কমলা ভাসিন–এর নারীবাদ পরিচিতি । পর্ব-২ 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন

এটা কি সত্যি যে, নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের বদলে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

প্রশ্নটি নারীবাদ সম্পর্কে সামগ্রিক ভুল বোঝাবুঝিকেই তুলে ধরে অথবা এটি নারীবাদকে কলঙ্কিত করার একটি প্রয়াস। আপনি কি এমন কোনও নারীবাদীর কথা শুনেছেন যিনি বলেছেন অথবা লিখেছেন যে তিনি পুরুষতন্ত্রের বদলে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান? যদি আপনি এমন উক্তি স্মরণ করতে না পারেন, তবে নারী-পুরুষ সমতা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব অক্ষমতা থেকে সম্ভবত এই প্রশ্ন উদ্ভুত হয়। 

এতে প্রতীয়মান হয় যে, কিছু মানুষ শুধুমাত্র ক্ষমতার ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারেন না। 

নারীবাদীদের অবস্থান, দাসত্ব, ক্ষমতার স্তরবিন্যাস এবং সকল প্রকার অসমতার বিরুদ্ধে এবং তার স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে। 

বলা হয়ে থাকে, যখন কোনও নারী পুরুষের মতো হয়,  তখন সে হয় একটি ডাইনি, কিন্তু একজন পুরুষ যখন নারীসুলভ গুণ অর্জন করে তখন সে হয় একজন সাধু। তাহলে কেন নারীবাদীরা পুরুষের মতো হতে চায়? 

প্রথমত, আমরা বিশ্বাস করি না বা স্বীকার করি না যে, পুরুষদের এক ধরণের বৈশিষ্ট্য আছে বা থাকা উচিত এবং নারীদের আরেক ধরণের আরেক ধরণের। আমরা বিশ্বাস করি যে, পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই তথাকথিত ‘পুরুষসুলভ’ গুণ (শক্তি, সাহসিকতা, নির্ভীকতা, কর্তৃত্ব, প্রতিযোগিতার মনোভাব ইত্যাদি) এবং তথাকথিত ‘নারীসুলভ’ গুণ (যত্ন, সেবা ভালোবাসা, ভীরুতা, বশ্যতা ইত্যাদি) থাকতে পারে বা বিকাশ লাভ করতে পারে। এই সবই মানবীয় গুণ পুরুষের জন্য আর কিছু নারীদের জন্য আলাদাভাবে ধার্য করে দেয়। এটি চাপিয়ে দেয়া গুণাবলিরই ফলাফল যা প্রভাবশালী, অসহিষ্ণু, আক্রমণকারী পুরুষ ও অনুগত, মেরুদণ্ডহীন, ভীতু নারী তৈরিতে প্রণোদনা দেয়। আমরা চাই যে, মেয়ে এবং ছেলে, নারী এবং পুরুষ উভয়েই ইতিবাচক ‘পুরুষসুলভ’ এবং ‘নারীসুলভ’ গুণাবলি পরিহার করে তাদের সামর্থ্যের  বিকাশ ঘটাতে পারবে। 

আমাদের প্রত্যেকেরই মধ্যেই নারী এবং পুরুষ উভয় গুণাবলি আছে এবং উভয় গুণাবলির অনুশীলন প্রয়োজন। 

নারীবাদীরা কখনও পুরুষদের নেতিবাচক গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট্যাবলি গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। এই পৃথিবী ইতোমধ্যেই পুরুষদের হিংস্রতা এবং আক্রমণে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে এবং এর জন্য অতিরিক্ত উৎপীড়নের প্রয়োজন নেই।  আসলে, আমরা বরং চাই যে পুরুষরাও আরও বেশি নারীদের মতো হয়ে উঠুক, অর্থাৎ তারা সন্তানদের এবং বৃদ্ধদের দেখাশোনা ও যত্ন করবে, সংসার পরিচালনা করবে ইত্যাদি। এর ফলে পুরুষরা আরও ভদ্র, অনুভুতিপ্রবণ এবং হৃদয়বান হয়ে উঠবে এবং নারীদের অনেক কাজের ভার লাঘব হবে। 

যদিও সাহসিকতা, নির্ভীকতা, যৌক্তিকতা, দক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলি পুরুষের বলে বিবেচিত হয়, তথাপি নারীদের অবশ্যই এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন এবং অনুশীলন করা উচিত। 

নারীবাদীরা কি পুরুষবিদ্বেষী?

নারীবাদীরা পুরুষদের ঘৃণা করে না। তারা পিতৃতন্ত্র, পুরুষের আধিপত্য এবং পুরুষের মধ্যকার পুরুষালি আচরণের বিরুদ্ধে। যেসব নারী পুরুষের আধিপত্য, আক্রমণ ও হিংস্রতাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে, নারীবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। নারীবাদীরা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আদর্শের বিরোধী। এই আদর্শ ও ব্যবস্থা পুরুষকে উৎকৃষ্ট বলে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে অধিক অধিকার ও সুযোগ প্রদান করে। 

সকল ব্যবস্থা ও নিয়মকানুন মানুষই টিকিয়ে রাখে। কোনও নিয়ম বা ব্যবস্থা কখনও কখনও নারীকে ধর্ষণ অথবা নির্যাতন করে না, করে একজন পুরুষ। নিয়ম কোনও দিন কন্যাসন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে না, করে একজন পিতা। 

সুতরাং, আমরা সেই সব পুরুষের বিরুদ্ধে, যারা নারীদের নিজেদের সমান বলে স্বীকার করে না, যারা নারীদের নিজেদের সম্পত্তি বলে গণ্য করে এবং পণ্য বলে বিবেচনা করে। 

দুর্ভাগ্যবশত অনেক পুরুষই আধিপত্য বিস্তারকারী এবং তাদের ভিতরে এ ধরণের গুণাবলি রয়েছে। এমনকি অনেক অতি উৎসাহী গণতান্ত্রিক এবং সমাজবাদী পুরুষের ক্ষেত্রেও এ তথ্য সত্য। তারা সমাজে সাম্যের বানী প্রচার করে অথচ বাড়িতে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই সাম্য অনুশীলন করে না।

আমরা অবশ্য বিশ্বাস করি, নারী যেমন প্রাকৃতিকভাবেই যত্নশীল এবং সেবাপরায়ণ নয়, পুরুষও তেমনি প্রকৃতিগতভাবেই আক্রমণাত্মক এবং আধিপত্য বিস্তারকারী নয়। তারা আসলে শিশুকালের শিক্ষাদীক্ষা পদ্ধতি এবং সামাজিক অবস্থার শিকার। যার ফলে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত ভাবমূর্তির ফাঁদে তারা আটকে আছে।  

আমাদের সমস্যা হলো যে অধিকাংশ পুরুষ এই বিষয়টি স্বীকার করে না এবং খুব অল্পসংখ্যক পুরুষই এই ব্যাপার থেকে নিজেকে মুক্ত করে মানবিক এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে। তাছাড়া, কিছু পুরুষ নারীদের দ্বারা প্রস্তাবিত যে কোনও পরিবর্তনের বিরোধী। 

যে নারীরা পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে, সমর্থন করে অথবা ঠিক বলে মনে করে তাদেরকেও নারীবাদীরা যথেষ্ট সমালোচনা করে। অন্যভাবে বলা যায়, যারা স্বৈরতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, আক্রমণাত্মক, তাদেরকেও নারীবাদীরা সমালোচনা করে। আমাদের অনেকেই ম্যাডেলিন অলব্রাইটের মতো নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। 

জেন্ডার সমতার ইস্যুটি নারী এবং পুরুষের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে নয়। বরং যারা নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে এবং সমতা চায় এবং যারা তা চায় না বরং পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়, তাদের মধ্যকার বিরোধ।

আমরা সবাই জানি যে, এই উভয় শিবিরে পুরুষ ও নারী আছে। অনেক পুরুষই আজকাল তাদের পুরুষত্ব, তাদের অধিকার এবং আচরণের নমুনা পরীক্ষা করে দেখছে। এই প্রথমবারের মতো পুরুষের বিভিন্ন গুণাবলি, পুরুষের শক্তি, পুরুষের যৌনশক্তি, পুরুষের জ্ঞানপদ্ধতি, পুরুষের যুদ্ধকৌশল, পরীক্ষা নিরীক্ষার সম্মুখীন এবং পরীক্ষাকারীদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়ই আছে। সুতরাং নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের জন্য লড়াই করাটা নারী ও পুরুষের মধ্যে যুদ্ধ, এই রকম চিন্তা করাটা ভুল।

এ লড়াইটি হচ্ছে দুটি মতাদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্যে। এর দিকে রয়েছে যারা নারী-পুরুষের বৈষম্য ও উপর নিচের ধারণাকে বাতিল করে সমতা, ন্যায়বিচার, উঁচু-নিচু ধাপমুক্ত সমাজ গড়তে চায়, অন্যদিকে রয়েছে যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

এটা অস্বীকার করা যায় না যে, পুরুষ এবং নারীর মধ্যে কিছু মেরুকরণ এবং স্বার্থগত দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্ব অবশ্যই এই জন্য নয় যে, তারা কেউ পুরুষ এবং কেউ নারী। বরং এর পেছনে কারণটি হলো নারী-পুরুষভিত্তিক শ্রমবিভাজন যা তাদের উপর চাপানো হয়েছে এবং যা বিভিন্ন দায়িত্ব ও তার পথ ধরে ভিন্ন ভিন্ন অধিকার ও চাহিদার সৃষ্টি করেছে। এই মেরুকরণ এবং দ্বন্দ্ব অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং তার নিরসনে কাজ করতে হবে। 

এই সবকিছুই মনে হয় যুক্তিপূর্ণ। তবে নারীবাদকে এত ভয় কেন? কেন একে হাস্যকর এবং ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়? কেন এটা এত বিরোধিতার মুখোমুখি হয়? 

এটা সত্য যে, অনেকেই নারীবাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় গুজবকে বিশ্বাস করতে ও নারীবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচারকে সমর্থন করতে খুবই আগ্রহী। তারা নারীবাদীদের সমালোচনা এবং উপহাস করতেও খুব পছন্দ করে। এর কারণ, নারীবাদ সম্বন্ধে তাদের একটা নিজস্ব অস্বস্তি রয়েছে। সময় সময় এই অস্বস্তি হাস্যকর কৌতুক হিসেবে প্রকাশ পায় (তুমি কি সেই ব্রা পোড়ানোদের দলের কেউ হা হা হা), কখনও কখনও ভয় ( শোনো, আমার স্ত্রীর কাছে খুব বেশি সময় থেকো না। আমি ঘরে কোনো নারীবাদ চাই না।)। কখনও কখনও এরা নারীবাদীদের সরাসরি আক্রমণ করে বসে। 

আবার কোনও নারীবাদীর ব্যক্তিগত দূর্বলতা এবং ভুলগুলোকে ‘নারীবাদের দোষ’ হিসেবে দেখা হয়। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি একজন নারীবাদী ধূমপান করে অথবা মদ্যপান করে, তবে তার জন্য নারীবাদকেই দোষারোপ করা হয় না। লোকেরা শ্রমজীবী শ্রেণির নারীদের ধূমপানকে দোষ মনে করে না। অনেকে মনে হয় এটাও ভুলে যায় যে, যেসব নারীরা নারীবাদকে অনুসরণ করে বং সমর্থন করে তারাও মানুষ এবং এই কারণে তারাও ধূমপান করতে পারে, মদ্যপান করতে পারে, রেগে যেতে পারে, অযৌক্তিক আচরণ করতে পারে, বাচ্চাদের অবহেলা করতে পারে ইত্যাদি।  

আমাদের দুর্বলতা এবং ভুলের জন্য নারীবাদ দায়ী নয়। আমরা নারীরা মানুষের অধিকার চাই। আমাদের দুর্বলতা এবং ভুল কাজের দায়িত্ব স্বীকার করি। 

অনেক কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী ধূমপান করে, তাদের পছন্দমতো জামাকাপড় পরে, তাদের পছন্দমতো কেশবিন্যাস করে। যার মাধ্যমে তারা নারীবাদী চিন্তা-চেতনার চেয়ে তাদের স্বনির্ভরতা এবং স্বাধীনতার চিহ্নকেই ফুটিয়ে তোলে বেশি। আসলে, এইসব ‘সাহসী’ নারীদের অনেকেই হয়তো নারীবাদী হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। নারীবাদকে যে অনেকেই হুমকি বলে মনে করে তা মোটেই বিস্ময়কর নয়। তারা সততার সঙ্গেই বলে, ‘তোমরা জানো যে, আমরা নারীর কল্যাণ বা এই ধরণের কোনও কিছুর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এই নারীবাদ আসলেই একটা সমস্যা।’ 

এর বিভিন্ন কারণ আছে। সব ধর্মের নেটারাই নারীবাদীদেরকে অপছন্দ করে। তার কারণ, নারীবাদীরা সব সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নারীবিরোধী ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন ও ঐতিহ্যের সমালোচনা করে থাকে। কোনও কোনও সময় ধর্মীয় নেতাদের ক্রোধ এত তীব্র হয়ে যায় যে, তারা বলিষ্ঠ নারীবাদীদের মৃত্যুদন্ডের চেয়ে কম কোনও শাস্তি প্রদানের দাবি ওঠে এবং পাকিস্তানে নারীবাদীদের এবং মানবাধিকার আইনবিদ ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অবিরত হুমকি দেয়া হয়। 

অনুরুপভাবে, অনেক দেশেই ক্যাথলিক চার্চগুলো সেইসব নারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত রয়েছে যারা তাদের সন্তান জন্মদান এবং নিজ শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী খ্রিষ্টানরা গর্ভপাতের বিরোধিতা করে। তারা শুধু যারা গর্ভপাত করছেন সেই সকল নারীর বিরুদ্ধেই হিংস্র হচ্ছে না, বরং তারা সেই সব ডাক্তারকেও হত্যা করছে যারা নারীদের গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। ডানপন্থী ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীবাদীদের পরিবারবিরোধী, ঐতিহ্যবিরোধী এবং ধর্মবিরোধী বলে অভিযুক্ত করছে। 

নারীবাদীদের অবস্থান, দাসত্ব, ক্ষমতার স্তরবিন্যাস এবং সকল প্রকার অসমতার বিরুদ্ধে এবং তার স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে
অলংকরণ: রাজিব কান্তি


দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় নেতারা নারীবাদীদের দ্বারা আনীত প্রগতিশীল পারিবারিক আইনের তীব্র বিরোধিতা করছে। পুঁজিবাদী পুরুষরাও বিশেষভাবে নারীবাদের বিরোধী। কারণ, তারা জানে যদি নারীরা সচেতন হয় তবে তারা ক্রেতা হিসাবে আর চালাকির শিকার হতে চাইবে না,  এবং অল্প মজুরি, নিচু মানের কাজ আর গ্রহণ করবে না। 

বর্তমানে তারা সেই ধরণের কাজগুলোর মাঝেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তারা ওই সকল নারীবাদীদের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন যারা পর্নোগ্রাফি (যা নারীদের যৌন বস্তুতে পরিণত করে তোলে), প্রসাধনী শিল্প (যা সৌন্দর্য্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে), শিশুখাদ্য (যা বিপুল পরিমাণ শিশুমৃত্যুর কারণ), জন্ম নিবারক (যা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের গিনিপিগ হিসাবে গণ্য করছে এবং অনিরাপদ জন্ম নিবারণ পদ্ধতি সরবরাহ করছে), ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। এ সকল ইন্ডাস্ট্রিতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে, এগুলোর মালিকদের আয়ত্তে আছে প্রচুর সম্পদ যার দ্বারা তারা তাদের অসৎ অভিসন্ধির বিরুদ্ধে যে কোনও চ্যালেঞ্জ বা হুমকি নস্যাৎ করে দিতে সমর্থ। 

সামরিক প্রতিষ্ঠানও নারীবাদীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। নারীবাদীরা বেশিরভাগই যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তি আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন। 

প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত ব্যক্তিরাও নারীবাদীদের ব্যাপারে অস্বস্তিবোধ করেন। কারণ, নারীবাদী পন্ডিতরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতা এবং রীতি-নীতির ক্ষেত্রে যে পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব বিরাজমান সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সদস্যরাও এইসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নারীদের প্রতি যে আচরণ করা হয় সে সম্পর্কে নারীবাদীরা যে প্রশ্ন করে থাকে তা অপছন্দ করে। 

আর একটি কারনে সাধারণ মানুশ নারীবাদীদের ব্যাপারে অস্বস্তিবোধ করে। তার কারণ সম্ভবত এই যে, এই একটিমাত্র মতাদর্শ ঘরের পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আমাদের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে, আমাদের একান্ত বিশ্বাস, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আচরণের ধরণগুলো সম্পর্কে, এমনকি আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছে। এ কারণেই নারীবাদ হুমকি হিসেবে গণ্য হয়। 

একবার যখন নারীরা পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে তখন আমরা অনিবার্যভাবেই আমাদের নিজেদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র এবং বন্ধুদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরি। কেননা এ সেই পুরুষ যারা পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের জন্য মূর্ত করে তুলেছে। 

সমাজের প্রতিটি স্তরে আন্তঃব্যক্তিক ও পারিবারিক সম্পর্ক এবং উভয় ক্ষেত্রে বিদ্যমান সামাজিক স্থিতাবস্থাকে নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে। 

পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ পুরুষদের জন্যই শুধু বেদনাদায়ক নয় বরং ওই সকল নারীদের জন্যেও বেদনাদায়ক যারা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাদের জন্যও বেদনাদায়ক যাদের কাছে সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষা করা অধিক প্রয়োজনীয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে নারীরাই কেবল লাভবান হতে পারে। কারণ, ‘তাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই’’। নারীবাদীরা যে নতুন সমাজ গঠন করতে চায়, তা করতে অনেক পুরুশ এগিয়ে আসতে পারে। তবে তাদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ পরিহার করতে ইচ্ছুক নয়। 

অনেক সময় আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, পুরুষতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা ঠিক কিনা? এটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিনা? আমরা যদি সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের গৃহে, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজে সংঘটিত অতিসূক্ষ্ম লিঙ্গ বৈষম্যগুলোর মুখোমুখি হই তবে আমরা কষ্টদায়ক পরিস্থিতি এড়াতে পারবো কিনা? 

আমাদের স্বামীরা যখন আমাদের শ্রমের ফলে লাভবান হয় অথবা যখন তাদের কাজ বা পেশা আমাদের কাজ বা পেশার চাইতে অগ্রাধিকার পায়, তখন আমরা কী করি? 

একজন মেয়ে শিশু যখন দেখে যে, তার ভাইকে বেশি খাবার দেয়া হয়, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং অন্য যে কোনও বিষয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, তখন সে কী করে? যখন একজন কন্যা সন্তান পারিবারিক সম্পত্তিতে ভাগ পায় না অথবা একজন পুত্র যখন একজন পুরুষ হিসেবে মায়ের উপর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়, তখন কী ঘটে সেই কন্যা বা সেই মায়ের? 

আমাদের নিয়ে যখন ঠাট্টা মশকরা করা হয়, আমরা যখন অপমানিত হই এবং আমাদের উপর নির্যাতন করা হয়, তখন আমরা কী করি? 

যদি এই ধরণের আচরণের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদের ইঙ্গিতও হুমকি হিসাবে দেখা হয়, তা আশ্চর্যের কিছু নয়। কারণ যে কোনও চ্যালেঞ্জই বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। 

জেন্ডার বিষয়টি যে খুবই ব্যক্তিগত এবং সে কারণে খুবই স্পর্শকাতর ও আবেগময় একটি বিষয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এগুলো আমাদের শুধু বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথা, স্কুল-কলেজ, আইনি ব্যবস্থা, রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ ইত্যাদির বিষয়ে মুখোমুখি হতেই বাধ্য করছে তাই নয় বরং আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, মা-মেয়ে) এবং আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোরও মুখোমুখি করেছে। অনেক সময়ই ভিন্ন স্বার্থের কারণে দুটি ভিন্ন দল/সম্প্রদায়ের মাঝে দ্বন্দ্ব হয়।  একই পরিবারের সদস্যদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। অনেক সময় একই ব্যক্তির দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মাঝেও দ্বন্দ্ব দেখা যায়। 

আমাদের কোনও একটি পক্ষ সমর্থনের প্রয়োজন হলে অনেক সময় এমন হয় যে, দুটোর ভেতর একটি বেছে নিতে বেশ কষ্ট হয়। আমরা হতভম্ব হয়ে যাই যখন আমরা আবিষ্কার করি যে, আমাদের খুব কাছের লোকেরা আমাদের স্বার্থে আঘাত হানছে, আমাদেরকে নানাভাবে শোষণ করছে এবং আমাদেরকে সমান দৃষ্টিতে গ্রহণ করছে না। 

সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে খুবই বেদনাদায়ক। শুধু পুরুষরাই নয় বেশিরভাগ নারীও এই ধরণের অবস্থার মুখোমুখি এবং হতভম্ব হওয়ার পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চায়। আমরা নারীবাদ নিয়ে অস্বস্তি বোধ করি। কারণ, নারীবাদ আমাদের নারীদেরকেও চ্যালেঞ্জ করে। আমরা কীভাবে শোষিত হই, আমাদের নারীত্বকে কীভাবে ব্যবহার করি, মেয়েলি আচরণ নিয়ে খেলা খেলি, অন্যদের কিভাবে শোষণ করি, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের অগণতান্ত্রিক এবং কর্তৃত্বপূর্ণ হয়ে উঠি, এ সবকিছুর প্রতিও নারীবাদ সমালোচনাপূর্ণ দৃষ্টি দেয়। 

অন্য কথায়, আমাদের নারীদের ভেতরে যে পুরুষতান্ত্রিকতা আছে, পুরুষসুলভ উৎপীড়ন ও ক্ষমতালোভের যে উৎস আছে, নারীবাদ সেগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য চ্যালেঞ্জ করে। মোট কথা, নারীরাও যে নিজেদের ভেতরে পুরুশতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করে। আমরাও পুরুষদের মতো একইভাবে পুরুশতান্ত্রিক পরিবারে বড় হই, একই ধর্মীয় ঐতিহ্যে বেড়ে উঠি এবং একই পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করি। যার ফলে, বহু নারীই বিশ্বাস করে যে, পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ; তারাও তাদের কন্যাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তাদের গতিবিধির উপর, পছন্দ অপছন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তাদের কন্ঠ রোধ করে। দীর্ঘ সময় ধরে যা আমরা বিশ্বাস করে আসছি, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা এবং তা পরিবর্তন করা আমাদের নারীদের জন্যেও খুবই কষ্টদায়ক। 

মারিয়া মাইস-এর মতানুযায়ী, আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী এবং পুরুষ, সামাজিক লিঙ্গীয় সম্পর্কগুলোর প্রকৃত রূপ পরীক্ষা করার ব্যাপারটি এড়িয়ে চলে। কারণ, তারা ভয় পায় যে অর্থ উপার্জন, শক্তির খেলা এবং আকাঙ্ক্ষার এই শীতল নৃশংস পৃথিবীতে শান্তি ও সংহতির শেষ দ্বীপ পরিবারটি এই কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

এছাড়া, যদি তারা এই বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দেয়, তাহলে তাদের স্বীকার করতে হবে যে, তারা (নারীরা) নিজেরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, পুরুষরা যাদেরকে ভিলেন হিসেবে গণ্য করে তারাও নারীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তারা উভয়েই দুষ্কর্মের সহচর। যদি তারা সত্যিই স্বাধীন ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় তবে তাদেরকে এই দুষ্কর্মের সহচর হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

এটা শুধু সেসব পুরুষদের জন্যই সত্য নয় যাদের সুবিধার শিকড় এই ব্যবস্থা মধ্যে নিহিত রয়েছে এটা ঐ সকল নারীদের জন্যও সত্য যাদের বস্তুগত অবস্থান এর সঙ্গে যুক্ত। 

নারীবাদীরা কোনও বড় সফলতা অর্জন করেছে সেখানেই প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে তীব্র নিপীড়নমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কয়েক বছর আগে কানাডায় এক ব্যক্তি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ১৪ জন ছাত্রীকে গুলি করে এবং তারপর আত্মহত্যা করে। সে যে চিঠি রেখে যায়, তাতে সে স্পষ্টভাবেই বলেছে যে, সে ‘নতুন নারীদের’ উপর খুবই ক্ষুব্ধ। 

কিছু মানুষ মনে করে বিশ্বব্যাপী পর্নোগ্রাফি এবং নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার যে বৃদ্ধি ঘটেছে তা নারীদের তাদের আগের স্থানে নিয়ে যাবার একটি প্রচেষ্টা। দক্ষিণ এশিয়ায় যে সকল নারী পর্দা নিয়ে তাদের শরীর ঢেকে রাখে না, তাদের কারও কারও উপর এসিড নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটে এবং নারীদের অনাবৃত বাহুতে আঘাত করা হয়। 

নিম্নবর্ণের হিন্দুরা, কৃষকরা, শ্রমিকরা, কৃষাঙ্গরা যখন সংগঠিত হয় এবং বিদ্যমান অন্যায় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে তখন তাদের বিরুদ্ধে যে হিংস্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়, তার সঙ্গে নারীদের বিরুদ্ধে যে সকল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার কী কোনও পার্থক্য আছে? 

নারীবাদীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা কেবল এ কথাই প্রমাণ করে যে, নারীবাদীরা এমন একটি সুরক্ষিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যেখানে শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তি লাভবান হয়। ঐ সকল ব্যক্তির সুবিধা এবং মুনাফাসমূহ হুমকির সম্মুখীন হওয়ার ফলে তারা প্রকাশ্যে শত্রুতা এবং নারীবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচারণার আশ্রয় নিচ্ছে।

যুক্তি পুরুষদের মুক্তির সঙ্গে নারীর মুক্তি সম্পর্কিত হয় এবং যদি  তারাও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফাঁদে বন্দি হয়ে থাকে, তবে তারা নারীবাদের ব্যাপারে এত ভীত কেন? 

সব পুরুষই নারীবাদের ব্যাপারে ভীত নয় এবং তারা সকলেই এর বিরুদ্ধেও নয়। তবে বিপুলসংখ্যক পুরুষ ভীত এবং এর বিরুদ্ধে। কারণ, বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের জন্য সুবিধাজনক। তাছাড়া নারীবাদ পুরুষ প্রাধান্য ও পুরুষ কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং প্রাকৃতিক জেন্ডারভিত্তিক পুরুষ আধিপত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। এটা পুরুষদেরকে তাদের মনোভাব, আচরণ এবং পদমর্যাদা পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখতে চাপ দেয়— যা মোটেও সহজ বা আনন্দদায়ক নয়। মোটের উপর, কোনও শাসকই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করে না। 

বর্তমান ব্যবস্থায় পুরুষদের সুযোগ-সুবিধা অসংখ্য, তাদের জন্মের মুহূর্ত থেকেই উচ্চমর্যাদা, ভালোবাসা এবং সম্মান দেওয়া শুরু হয়। ছেলে শিশুদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো খাবার, ভালো চিকিৎসা এবং ভালো শিক্ষার সুযোগ থাকে এবং একইভাবে তাদের স্বাধীনতাও থাকে— চলাফেরার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের এবং পছন্দের স্বাধীনতা।

পুরুষরা উত্তরাধিকারসূত্রে নারীদের চেয়ে বেশি পৈত্রিক সম্পত্তি পায় এবং অনেক আইন এখনও পুরুষদের অনুকুলে, পক্ষপাতমূলক। 

শতকরা নব্বই ভাগের উপর সংসদীয় আসন এবং শতকরা ৮০ ভাগের উপর ব্যবস্থাপক পদ দখল করে আছে পুরুষরা। নারীবাদীরা নারী-পুরুষের অসম সম্পর্কের ব্যাপারে নীরবতা ভেঙেছে এবং পরিবারের ভেতরে যে অসমতা এবং নির্যাতন রয়েছে তা প্রকাশ করেছে। তাই পুরুষরা স্বনির্ভর ও সাহসী নারীদেরকে ভয় পায়। তারা ভীত যে, নারীরা চাকরির জন্য তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। 

নারীদের ভূমিকাকে যদি শুধুমাত্র গৃহিণীর কাজ বলে গণ্য করা হয়, তবে প্রয়োজনের সময় তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে রাখা যায় এবং প্রয়োজন ফুরালে তাদের যখন তখন ছাঁটাই করা যায়। 

যদি নারীদের ভূমিকা সম্পর্কিত সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা যায় এবং নারীদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা প্রকাশের সামর্থ্য বৃদ্ধি পায় তবে এই ধরণের বৈষম্য অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হবে না। সকলেই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, পুরুষ বা নারী হিসেবে নয়। তবে পুরুষরা কখনও এই অনিবার্যতাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাবে না। 

নারীবাদ বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সমাজের মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করে। এর ফলে পুরুষরা তাদের বর্তমান অন্যায্য সুবিধাদি হারাবে। এই জন্যে তারা নারীবাদকে ভয় পায়। 


তার মানে কি এই যে, পুরুষরা যদিও উপলব্ধি করতে পারছে না, তবুও শেষ পর্যন্ত নারীবাদ নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই কল্যাণকর হবে? 

ঠিক তাই। নারীবাদীরা সকল প্রকার অসমতা, কর্তৃত্ব এবং নির্যাতন বিলোপ করার মাধ্যমে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে নয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও একটি ন্যায্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই নতুন ব্যবস্থায় অনিবার্যভাবে পুরুষরাও অন্তর্ভুক্ত হবে। এই ব্যবস্থার ফলে অবশ্যই তারা কিছু কিছু সামাজিক সুবিধা হারাবে— তবে অন্যভাবে তারা লাভবান হবে, সমাজও লাভবান হবে। 

যেমন, যদি পরিবারের প্রত্যেক শিশুকে (শুধু ছেলে শিশু নয়) একইভাবে বড় করা হয় এবং তাদের উন্নতির জন্য একই ধরণের সুবিধা এবং উৎসাহ প্রদান করা হয়, তবে পরিবার এবং সমাজ উভয় স্থানেই আরও বেশি প্রতিভা বিকশিত হবে এবং সৃজনশীলতা বাড়বে। যদি নারীদের জোরপূর্বক নির্ভরশীল, অসহায়, অন্যের মুখাপেক্ষী করে রাখা না হয় তবে পরিবারগুলো আরও সম্ভাবনাময়, অর্থনৈতিকভাবে আরও মজবুত এবং সকল দিক থেকেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। 

এই নতুন সমাজে পুরুষদের অর্থনৈতক দায়-দায়িত্ব এবং চাপও কম হবে এবং তারা আরও সহজভাবে তাদের নিজস্ব আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রকাশ করতে পারবে। যে কাজগুলো তথাকথিতভাবে ‘মেয়েলি’ বলে বিবেচিত, তারাও সে কাজ করতে পারবে এবং চাইলেই ঘরে বসে থাকতে পারবে। পুরুষরা যা বর্তমানে নারীসুলভ গুণাবলি হিসেবে বিবেচিত সেগুলোর অনুশীলন করতে পারবে। নানাবিধ জীবনদায়ী কার্যকলাপ যা থেকে এখন পুরুষ বঞ্চিত তাতে তাদের প্রবেশাধিকার ঘটবে। বর্তমান সমাজ পুরুষদের কাছ থেকে যে ভূমিকা ও ভাবমূর্তি দাবি করে নারীবাদ তাদের তা থেকে মুক্ত করে দিত। পুরুশ ও নারী উভয়ই তাদের প্রকৃত স্বভাব বুঝতে সক্ষম হবে। 

নারীবাদীদের উদ্দেশ্য বর্তমান ব্যবস্থায় অর্ধেক স্থান নারীদের দ্বারা পূর্ণ করা নয়, বর্তমান অসম এবং অন্যায্য  ক্ষমতা কাঠামোতে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব অর্জন করা নয় বরং সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন নিশ্চিত করা। 

এছাড়াও, আমাদের মতে নারীবাদ বলতে কেবল নারী কর্তৃক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণা গ্রহণ করা, উপযোগী করা এবং অবলম্বন করাকে বুঝায় না বরং প্রত্যেকটা বিষয়ে পুনঃপর্যালোচনা এবং পুনর্মূল্যায়ন বুঝায়। অন্য কথায়, নারীদের পুরুষদের মতো হয়ে যাওয়াটা নারীবাদ নয়। একটি বিকল্প সংস্কৃতি  তৈরির ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ উভয়ের প্তহের ভেতরে কোনটা ভালো তা অনুসন্ধান করাই নারীবাদের কাজ। 

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন