন মানুষের ভিতরকার আদিম এক অন্ধকার নিয়ে। অন্ধকার শব্দটা মানিকের খুব প্রিয়। এই অন্ধকারেরই মূর্তায়ন হলো গল্পটার প্রধান চরিত্র ভিখু। খুনাখুনি, ডাকাতি, রক্তপাত কোনোকিছুতেই ভিখুর হাত কাঁপে না। কাঁপে না কারণ, যেকোনো মূল্যে সে টিকে থাকতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকার জন্যে যদি এসবই করতে হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। এই বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন কাঁধে দগদগে ঘা নিয়ে, পলাতক অবস্থায় বনের গহীনে জোঁক-মশা-শেয়ালের উৎপাতেও সে মরতে রাজি হয় না। ‘মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে বাঁচিবেই।’ 

অথচ যার সাহায্যে এই টিকে থাকা তার জন্য সহজ হয়, তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতেও তার কোনো সমস্যা হয় না। তারপর সে পালিয়ে বেড়ায়। রোগে শীর্ণ এক বাহুকে পুঁজি করে ভিক্ষুক হিসেবে সে নতুন জীবন শুরু করে অপর এক অঞ্চলে। বিনয়ই ভিক্ষুকের ভূষণ। ফলে ভিক্ষা কম পেলে, বা পথচারীর কোনো আচরণে তাদেরকে গালি দেয়ার, বা তাদের উপর হামলে পড়ার ইচ্ছা অনেক কষ্ট করে দমন করে সে। এমন সময় দেখা হয় পাঁচীর সাথে। একই পথের মুসাফির তারা। পাঁচীর পায়ে একটা ঘা। সেটা সারানো দুঃসাধ্য কিছু না, কিন্তু এই ঘায়ের বদৌলতেই ভিক্ষুক হিসেবে তার আয়টা হয়। তাই এই ঘা’টাকেই সে পরম যত্নে লালন করে, জিইয়ে রাখে। ভিখু এই পাঁচীর সাথে খাতির জমাতে যায়, চায় তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। তারপর, সেই প্রাগৈতিহাসিক দ্বন্দ্ব: যৌন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যুদ্ধ, যেকোনো একজনের বিজয় ও অপরজনের মৃত্যু, এবং বিজয়ীর নারীলাভ। কিন্তু, যেই ভিখু এত হিংস্র, এত মারমুখী, তার মনে কি কোমলতারও কোনো জায়গা আছে? সে কি ভালোবাসতেও পারে? এমন একটা প্রশ্ন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঝুলিয়ে দেন আমাদের সামনে। যেভাবে পাঁচী নিজের শরীরের ক্ষতের কারণে লাভবান হয়, ফলে তা সারাতেও চায় না, একইভাবে হয়তো সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই কিছু মানুষ নিজেদের অন্তরের ক্ষত, বা মানিকের ভাষায়, তাদের ভিতরকার অন্ধকারকে জিইয়ে রাখে, লালন করতে থাকে। এবং, সময়মত, উত্তরাধিকারে পাওয়া এই অন্ধকার সে চালান করে দেয় পরের প্রজন্মে। 

টোপ | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় | ১৯৪৫

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সিরিয়াস সাহিত্য ও সরস সাহিত্যের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। অত্যন্ত রসিক, উইটি এই লেখকের অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘টোপ’। শুরুতে হাল্কা খেলাচ্ছলে ও হাস্যরসপূর্ণ ভঙ্গিতে গল্পটা বলা হতে থাকে, কিন্তু আস্তে-আস্তে অসাধারণ ধৈর্য ও নৈপুণ্যের সাথে গল্পটার ভেতরকার অন্ধকার প্রকাশিত হয় পাঠকের নজরে।   

কাহিনীর শুরু কথকের দুয়ারে বাঘের চামড়ার একজোড়া জুতা হাজির হওয়ার মধ্য দিয়ে। জুতাজোড়া পাঠিয়েছেন রাজাবাহাদুর। কে এই রাজাবাহাদুর? অতীতচারণ করে সে গল্পই বলতে শুরু করে কথক। রামগড় জমিদারি এস্টেটের মালিক এন. আর. চৌধুরী তথা রাজাবাহাদুরের সাথে পরিচয় হয় গল্পের কথকের, যিনি একজন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও কবি। রাজাবাহাদুরের সম্মানে তিনি একটা প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে দেন। ফলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক বলতে, রাজা ও প্রজার মধ্যে যে সম্পর্ক আরকি। সে যাই হোক, একজন জমিদারের সাথে খাতির জমানোর সুযোগ পেয়ে গল্পের কথকও খুশিই হন। ঘটনাক্রমে একসময় জমিদারের তরফ থেকে একসাথে শিকারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সব কাজকর্ম ফেলে তিনি রওনা দেন। একটা আলিশান রোলস রয়েস গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বনমধ্যে জমিদারের বিরাট বাংলোতে। সেখানে গোসল, খানাপিনা শেষে রাজাবাহাদুর নিজের আগ্নেয়াস্ত্রের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ কথককে দেখিয়ে গর্ব করেন, খানিকটা টিটকারিও মারেন। এরপরেই আসে শিকারের পালা। এই শিকার তো আসলে তার পৌরুষ ও সাহসিকতারই দাম্ভিক প্রদর্শন। কিন্তু দেখা যায়, তিনি গাড়ির মধ্যে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে গুলি করেই ঘায়েল করতে থাকেন পশু-পাখি। বড় কোনো শিকার না পেয়ে তিরিক্ষি মেজাজে দু-একটা বনমুরগিই মেরে ফেলেন তিনি। এবং সে মুরগি তিনি ঘরেও তোলেন না। অর্থাৎ, এই শিকার থেকে তার পাওয়ার কিছুই নেই, কেবল নিজের বিক্রম প্রকাশের, একটা কিছু মেরে ফেলার আনন্দ ছাড়া। 

কিছুদিন পর কথক নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলেও রাজাবাহাদুর তাকে নিজের বীরত্বের সম্পূর্ণ পরিসরটুকু না দেখিয়ে ছাড়বেন না। হুকুমের সুরে বলেন আরেক রাত থেকে যেতে। সেই রাতে বিশাল এক টোপ দিয়ে রাজাবাহাদুর একটা মাছ ধরবেন বলে জানানো হয়। কপিকল দিয়ে সেই টোপ নিচে এক নদীর ধারে নামানো হয় আর তখনই ভয়াল গর্জনে লাফ দিয়ে ওঠে একটা বাঘ, আর সাথে-সাথে এক গুলিতে তাকে ঘায়েল করে ফেলেন রাজাবাহাদুর। তিনি যে বীরোত্তম বীর, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। মাছটা তাহলে বাঘ, সেটা বোঝা গেল। কিন্তু টোপটা কী ছিল? এর উত্তরে আমাদের সামনে যা উন্মোচিত হয় তাতে এক পলকে গল্পের মোড় ঘুরে যায়। সামন্তবর্গের স্বেচ্ছাচার, নিপীড়নের এক অমোঘ নজির হয়ে দাঁড়ায় গল্পটা। 

আত্মজা ও করবী গাছ | হাসান আজিজুল হক | ১৯৬৭

হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও করবী গাছ সে সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল। সেই গ্রন্থের নামগল্পই আমাদের আলোচ্য। গল্পটির মূল পটভূমি হলো দেশভাগের পরবর্তী প্রান্তিক মানুষের জীবন। হাসান আজিজুল হক নিজে একবার বলেছিলেন, ‘দেশ ভাগ আমার জীবনের জন্য একটা ক্ষতস্বরূপ। ক্ষত সারলেও দাগ থেকে যায়। আমি এই দাগের অনুধাবন করার চেষ্টা করছি।’ এই গল্পটিও যেন সেই ক্ষত থেকেই উৎসারিত। এক বৃদ্ধ পিতা ও উচ্ছন্নে যাওয়া তিন ছেলের কথোপকথনের মধ্যে আনাগোনার মাধ্যমে আগাতে থাকে গল্পটা। পরিপার্শ্বের বিভিন্ন খুঁটিনাটির অপরূপ বর্ণনা ও আবহনির্মাণে এমনই এক মায়ার চাদর ঝুলিয়ে দেন চোখের সামনে, যে গল্পটার অভ্যন্তরীণ নির্মম বাস্তবতাটা টের পেতে একটু সময়ই লেগে যায় আমাদের। মূলত, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে বাস করছেন গল্পের বৃদ্ধ সেই পিতা। এমন অবস্থায় নিজের ও পরিবারের পেট চালানোর জন্য নিজের কন্যাকে উপজীব্য করে যেভাবে তিনি নিজের ও পরিবারের পেট চালান এবং তার ফলে সেই বৃদ্ধের মধ্যে জন্ম নেয়া অসহায় এক আত্মগ্লানিকে এত অদ্ভুতভাবে তুলে ধরেছেন হাসান আজিজুল হক যে অবাক হতে হয়। ক্রোধের বদলে ততক্ষণে জায়গা করে নিয়েছে একটা অক্ষম আত্মবিনাশী আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিন তিনি একটা করবীগাছে পানি দিয়ে সেটাকে বড় করে তুলছেন, আদতে যা নিজের মৃত্যুরই আয়োজন। গোটা গল্প যে অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যাওয়া হতে থাকে, যে ক্রোধ ও কান্না ঘনীভূত হয়ে জমে ছিল এতক্ষণ, শেষ বাক্যে এসে সবটুকু যেন একদম ফেটে পড়ে — এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি? 

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন