সুভাষণের অন্দর-বাহির

KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি

সমাজে সমস্ত প্রকার বৈষম্য সহনীয় করে তুলতে  ভাষাগত ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরী। 

এই ভাষা হয় সুভাষণ (ইউফেমিজম) আর কোমলতায় গড়া। নকল অলঙ্কারে ঝলমল করতে থাকে ভাষার শরীর। তাকাইলে চোখে ধাঁধা লাগে। আর তাই সতর্ক না হইলে সেই ধাঁধাঁ-লাগা চোখে সত্যিগুলা ধরাই পড়ে না। 

কারণ ভাষা প্রকাশ করে না শুধু, গোপনও করে। শুধু সংযুক্ত নয় বিযুক্তও করে।  

কনফুসিয়াসের নামে একটা কাহিনী চালু আছে। কনফুসিয়াসরে একবার জিগানো হইলো যে, তিনি পৃথিবীর সম্রাট হইলে কোন কাজটা প্রথমে করতেন? উনি কইছিলেন, তার প্রথম কাজ হবে ভাষারে বদলায়ে ফেলা।   

কনফুসিয়াস ভাষারে বদলানোর সুযোগ  না পাইলেও আধুনিক যুগে আইসা অধিপতি শ্রেণির হাতে ভাষারে অনেকাংশে গড়েপিটে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

জর্জ ওরয়েলের  সেই  ‘১৯৮৪’ বইটার কথা মনে পড়বে আমাদের  যেইখানে নিউস্পিক বা নয়াজবান চালু হইছিল। সব ভালো কথা কইতে হবে। নেগেটিভ কিচ্ছু বলা যাবে না। ফলে ভাষার এমন বাস্তবতা তৈরি করতে হবে যাতে শ্রেণী-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না।  

সুশীল সমাজ টিভি মিডিয়া পত্রিকার কলামিস্ট সেই নয়াজবানের খেদমতগার। কেউ জ্ঞানত, কেউ অজ্ঞানত। যে লোক প্রকৃতপক্ষে, ‘লেবার’ বা যে বদলা খাটে/ কামলা খাটে তারে মর্যাদাপূর্ণ ‘শ্রমিক’ নামে ডাকা হয়। বাসার যে কাজের বুয়া, কাজের মাইয়া/ ছেমড়ি/ছেড়ি তার জন্যও সুন্দর-মার্জিত এবং ‘তৎসমায়িত’ নাম বরাদ্দ করা হইছে: গৃহপরিচারিকা। ‘গার্মেন্সে কাম’  যারা করে তাদেরও মহিমান্বিত নাম ‘পোষাকশ্রমিক’।       

সুভাষণ কী? 

সোনার বাংলায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের ক্ষেত্রে অলিখিত তরিকা হইলো, লেখার শিরোনামের মূলশব্দটা নিয়া  প্যাচাল পারা, ত্যানা প্যাচানো। যেমন, ধরেন, ক্যাকটাস নিয়ে লিখতে গিয়ে  আদিতে গ্রীকভাষায় শব্দটার মানে কী ছিলো?  ‘অন্ডকোষ। এইবারে শব্দটা ভাঙো, কোন্‌ অংশের কী অর্থ, সবমিলে কী দাঁড়াইল…  এইসব ইনায়ে- বিনায়ে লিখতে হবে কমসে কম এক পৃষ্ঠা। তারপর আলোচ্য বিষয়ে বিখ্যাত লোকেদের কয়েকটা বানী এস্তেমাল করা। 

সেই রাস্তা ফলো করা যাক, কিন্তু সংক্ষেপে।                

সুভাষণ বাংলা প্রতিশব্দটা  (সুভাষন) নিজেই  সুভাষণের একটা উদাহরণ। ইংরেজি ‘ইউফেমিজম’ শব্দটার গোড়া গ্রীক। অর্থ:  ‘যে কথা শুনতে ভালো লাগে’। সুভাষিত করে বললে, ‘শ্রুতিমধুর বচন’। 

ভাষাচার্য  সুকুমার সেন, সুভাষণ পরিচয় দিছেন এইভাবে:  

অকল্যাণসূচক অথবা নিন্দিত বা কুৎসিত  অর্থকে কল্যাণসূচকরূপে বা ভদ্রভাবে প্রকাশ করিবার জন্য সুভাষণ (Euphemism) অলঙ্কারের আশ্রয় লওয়া হয়।

বিখ্যাত একটা ডিকশনারি অনুযায়ী,‘অস্বস্তিকর বা বিব্রতকর কোনো বিষয়ে বলতে, যেমন, মৃত্যু ও সেক্স,  লোকে যে শিষ্ট শব্দ কিংবা অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তা-ই সুভাষণ।‘  

সুভাষণ উপরের সংজ্ঞা দুইটার চাইতে বিস্তৃত হইলেও এতেই আপাতত আমাদের কাজ চলবে। উদাহরণ: ‘মরা’র পরিবর্তে সুভাষণ ‘শেষনিশ্বাস ত্যাগ করা’।   

কি চমৎকার দেখা গেল! 

ক্ষমতা-আধিপত্য ভাষার উপর দাপট চালাইতে থাকে। ভাষারে খাটায়ে নেয় তারা। শতভাগ  সফল অবশ্য হয় না। ভাষার ভেতরে কিছু ‘টির‍্যানি’  বা স্বৈরাচারী দিক আছে বইলা  লুদভিগ হ্বিটগেনস্টাইন মন্তব্য করছিলেন তার নোটবুকে। 

যাহোক, সেই দাপটের বিষয়ে আসা যাক। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া, বিবিসি, সিএনএন, ফক্স এইসব মিডিয়া যেগুলোতে, বঙ্গীয় সুশীলের নিরঙ্কুশ আস্থা, তারাই, আফ্রিকায় দাঙ্গাটাংগা হলে, নাম দেয় ‘ট্রাইবাল কনফ্লিক্ট’ আর  ইউরোপের আশেপাশে ঘটলে নাম হয় ‘এথনিক ক্লিনজিং’। ফলে জোসেফ কনরাডের ১৮৯৭ সালের গল্প, ‘অ্যান আউটপোস্ট অফ প্রগ্রেস’ –এ দেখা যায়, যারা অন্য দেশ দখল করতে যায়, তারা তীর্থযাত্রী (‘পিলগ্রিম’); আর লুঠ-করা সামগ্রীর গুদামের নাম, ‘ফেটিশ’! 

গায়ের জোর দিয়া তো মনের ক্ষোভ কমানো যায় না, ফলে ভাষারে যতটা সম্ভব আদুরে বানানো হয়। নির্ভেজাল হত্যাকান্ডের নামও দেয়া হয়, পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি (কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ)। ২০ শতকের ৯০ এর দশকে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এক নারীকে যৌন-হেনস্থার অভিযোগ উঠলে, অনেক বাকবিতণ্ডার পর, তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তার আচরণ অসঙ্গত (‘ইনএ্যাপ্রোপ্রিয়েট’) ছিল। বলা বাহুল্য পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ভার্বাল এপ্রোচটা কিন্তু সঙ্গত (এপ্রোপ্রিয়েট) ছিল! এইরকমই হয় ভাষা পরিস্থিতিতে। প্রথম ইরাক যুদ্ধের সময় জানা গেল, অন্য দেশে বোমা ফেলতে যাইতেছে যে বিমান, তার নাম:  প্যাট্রিয়ট। (এই প্রসঙ্গে কারও মনে পড়তে পারে, সোনার বাংলায়ও এভাবে  কেউ কেউ ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধি পায়)।     

শুধুমাত্র ডান্ডা দিয়া  মানুষরে পোষ মানানো যায় না।  যে গরুরে হাজার বছর ধরে পোষ মানায়ে নেওয়া হইছে, সেই গরুও  (মানে বাছুর) জন্মেই  তিড়িংবিড়িং লাফ মারে।

মানুষরে পোষ মানাইতে অনেক প্রকার সাংস্কৃতিক ট্রেনিং বা সুশীলায়নের দরকার হয়; চমস্কির ইনডকট্রিনেশন সিস্টেমের বাংলা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন: দীক্ষায়ন প্রকৌশল (পোষমানা মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া বলা যায়)। আর ভাষাও সেইখানে একটা বড় রোল প্লে করে; যদিও আদমের বেটা মানুষরে পুরোপুরি ডোমেস্টিক বানানো যায় না। অনেকখানি যায়।         

এই কথার প্রমাণ পাবেন যখন দেখবেন,  সন্ত্রাসী বা কথিত সন্ত্রাসীরে বা নিরীহ লোককে ( পাঠক, ঝালকাঠির  তরুণ লিমনের কথা মনে আছে আপনার?) ঠান্ডা মাথায় কমান্ডো স্টাইলে খুন করারেও তাই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বইলা চালাইতে হয়। চাষীর জমি কাইড়া নিয়া কারখানা বানানোর নাম দেয়া হয়, ‘শিল্পায়ন’। 

ভাষা প্রকাশ করে না শুধু, গোপনও করে
অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

জন এফ কেনেডি ১৯৬৩ সালে সেপ্টেম্বরে  এক টিভি ইন্টারভিউতে ভিয়েতনামের সৈন্য পাঠানোর  ব্যাপারে যেমন বলেন,  ‘… আমরা সেইখানে আমাদের লোকজনরে উপদেষ্টা হিসেবে পাঠাইতে পারি, তবে, ভিয়েতনামের জনগণরে কিন্তু জিততে হবে।‘  সেই উপদেষ্টাদের চেহারা ও স্বভাব ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে জানা যায়। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর  ‘সুভাষণ’-এর একটা মাত্র নমুনাঃ নাপাম বোমার পরিবর্তে সুভাষিত হালকা/ বাছাইকৃত রসদ-এর ব্যবহার। 

উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানো তার বইয়ে বেশ কিছু উদাহরণ হাজির করছেন। যেমন:  

ভিক্টোরিয়ান আমলে অবিবাহিত নারীর সামনে কেউ ট্রাউজারস-এর উল্লেখ করত না। তেমনি, কিছু জিনিস আছে যা জনসম্মুখে আজকাল একজন চাইলেই বলতে পারে না:

★ সাম্রাজ্যবাদরে বলা হয় ‘বিশ্বায়ন’ 

★ বামনরে যেমন বলা যাইতে পারে শিশু তেমনি সাম্রাজ্যবাদের শিকারগুলোরে বলা হয় ‘উন্নয়নশীল দেশ’

★ সুবিধাবাদিতাকে বলা হয় ‘বাস্তববাদিতা’

★ গরিব লোকদের বলা হয় ‘অল্প আয়ের লোক’ 

★কোন কৈফিয়ত বা জবাবদিহিতা ছাড়া কর্মীদের ছাটাই/ বহিষ্কার করতে মালিকের ক্ষমতারে বলা হয় ‘নমনীয়  শ্রম বাজার’ (flexible labor market)

★জুলুমরে বলা হয় ‘অবৈধ জবরদস্তি’ অথবা ‘শারীরিক এবং মানসিক চাপ’

★ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদের জনসম্পদ লুটপাট ‘বেআইনি সমৃদ্ধি’র নাম 

★ একজন কৃষ্ণাঙ্গ হইল ‘বর্ণময় মানুষ’

★ সামরিক অপারেশনে নিহত লোকেরা মৃত না, যুদ্ধে নিহতেরা হইলো ‘ক্ষয়ক্ষতি’ 

★ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে, ১৯৯৫ সালে, ফ্রান্স যখন নিউক্লিয়ার পরীক্ষা চালায়, তখন নিউজিল্যান্ডে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি বোমা শব্দটা পছন্দ করি না। এগুলো বোমা না, এগুলো বিস্ফোরক বস্তু।

কেন সুভাষণ?  

ব্রাজিলিয়ান লেখক রুবেন ফনসেকার একটা ডার্ক কমেডিক গল্পে একজন আইনের প্রফেসরের সুভাষণের প্রতি এতো ঝোঁক ছিল, বা ট্যাবু-টার্মের প্রতি এমন বিরাগ ছিল যে, সে সঙ্গম বা সেক্স শব্দের কোনো প্রতিশব্দই ব্যবহার করতেন না কথাবার্তায়। নিতান্ত বাধ্য হইলে ল্যাটিন ‘ইন্ত্রোদাকসিও পিনিস ইন্ত্রা ভাস’ কথাটা কইতেন। 

আমাদের দেশেও ইংরেজ-ব্রাহ্ম বাহিত সুশীল সম্প্রদায়  রুচিতে ভিক্টোরিয়ানদের চেয়েও বেশি ভিক্টোরিয়ান।       

কী কী আমাদেরে বিব্রত করে জানতে-বুঝতে চমৎকার একটা উপায় হইতে পারে আমাদের ভাষিক পরিহার–প্রবণতার দিকে নজর দেওয়া। কারণ সেসব আমাদের মনের অবস্থার প্রতি ইশারা করে। কোনটা আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, বিব্রত করে, কোন বিষয়, প্রসঙ্গ বা আলোচ্য বিষয় ট্যাবু আমাদের কাছে? কোন কথাটারে ঘুরায়ে বদলায়ে বলতে হয়?   

সুভাষণ স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ জনসম্মুখে/ পাবলিকলি বলতে হেল্পায়। এমনভাবে, যেন ব্যবহারকারী সেইগুলা (বিষয়গুলা) নিয়া না, অন্য কিছু নিয়ে বলতেছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এজেন্ট এদের করা ম্যানিপুলেশনে সুভাষণ প্রায়শই  অন্যতম হাতিয়ার হয়া ওঠে। খালি ট্যাবুটার্মগুলো বলতেই সুভাষণ ব্যবহৃত হয় তা না, বরং সত্যিরে, বাস্তবতারে প্রায়ই ঢাইকা রাখতে, চরম বৈষম্যরে সহনীয় কইরা তুলতে, ক্ষমতা-শ্রেণি-কর্তৃত্বকে ভাষিক অভিব্যক্তিগুলা থিকা আড়াল করতে সুভাষণ  খুবই ফলদায়ক। যেই সমাজে বৈষম্য যত বেশি, গুটিকয়েকের আধিপত্য যত বেশি সেই সমাজের শাসক-সুবিধাভোগী শ্রেণিরে ততবেশি সুভাষিত হইতে হয়।   

বিশ্বজুড়ে সুভাষণের প্রধান ভোক্তাশ্রেণি মিডলক্লাস। গবেষকেরা দেখছেন, যারা লোয়ার ক্লাস থেকে আপার ক্লাসের দিকে যায়, তাদের উক্তি বেশি সুভাষিত। কারণ তাদের কাছে সুভাষণ ক্লাস-মার্কার বিশেষ। অবশ্য এর মানে এইটা না যে লোয়ার থেকে আপারের দিকে যত যাওয়া যাবে সুভাষন তত বাড়বে। বরং উলটা আপার এবং লোয়ার- উভয় ক্লাসই মিডলক্লাসের চেয়ে কম সুভাষিত উক্তি ইউজ করে।  

মধ্যবিত্তের (ইকোনমিক ও কালচারাল উভয় বিবেচনায় মধ্যবিত্তের কথা বলা হইতেছে) সুভাষনের সাথে লেপ্টে থাকতে চাওয়ার কারণ খালি  সত্যরে, স্পর্শকাতর বিষয়গুলারে এড়ানো বা গোপন রাখার প্রবণতা না। সুভাষণ মধ্যবিত্তের খুব প্রিয় কারণ  সামাজিক আড়ম্বরের প্রতি তাদের আকুল-আকাঙ্ক্ষায়  সুভাষন সাহায্য করে, হেল্পায়। এইটা সম্ভব হয়, কারণ বেশিরভাগ সুভাষনে সিলেবল বাড়ায়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আর মধ্যবিত্ত মনন সংখ্যায় বিপুল হওয়ারে ওজন ও মূল্যে বিপুল হওয়ার সাথে গোল পাকায়ে ফেলে।      

অলঙ্করণঃ ঈহা

অবশ্য সুভাষণ  মানেই যে সবসময় অধিপতির শ্রেণিস্বার্থ কায়েমে ষড়যন্ত্রবিশেষ –এইটা বলা যায় না।  বেশিরভাগ সময়,অবশ্য, এইটা শ্রেণী স্বার্থে উপাদেয় ফল দেয়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে সদর্থেও  সুভাষণ ব্যবহৃত হইতে পারে। ভাষিক সৌন্দর্য বাড়ায় কখনো কখনো। খুব বেদনাদায়ক কিছু করার আগেও  রোগীকে ডাক্তার হয়ত বলতেছে, ‘একটু লাগবে কিন্তু’।   

সুভাষণের স্বভাব-চরিত্র

সুভাষণ যে শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়, তার চাইতে অবশ্যই  আকারে বড় হয়। আর বলাবাহুল্য স্বাদু ও  শ্রুতিমধুর হয়। গার্মেন্সে যে কাজ করে তার নাম হয়, পোশাকশ্রমিক। লেবার উপযুক্ত শব্দ। কাজের মেয়ে, ছেমড়ির চেয়ে ‘গৃহপরিচারিকা’ আকারে বড়। 

হিউ রসন তার ‘Dictionary of Euphemisms and other Doubletalk’ এর ভূমিকায় সুভাষনের নীতিটা লিখছেন:

‘সুভাষণ যত দীর্ঘ  তত ভালো। সাধারণত… যে শব্দগুলারে সুভাষণ প্রতিস্থাপিত করে, সুভাষন তাদের চাইতে  দীর্ঘ হয়। বেশি বর্ণযুক্ত, বেশি অক্ষরযুক্ত (সিলেবল অর্থে), প্রায়ই এক অক্ষরের বদলে দুই বা ততোধিক অক্ষর প্রয়োগ করা হয়।’    

বাংলা ভাষার সুভাষণ স্বাভাবিকভাবে ইংরেজির থেকে আলাদা। ইংরেজিতে যেমন ভাষিক ভদ্রায়নে ল্যাটিনাইজেশনের ব্যবহার তেমনি বাংলায় সংস্কৃতায়ন। ইংরেজিতে, স্কুল/ কলেজ যেমন ‘একাডেমিয়া’ ( তা-ও আবার  সিউডোল্যাটিন) হয়া যায়, বাংলায় তেমনি গাঁজা শব্দ ভদ্রস্থ  করতে ‘গঞ্জিকা’র মতো শব্দ বানাইতে হয়। আদতে গঞ্জিকা বলে কোনো সংস্কৃত শব্দ নাই। কেউ শুয়ারের বাচ্চা না বললে, বরাহ শাবক বলে গালি দিলে বুঝবেন, সে তার ভদ্রলোকত্বের সিগন্যাল দিচ্ছে।  

সুভাষনের জনপ্রিয়তম মাধ্যম শিষ্টতা (পোলাইটনেস)। শিষ্টতা নিয়া, অন্তত দুইজন খ্যাতনামা অভিধান রচয়িতা তাদের অভিধানে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করছেন। স্যামুয়েল জনসন আর অ্যামব্রোস বায়ার্স।  প্রথমজনের মতে,  শিষ্টতা হইলো, ‘ভুয়া ভালোমানুষী’  আর ২য় জনের মতে, ‘সবচে গ্রহণযোগ্য ভন্ডামি’   

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বুরদিও’র মতে, কথা বলার সময় সুভাষণ মুনাফারে দ্বিগুণ কইরা দেয়ঃ “the profit of saying and the profit of denying what is said.”  বুরদিও অবশ্য মনে করেন, মানুষের সমস্ত ভাষিক যোগাযোগই কম বা বেশি মাত্রায় সুভাষিত। প্রত্যেকেই কথা বলার/ লেখার আগে নিয়মিত তার অডিয়েন্সের কথা মাথায় রাইখাই সেন্সর করে। সেই অর্থে সবার ভাষাই কম-বেশি ইউফেমিস্টিক। জনাব বুরদিও অবশ্য বলতে ভোলেন না যে,  এই কম-বেশির তফাৎ বিবেচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশি কারা ব্যবহার করে, কখন, কীভাবে এবং কাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়  সেইটা দেখাও জরুরি।           

‘বিশুদ্ধতা’ জিনিসটার ভেতরেই ( ভিত্রে/মধ্যে, এমনকি আরেকটু রাশভারী, সুশীল করতে ‘অন্তর্গত’ শব্দটাও কইতে পারেন) একটা প্রতিক্রিয়াশীলতা লেপ্টে আছে বলে মনে হয়। অন্তত, বড় রকমের রিজিডিটি  আছে  সন্দেহ নাই।  স্ট্যান্ডার্ড, প্রমিত, মানদন্ড ( এইখানে ‘দন্ড’ কথাটায় একটু নজর দেয়া যায়। দন্ড, মানে ডান্ডা- শাস্তি আর কি।  দেখেন নিরীহ শব্দটার ভিত্রেও কতকিছু স্পর্শকাতর বিষয় আছে) প্রতিক্রিয়াশীল জিনিস। 

বিশুদ্ধতা বলবে এইটা ঠিক/কারেক্ট, ওইটা ভুল/রং। যদিও সুশীল বয়ানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাব্জেক্টিভিটির কথা উচ্চকিত হয়, এইক্ষেত্রে ‘অব্জেক্টিভিটি’ তাদের চাওয়া। এবং সেই তথাকথিত ‘অবজেক্টিভিটি’ আবার খুবই শ্রেণিস্বার্থ ঘেঁষা। ফলে ভাষাগত দিক দিয়া এই বিশুদ্ধতাবাদীরা আসলে ‘মৌলবাদী’, মৌলবাদের  সুশীল যে মিনিং দাঁড়াইছে সেই অর্থে বললাম। 

কেননা তাদের প্রেসক্রাইব করা ভাষার বাইরে কিছু দেখলেই তেনাদের গা জ্বলে  (‘গাত্রদাহ’ বললে একটু ভদ্রস্থ শোনায় না?), আপনি’র জায়গায় ‘আপনে’  দেখলেই  সেই ভাষারে ‘অসাধু’ মনে হওয়া হেতু ‘তাহাদের’ মাথার চান্দি (অথবা ধরেন ব্রহ্মতালু) গরম হইয়া যায়।      

লেজিটিমেট ভাষা,  বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ভাষা ব্যবহারে। তখন, যেকোনো ভাষিক অভিব্যক্তিরে (এক্সপ্রেশন) বিবেচনা করা হয় সেই লেজিটিমেট ভাষার সাপেক্ষে। লেজিটিমেট  ভাষা থেকে সামান্য বিচ্যুতিও হাসির, উপহাসের এমনকি তিরস্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘আপনি’ শব্দটার জায়গায় ‘আপনে’ বসালেই বেশ ফানি ফানি লাগে। 

আমাদের টিভি-নাটক-সিনেমায় দেখবেন, যখনই হিউমারের ঘাটতি পড়ে, তখন ডায়ালেক্ট (আঞ্চলিক ভাষাও বলা যায়, যদিও সবসময় ‘আঞ্চলিক’ আর ‘ডায়ালেক্ট’ সমার্থক না) আইনা খামতি পূর্ণ করা হয়। 

আগে যেমন কলকাত্তাই সিনেমায় ভাঁড় চরিত্রগুলার মুখে ‘বাঙাল’ ভাষা দেখা যাইতো খুব তেমনি  বর্তমানে ‘বাঙাল’ ভাষার জায়গায় এদেশি টিভি-সিনেমায় ডায়ালেক্টগুলা হাস্যরস সাপ্লাই দিতে থাকে। তারও আগে, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিম্নবর্গের পাত্রপাত্রীরা অপভ্রংশে কথা বলতো; গ্রাম্য লোকের  (গাইয়া লোকের) মতো, শহুরে লোকদের আনন্দ দেবার জন্য। 

কিন্তু কেন ডায়ালেক্টগুলা ফানি লাগে? 

ফানি লাগে লেজিটিমেট জায়গা থেকে প্রতিসরণ বা বিচ্যুতি ঘটে বলে?  দর্শক শ্রোতাকে সাময়িক সুপিরিয়রিটির বোধ দিতে থাকে এইরকম হিউমার?  (এমনকি, প্রিয় পাঠক/ পাঠিকা, আপনি সুশীল হইলে,  এই লেখাটা পড়তে গিয়া যদি ২-১টা শব্দ পড়তে গিয়া মৃদু অস্বস্তি লাগে, তবে অবাক হবেন না) 

সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, সুভাষণ সবসময় লেজিটিমেট ভাষার গা ঘেষে চলে। এই লেখাটা সুভাষণ নিয়া, লেজিটিমেট ভাষা কিংবা ভাষার উচু-নিচু বা স্ট্যাটাস  নিয়ে না। বিস্তারিত সেই আলাপ  অন্যত্র করবো। তবু প্রয়োজনে দুই-একটা খুচরো মন্তব্য রেখে যেতে হলো।         

তবুও যদি আপনি খুবই ইনোসেন্ট ধরনের হন আর বলেন,  প্রমিত বা মান ভাষা বলে বাজারে চালু  জিনিসের গলদটা কোথায়?

গলদটা এইখানে যে ভাষার ডাইনামিক ও সৃষ্টিশীল দিকটা অনেক সময় ভাষা হারিয়ে ফেলে, কিংবা অনেক সময় হারিয়ে ফেলা হয় (যেমনটা হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে) হয়া যায় টেকনোক্রেটিক শাসনের মতো সেই ভাষা। এবং সেই ভাষা ক্ষমতা-সম্পর্ক রিপ্রডিউস করতে হেল্পায়। 

তখন মুখস্ত বুলি কপচানো পাখির মতো হইয়া যায়, অর্থাৎ ভাষার প্রাঞ্জলতা থাকে না, সৃজনশীলতা থাকে না। সবচে বড় কথা, ভাষার মধ্যে (ভেতরে/ ভিত্রে) বানোয়াট জিনিসপাতি চলতে থাকে। তখন কী হয়, তার প্রমাণ পাবেন, আমাদের বামেরা ‘শোষিত’ শ্রেণির কাছে যে পৌছাতে পারে না , অনেকগুলা কারণের মধ্যে বামদের ভাষাও হয়তো একটা কারণ। ভাষার এহেন অবস্থায়, ভাষার প্রাণটাই যেন মইরা যায়, মেকানিকাল হয়া যায়। কানপাতলে শোনা যায়, ভাষা যেমন জীবন উৎসারিত হওয়ার কথা, সেইরকম ‘কালচার নেচারের ভাষায় কথা বলছে’না।   

একটা ৮/৯ বছরের ছেলে বা পোলা, ‘বাসাবাড়িতে’ কাজ করে, চেনে ঘোড়া আর পাখি। একদিন পত্রিকার পাতায় একটা ছবি দেইখা বলে উঠল, ‘ঘোড়াপাখি’  ‘ঘোড়াপাখি’। যদিও সে পড়তে পারে না, জানে না পেগাসাস বা পঙ্ক্ষীরাজ বলে কোন পৌরাণিক প্রাণীর কথা।  ‘ঘোড়াপাখি’র মতো একটা সৃজনশীল শব্দ তৈরিতে উচ্চতর দক্ষতার পরিচয় কিন্তু সে দিছে।  কিংবা এই বস্তিতে থাকা শিশুরে যদি বলেন, ঝলমল করছে মানে কী? সে যদি উজ্জ্বল না বইলা, ‘যেন লাইট মারছে’ বলে অবাক হবেন না। কারণ এদের ভাষা মধ্যে জীবন উপস্থিত।

দুর্নীতি মানে জিজ্ঞেস করলে, ভদ্রলোক হয়ত বলবে, অন্যায় কাজ, রীতিলঙ্ঘন ইত্যাদি। যে নিরক্ষর সে আপনারে  হয়তো বলতে গিয়া বর্ণনাই দিয়ে ফেলল, ‘দুর্নীতি মানে ধরেন, র‍্যাশন কার্ড আনতে গেছি, ঘুষ নেল’। যা ক্ষমতা-কাঠামোর বুকের সাথে লেপ্টে থাকা  ‘প্রায়’ মেকানিকাল ভাষা (অঙ্গীভূত হয়েছেও বলতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নাই) আপনাকে এই সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্ছিত করবে।     

কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘শব্দের ভেতর দিয়েই চিন্তার জন্ম হয়’।আর আমাদের  চিন্তা-ভাবনা আগে ভাগেই  ভাষার আবেষ্টনে আবদ্ধ থাকে  অনেকখানি (অলরেডি এনকমপাসড বাই দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ দ্যাট ইজ আওয়ার ওন’)

(কীভাবে, কেমনে হয়, সে- আলাপ বিস্তারের সুযোগ এখানে নাই বলে দুইজন উল্লেখযোগ্য ভাষাবিদের উদ্ধৃতি রেখে গেলাম। এই ব্যাপারে ভিন্নমতের বা কৌতূহলী যে কারুর সাথে সতর্ক ( তর্কের সহিত বর্তমান) আলাপে আমার কোনো আপত্তি নাই। )    

এই প্রভাবিত/ নির্ধারিত হওয়াটা একতরফা না যে খালি ভাষাব্যবহারই চিন্তারে ডমিনেট করবে, বরং প্রক্রিয়াটা দ্বান্দ্বিক। সংস্কৃতি যেমন ভাষার রূপরীতি ঠিক করে দেয়, একটা সমাজের চিন্তাজগতও প্রভাবিত হয় আবার সেই সমাজের প্রচলিত ভাষা-কাঠামোরে কেন্দ্র কইরা। ভাষা গবেষকেরা নিঃসন্দেহ, ব্যক্তির চিন্তা তার সমাজের বিদ্যমান ভাষা-কাঠামো দ্বারা  প্রভাবিত হয়। যত কল্পনাশক্তি বা সৃজনশীলতার অধিকারী আপনি হননা কেন, যে ভাষিক আবহাওয়া ও জলবায়ুতে আপনার থাকা, বেড়ে ওঠা, সেই ভাষার কাঠামোর বাইরে গিয়া চিন্তা বা ভাষিক অভিব্যক্তি সৃষ্টি করা খুব কঠিন। 

তো, কী  করতে পারেন?

ভাষা ব্যবহারেও হয়ত বড়জোর লড়াই না হোক, প্রতিরোধী অবস্থানটা জানাইতে পারেন।

সুভাষণ যখন শোষণে সহায়ক, শ্রেণি-কর্তৃত্বের আধিপত্যের সহায়ক তখন  (যতটা সম্ভব) এভয়েড করা গেলে তো ভালোই, নতুন শব্দও ব্যবহার করতে পারেন। জরুরী ভাষা ব্যবহারে চোখ-কান খোলা রাখা সচেতনতা। কেউ কেউ সেই চেষ্টা করেন নাই এমন না, মার্ক্সিস্ট শব্দটার বাজার চলতি নেগেটিভ দিকটা টের পায়া ধূর্জটিপ্রসাদ নিজের পরিচয় দিতেন মার্ক্সোলজিস্ট বলে। ভেরিয়ার এলউইন এ্যান্থ্রোপলজিস্ট না বলতে নিজেরে বলতে চাইতেন, ফিল্যানথ্রোপলজিস্ট। বাংলায় যারা এনার্কিজম নিয়ে আগ্রহী, তারাও প্রথমে ‘নৈরাজ্যবাদ’ বললেও শব্দটার নেগেটিভ এ্যাসোসিয়েশন টের পেয়ে ‘অরাজপন্থা’ বলা শুরু করছেন। 

ক্ষমতা-কর্তৃত্ব-শোষণে সুভাষণের যেভাবে ব্যবহার হইতেছে, সেই বিষয়ে সচেতনতাও কাজের। কোনো কৌশলের ব্যাপারে সতেচন হওয়া মানে সেই কৌশলকেই অনেকখানি অকেজো কইরা দেওয়া।      

এমন এককালে আমরা বাস করি যখন গনহত্যারে বলা হয় দুর্ঘটনা। 

গরিবের-কৃষকের জমি দখলের নাম  শিল্পায়ন,. প্রানপ্রকৃতি ধ্বংসের নাম ডেভেলাপমেন্ট (উন্নয়ন-এর চেয়ে স্মার্ট, মিষ্টিও লাগে শুনতে)। পাছায় বাঁশ ঢুকাইতে ঢুকাইতে বলা হয়, ইতিবাচক হও। থিংক পজিটিভ। বি পজিটিভ। 

আইডিওলজিক্যাল পজিটিভিজমের এই রমরমা সময়ে, ইতিবাচকতার মহামারির এই কালে এক নম্বর মিথ্যাবাক্য, আপনা ভালো তো জগত ভালো। আপনি ভালো হলেই জগত ভালো হবে না। আপনার ভাষিক অভিব্যক্তি যতই ‘ইতিবাচক’  আর সুভাষণে ভরপুর হোক, তা কেবল বাস্তবতারে, সত্যরে আড়াল করতে থাকবে।

গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিস বলতেন, বলতেন ওয়াল্টার বেনইয়ামিনও, প্রতিটি সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের আগে মুখোশ পইড়া নেয়।    


[ টীকাটিপ্পনী: 

একাডেমিক লেখার মতো উদ্ধৃতি-পাদটীকা দিতে আমার বিরক্তি লাগে। এইখানে, পন্ডিত লোকের বই-এর উদ্ধৃতি দেখলে যাদের লেখকের প্রতি সমীহ জাইগা ওঠে,- আরিব্বাবা উনি তো বেশ জ্ঞানী লোক- সেইসব সুশীলদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তি উপহার প্রদানের নিমিত্তে, তাহাদের শ্রীচরণে এই রেফারেন্সগুলা নিবেদিত।     

  সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত। বর্ধমান সাহিত্যসভা, বর্ধমান, ১৯৫৭ সাল, ৫ম সংস্করণ।

জন সিনক্লেয়ার প্রণীত, কলিন্স কোবিল্ড লার্নার’স ইলাস্ট্রটেড ডিকশনারি, ২০০৯ সংস্করণ। 

এদুয়ার্দো গালেয়ানো, আপসাইড ডাউন এ প্রাইমার ফর দ্য লুকিং-গ্লাস ওয়ার্ল্ড। বইয়ের ‘দ্য লুকিং-গ্লাস স্কুল’ অধ্যায়ের  ‘ইনজাস্টিস ১০১’  অংশ দ্রষ্টব্য।    

  হিউ রঅসন, দ্য ডিকশনারি অফ ইউফেমিজমস এন্ড আদার ডাব্‌লটক, পৃ: ১০,  ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮১। বন্ধনীর ভেতরে শব্দ বর্তমান লেখকের।   

স্যামুয়েল জনসনরে প্রায় সবাই অভিধানপ্রণেতা হিসেবে জানলেও সাহিত্যিক অ্যামব্রোস বায়ার্স যে, ‘দ্য ডেভিল্‌স  ডিকশনারি’ নামে প্রজ্ঞা ও ব্ল্যাক হিউমারে ভরপুর একখানা অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন এটা হয়ত অনেকেই জানে না।  

গৌতম ভদ্র, ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার যায়?’ পৃ: ২৩  ছাতিম, কলকাতা। যদিও বইটা ভিন্ন বিষয়ের, মন্তব্যটা আমার ভাল্লাগছে।      

  এল. এস. ভাইগটস্কি, থট এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, ১৯৬২, পৃ: ১৫৩  

এইচ.  জি. গাডামার, ফিলসফিকাল হের্মেনিউটিক্স, ১৯৭৬, পৃ: ৬২ ]  

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন