ডেভিড গ্রেবার ও তার সাহসী আশাবাদ 

রেবেকা সোলনিট
লেখক
Syed Farhad
সৈয়দ ফরহাদ
কবি ও গায়ক
অলঙ্করণ: সামিউল ইসলাম

ডেভিড গ্রেবার হাসিখুশি আর আমুদে মানুষ ছিলেন। মতাদর্শের লড়াইয়ে, তার সকল সম্ভাবনার উত্তাপ নিয়েই, তিনি ছিলেন বাকপটু আর কৌতূহলী। সেই শূন্য দশকের শুরুতে, নিউ হ্যাভেনে, কিংবা ২০২০ সালে তার মৃত্যুর বছর কয়েক আগেও লন্ডনে, যতবারই দেখেছি, তিনি ছিলেন সেই একই রকম। দীপ্তিময়, ঝাঁঝালো এক ক্লান্তিহীন প্রাণ। দেখে মনে হয়েছিল, তার মাথায় যেন সর্বক্ষণ বয়ে চলেছে চিন্তার ঝড়, শব্দগুলো যেন ছুটছে, উপচে পড়ছে, বরাবরের মতোই এক অপ্রতিরোধ্য প্রাচুর্যে। একজন ভাল শ্রোতা হিসেবেও এক্টিভিস্ট সার্কেলে তিনি সম্মানিত ছিলেন এবং তিনি যে কী ভীষণভাবে সমতায় বিশ্বাস করতেন এটা চারপাশের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখেই বোঝা যেত।   

তিনি ছিলেন আগাগোড়া একজন নৃতাত্ত্বিক। মাদাগাস্কারের পরম্পরা-ঘেষা মানুষদের মাঝে মাঠপর্যায়ে কাজ করার পর, তিনি কখনোই থেমে যাননি। বরং নিজের সমাজের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। নৃবিজ্ঞানীর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তার ‘ডেড জোনস অব দি ইম্যাজিনেশন: অন ভায়োলেন্স, ব্যুরোক্রেসি, অ্যান্ড ইন্টারপ্রেটিভ লেবার’ এর মতো প্রবন্ধে এবং বুলশিট জবস এর মতো গ্রন্থে তিনি এমন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন যেগুলোকে সাধারণত বোরিং হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কখনো বা সেসব বিষয় থেকে যায় উপেক্ষিত। ২০১১ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘ডেট’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে অর্থ এবং আর্থিক ব্যবস্থা কল্যাণের জন্য পুনর্গঠিত হতে পারে।    

তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, শিল্পোন্নত ইউরো-আমেরিকান সভ্যতা আর দশটা সভ্যতার অতীত কিংবা বর্তমানের মতোই, কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত একটা দশা মাত্র। তিনি সেই সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন যখন সমাজগুলো কৃষি বা প্রযুক্তি বা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যখন সামাজিক গোষ্ঠীগুলি এমন কিছু বেছে নিয়েছিল, যেগুলো প্রায়ই ‘আদিম’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়। আদতে সমাজগুলো ছিল আরও মুক্ত। তিনি সেইসব বয়ানকেও প্রত্যাখান করেছিলেন, যেইসব বয়ান দাবি করে মানুষের আদিম সরলতা হ্রাস পাচ্ছে কিংবা আদিম বর্বরতা থেকে মানুষের মুক্তি ঘটছে ইত্যাদি। তার বদলে তিনি বহু বৈচিত্রের এক সমাজের কথা বলছেন, সমাজকে দেখেছেন এক চলমান নিরীক্ষা হিসেবে আর মানুষকে দেখেছেন সীমাহীন সৃজনশীল হিসেবে। এই বৈচিত্রই ছিল তার আশার উৎস, তার একগুঁয়েমির ভিত্তি, যে কারণে তিনি মনে করতেন- সবকিছু এভাবে আর চলতে পারেনা।    

মার্কাস রেডিকার যেমন, ডেভিডের একটি বই- পাইরেট এনলাইটেনমেন্ট– এর পর্যালোচনাতে লিখেছেন, ‘গ্রেবার যা যা লিখেছেন তা একই সাথে বর্তমানের কুলজি, একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ কেমন হতে পারে তার একটি বিবরণ।’ জেন্ডার বৈষম্য এবং সমাজের অপরাপর বৈষম্যসহ, সব ধরণের বৈষম্য নিয়েই তিনি ভাবতেন। যে সহিংসতা, অসমতা এবং পরাধীনতাকে উসকে দেয়, সেগুলো কিভাবে সমাজে বৈধতা হারাতে পারে আর কখন এ থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারে তিনি সেসব নিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এক কথায়, তার সাধনার মূলে ছিল স্বাধীনতা; এবং তা অর্জনে প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে বের করা।   

কখনো কখনো তাকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের ‘আমরাই ৯৯ পারসেন্ট’ স্লোগানটির জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু কোন কৃতিত্বের দাবিদার না হয়ে তিনি বরং নিজেকে ওই ৯৯ শতাংশের একজন মনে করতেন। তবে স্লোগানটি এতোই প্রভাব বিস্তার করে যে আজও ১ শতাংশ এলিটদের বোঝাতে বাক্যটি ব্যবহৃত হয়। ‘৯৯ পারসেন্ট’ আজ এক আশার বাক্য। সমাজের বিত্তবান শ্রেণির বিপরীতে শ্রমিক ও মধ্যবিত্তকে ওই এক শব্দবন্ধেই আজ গ্রেপ্তার করা যায়। আর এটি একটি দাবিও, যা নিয়ে আমরা সকলে সোচ্চার। বিশেষ করে যারা রুটি-রুজির সংগ্রাম করছে, রুটি-রুজির সংস্থান যাদের অনিশ্চিত তাদের তো এই বিপুল বিত্তের মালিকদের বিরুদ্ধে একজোট হবার যথেষ্ট কারণ আছে।      

ডেভিড তার কাজে যেমন আনন্দ খুঁজে পেতেন, তেমনি বহু আন্দোলনের সঙ্গে তার কাজ ছিল প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ১৯৯০ এর দশকের শেষ দিকে কর্পোরেট বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই আন্দোলনের জেরে ১৯৯৯ সালের সিয়াটলের ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশন মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সের আয়োজন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ১৯৯৪ সালে মেক্সিকোর জাপাতিস্তা অভ্যুত্থান, আর ২০১১ সালের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে তো তিনি সরাসরিই যুক্ত ছিলেন।   

নিজের ধারণাগুলোর বাস্তবায়ন কিংবা তার নানা দিক উন্মোচনের মধ্য দিয়েই তো এমন আনন্দ খুঁজে নেওয়া উচিৎ। ডেভিড অন্তত তাই মনে করতেন। ডেভিডের ভাষায়, ‘দুনিয়ার এক অমোঘ সত্য হলো, সত্য আমরা নিজেরাই নির্মাণ করি, এমনকি ভিন্ন ভিন্নভাবে নির্মাণ করি।’     

এখন আপনি যদি বিশ্বাস করেন, আপনার প্রস্তাবিত ধারণায় ভিন্ন ভিন্ন পূর্বানুমান আর মূল্যবোধের দুনিয়া হাজির আছে তবে পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল আপনি হাতে-নাতে পাবেন। আর তা হবে পুরোনো অনুমান আর মূল্যবোধ পালটে গিয়ে।  

আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এই ধারণাগুলোই আমাদের অস্ত্র। ডেভিড এই অস্ত্রগুলোই সবার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। অথবা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেগুলো আমাদের সঙ্গেই আছে। আর এ কারণেই, একটি সহজবোধ্য লেখার স্টাইল গড়ে তুলতে তিনি তার সমস্ত শ্রম ব্যয় করেছেন। তাতে সফলও হয়েছেন। তবে এই পথটুকু যে সবসময় সহজ ছিল তা কিন্তু নয়। 

আমাদের দুজনেরই বন্ধু, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এবং ঋণ ব্যবস্থা বিলোপ আন্দোলনের কর্মী আস্ট্রা টেইলর তাকে একবার টেক্সট করেছিলেন, ‘ডেট’ বইটি আবার পড়ছি। আপনি সত্যিই দুর্দান্ত লেখক। বামপন্থীদের মধ্যে এই দক্ষতা বিরল।’ সেই আগস্টে, তার মৃত্যুর এক মাস আগে ডেভিড উত্তর দিয়েছিলেন: ‘সত্যি বলতে ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কিছু নেই আমার! এই কাজটি বেশ যত্ন নিয়ে করি, এই যা। আমি বরং এটাকে ‘পাঠকের প্রতি সদয় থাকা’ হিসেবে ধরে নিই। এটা আমার রাজনীতিরই অংশ।’   

মতাদর্শের লড়াইয়ে, তার সকল সম্ভাবনার উত্তাপ নিয়েই, গ্রেবার ছিলেন বাকপটু আর কৌতূহলী
অলঙ্করণ: রিসাদ

জবরদস্তিমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মানুষ নিজেদেরকে শাসন করতে পারে। এই বিশ্বাস সমুন্নত রেখেই অ্যানারকিস্টদের সাধারণ জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। ডেভিড গ্রেবারও তাই রেখেছিলেন। হান্না আরেন্ট সম্পর্কে একবার লিন্ডসে স্টোনব্রিঞ্জ যেমন লিখেছিলেন- ‘তার ব্যতিক্রমী মনের ওপর মনোযোগ দেওয়ার মানে হলো তার চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ মিস করে যাওয়া। চিন্তা নিয়ে তার পাঠ হলো- চিন্তা সহজাত। আর এটাই চিন্তার শক্তি।’ একই কথা ডেভিডের বেলায়ও প্রযোজ্য।         

প্রতিভা ও মৌলিকতা, এই দুটোই তার ছিল। তারপরও তার একাডেমিক ক্যারিয়ার একেবারেই মসৃণ ছিলনা। হতে পারে, তা না হওয়ার কারণ ওই দুটো বিষয়। তার যে বইটি আমি প্রথম পড়েছিলাম, ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যান্থ্রপলজি’, ছোট্ট একটি বই। কিন্তু বড় বড় আইডিয়া দিয়ে ঠাসা। তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমেরিকায় খোঁজ করলেই গন্ডায় গন্ডায় মার্ক্সবাদী একাডেমিশিয়ান পাওয়া যায়, কিন্তু তেরো জন একাডেমিশিয়ানও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যারা নিজেদের অন্তত অ্যানার্কিস্ট বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার মানে, মার্ক্সবাদের সাথে একাডেমির যে সখ্য আছে, সেটা অ্যানার্কিজম কখনোই গড়ে তুলতে পারবে না। যদিও দিনশেষে, এটা ছিল একমাত্র সামাজিক আন্দোলন যার শুরুটা একজন একাডেমিক স্কলারের হাত ধরেই। পরবর্তীতে এটি শ্রমিক শ্রেণীকে জড়ো করার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।’ মার্ক্সবাদের সঙ্গে তুলনা করে তিনি যুক্তি দেন যে, অ্যানার্কিজম আদতে তা ছিল না, বরং এটার শুরু কিছু বুদ্ধিজীবীর নেতৃত্বে। বরং তার ভাষায়, ‘অ্যানার্কিজমের মৌলিক নীতিগুলিগুলো হলো –স্বতস্ফুর্ত ভাবে গড়ে ওঠা সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পারস্পরিক সহায়তা, এইসব’, যেগুলো কিনা সহজাতভাবেই, যতদিন ধরে দুনিয়ায় ‘মানবতা আছে’ ততদিন ধরেই আছে।   

একজন একডেমিশিয়ান এবং একটিভিস্ট হিসেবে ডেভিড যে কথা বার বার বলে গেছেন, তা হলো-  ‘সবকিছু আর এইভাবে চলতে পারেনা।’ যেখানে একাডেয়য়ার লোকজন দুনিয়া বদলানোর কর্মকান্ড থেকে প্রায়শই একটা শীতল আর নিরাপদ দূরত্ব রাখতে চান, সেখানে তিনি এই কাজের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী আর আন্তরিক। তিনি দেখতে চাইতেন আইডিয়া কাজে  পরিণত হয়ে দুনিয়া বদলে দিচ্ছে। টেইলর উল্লেখ করেছেন, ‘একদিকে তিনি একাডেমিক ব্যুরোক্রেসির ঢিলেমি ঘৃণা করতেন, আবার অন্যদিকে একটিভিস্টদের সঙ্গে আড্ডা, তাদের সঙ্গে নানান আদর্শিক তর্কে অংশ নেওয়া উপভোগ করতেন। পছন্দ করতেন তাদের সঙ্গে নানা পরিকল্পনা আর খুনসুটিতে মেতে থাকতে।’        

তিনি আশাবাদী ছিলেন, তবে অবশ্যই সেটা বাছবিচারহীনভাবে নয়। বরং যে সাক্ষী-সাবুদ তিনি সংগ্রহ করেছেন সমাজ থেকে, তাতে তিনি দেখেছেন যে মানব সমাজ এ যাবৎ নানা চেহারায় হাজির হয়েছে। ফলে তিনি মনে করতেন, আজ যাদের ক্ষমতাহীন বলা হচ্ছে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেই ক্ষমতায়িত হতে পারে। আর ঠিক এখানেই দরকার আইডিয়া।  

ডেভিড তার ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপোলজি’  বইতে মাদাগাস্কারের সাকালাভা জনগোষ্ঠীর একটি আচারের কথা উল্লেখ করেছিলেন; যেখানে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত রাজাদের সম্মান জানায়। তবে এই রাজাদের মনোবাসনা প্রকাশিত হয় ‘এক আধ্যাত্মিক মধ্যস্ততাকারীর মাধ্যমে, যারা আবার অনভিজাত সাধারণ বয়স্ক নারী।’ অর্থাৎ, আচার অনুষ্ঠানটি অভিজাত বংশের পুরুষদের দিয়ে পরিচালিত হলেও, তা আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অনভিজাত নারীদের দ্বারা।    

বুদ্ধিজীবী ও এক্টিভিস্টদের জন্য আশা জিনিসটা খুব গোলমেলে। অন্যদিকে হতাশাবাদ মানবপ্রকৃতি এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনার বিরোধী হলেও এটাকে বেশ বাস্তবধর্মী বলে মনে করা হয়। সাধারণত দুনিয়ার যা পরিস্থিতি তা দেখলে হতাশাকেই বাস্তবসম্মত মনে হয়, আশাবাদকে মনে হয় বালখিল্যতা। যদিও এর উল্টোটা মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে। আশা ব্যাপারটা রিস্কি। আশা করে আপনি হারতে পারেন, হেরেও থাকেন প্রায়শই, কিন্তু রেকর্ড ট্র্যাক করলে দেখা যাবে, চেষ্টা করলে কিছু কিছু সময় আপনি জিতেও যান।    

তার ‘ডেস্পায়ার ফ্যাটিগ’ নামের প্রবন্ধটা শুরু হয় এরকম লাইন দিয়ে: ‘নিরাশা ব্যাপারটাকে কি বোরিং লাগা সম্ভব?’ ডেভিডের অসম্ভব শক্তির জায়গা এটাই ছিল যে তিনি আউটসাইডারের মতো করে ভাবতেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত স্বতঃসিদ্ধগুলোকে ঠিক ধরে নিয়ে তারপর এগুতেন না, বরং প্রশ্ন করতেন, ‘এই জিনিসটা যদি মেনে না নেই তাহলে কী হতে পারে?’ যদি এই জিনিসটার আদি ও অন্ত খুঁজি, প্রভাব বিশ্লেষণ করি, খারিজ করি, এপিঠ ওপিঠ নেড়েচেড়ে দেখি, তাহলে আসলে আমরা কী পেতে পারি? এমনও তো হতে পারে এভাবে মিলে গেল মুক্তির পথ! 

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন