পুরুষের সৌন্দর্য, নারীর চোখে  

afroja soma
আফরোজা সোমা

টিভি খুব কম দেখা হয়। দেখলেও মূলত নিউজ। নিউজের সময়ই সেদিন দেখলাম এক যুবক মলম দিয়ে বুকের লোম তুলছেন। জানলাম, তিনি বুকের ‘অবাঞ্ছিত লোম’ তুলছেন। শরীরে অনেক লোম থাকায় তিনি নিজেকে যথেষ্ট আবেদনময় ভাবছিলেন না। তাই কাঙ্ক্ষিত রমনীর কাছে যেতে তিনি কুন্ঠিত। বুকের  ‘অবাঞ্ছিত লোম’ তুলে ফেলে যুবকটি আত্মবিশ্বাসী হয় এবং আকাঙ্ক্ষার নারীকে বহুবন্দী করে হাসে। 


বুকের অযাচিত লোম

বিজ্ঞাপনটি দেখে যুগপৎভাবে দুটো অনুভুতি হয়েছে। হায়! বুকের অযাচিত লোম এই ভেবে হাসি লেগেছে। অন্যদিকে মনে হয়েছে, বিউটি বা সৌন্দর্য বিষয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা বদলাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটি তারই প্রমাণ। মানবশরীরের লোমের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক এই বস্তুকেই নারীদের জন্য সৌন্দর্যের পথে বাঁধা হিসেবে তুলে ধরা হয়। ফলে চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে হাত-পায়ের লোম তোলার চর্চা দুনিয়াব্যাপী চলছে। লোম তোলা ইন্ডাস্ট্রির বিশ্ব-অর্থনীতিও বিরাট। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি তথা চোখের আরাম লাগার সংস্কৃতির একটি রাজনৈতিক দিকও আছে। 

যুগ যুগ ধরে নারীকেই পুরুষের চোখের মাপে কোমনীয় ও আকর্ষণীয় হতে হয়েছে। কারণ সমাজের সকল কিছুতে পুরুষই ছিলো সক্রিয় ভূমিকায়। পুরুষই সিদ্ধান্তপ্রণেতা। আদর্শ নারীর গুণ, গজ ফিতায় মেপে নারীর দেহ-সৌষ্ঠব, রূপসী-গুণবতীর আনত থাকার আবশ্যকতা বিষয়ে মান-নির্ধারণকারী ছিলো পুরুষ। পুরুষের নিজের রুপ-গুণের নির্ধারকও সে-ই। অর্থাৎ পুরুষই মুখ্য। নারী উহ্য। তবে দুনিয়া পাল্টাচ্ছে। নানামুখী ঘটনার ঘাতে নারী-পুরুষের রূপ-সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার মাপকাঠি বদলাচ্ছে। 

পুরুষের বুকের লোম তোলা নিয়ে আজকে হয়তো অনেকেই হাসতে পারেন। তাদের কাছে বুকের লোমকে ‘অযাচিত’ ভাবাটাই অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটির মধ্যে রয়েছে সমাজ বদলের ইশারা। কারণ এই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠা করছে যে সৌন্দর্য এখন পুরুষেরও গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। তাই পুরুষ নিজের শারীরিক উপস্থাপন নিয়ে ভাবছে। বিশ্বব্যাপী নারীরা কর্মে যুক্ত হচ্ছেন। নিজেদের প্রেম-বিয়ে-পছন্দ-অপছন্দ-যৌনতা নিয়ে স্পষ্টভাবে বলছেন। ফলে বিত্তশালী বা ক্ষমতাবান হলেই এখন পুরুষের চলছে না। পুরুষের ‘লুক’ বা তার সৌন্দর্যও প্রয়োজন হচ্ছে।  


চাই লম্বা পাত্র, পাত্রের মাথাভরা চুল

আমার পরিচিত এক অবিবাহিত তরুণীর কথা বলি। তার পরিবার পাত্র খুঁজছে। তবে তিনি আগেই জানিয়েছেন, টাকওয়ালা পাত্র আবেদনের অযোগ্য হবেন। এ ছাড়া পাত্র হওয়াও আবশ্যক। হঠাৎ করে এমন শুনতে একটু ধাক্কা লাগে, তাই না? কিন্তু কনের জন্য কি সমাজটা আজও  এ রকম নয়? যুগ যুগ ধরে পাত্রপক্ষ খুঁজেছে কনের দুধে আলতা গায়ের রং, দীঘল কালো কেশ এবং ইত্যাকার নানা কিছু। কিন্তু কনের চাওয়া কেউ জানতে চায়নি। জিজ্ঞাসার এই সংস্কৃতিই ছিল না। সমাজ মনে করতো, পাত্র যদি ভালো আয়-রোজগার করতে পারে, বউকে যদি শাড়ি-গয়না দিয়ে সুখে রাখতে পারে, তবেই হলো। এই মনোজগতেই তৈরি হয়েছে প্রবাদ, পুরুষ হচ্ছে সোনার আংটি। 

আজকাল অনেক নারী নিজের ভাত-কাপড় নিজেই কামাই করছেন। অর্থ-স্বাধীন নারীরা পুরুষের সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার চিরায়ত বয়ানকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন। ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’ বলে একটি প্রবাদ আছে। যার অর্থ পুরুষের চরিত্রে যদি একটু খুঁত বা দাগও থাকে, তবুও তার মর্যাদা বা কদর কমে যায় না। কিন্তু দুনিয়া কাঁপানো মি টু মুভমেন্ট এসে সেখানেও আঘাত করেছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে অনুচ্চারে একাধারে দুটি কাজ  হয়েছে। একদিকে চরিত্রহীন পুরুষেরা নিজেদেরকে চরিত্রবান প্রমাণ করার পরোক্ষ চাপ বোধ করবে। অন্যদিকে পুরুষের এই চাপবোধ করার বাস্তবতার কারণেই নারীরা আরো সক্রিয় রূপে আবির্ভূত হবেন। 


গ্রন্থিল বাহু বনাম পুরুষের কোমল কান্তি

সক্রিয় নারী সক্রিয় ভোক্তাও বটে। ফিল্ম বা মিউজিক ভিডিওগুলোতে আগে সাধারণত নারীকেই উপভোগ্য, কমনীয় বা দেখনসুখের বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হতো। সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে দেখবেন নায়কদের দেহসৌষ্ঠবের সতর্ক উপস্থাপন রয়েছে। পুরুষের সিক্স প্যাক দেখিয়ে পরিচালক শুধু পুরুষ দর্শকই ধরতে চান না। বরং নারীদেরও বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে চান। সঞ্জয় লীলা বানসালি ‘সাভারিয়া’ ফিল্মে রণবীর কাপুরের তোয়ালে পরা নাচটা খেয়াল আছে? শরীরের খাঁজ-ভাঁজ দেখানোর নাচটির উদ্দিষ্ট দর্শক কি শুধুই পুরুষ? মোটেও না। নারীরাও এই নাচ চানাচুরের মতো খেয়েছেন।  

ক্যাপিটালিজমের ঈশ্বরের নাম মুনাফা। মুনাফা অর্জনের জন্য বেনিয়ারা সব পারে। বেনিয়ার হিসাবে হিজাব পরিহিতা জন্য হিজাব রিফ্রেশ শ্যাম্পু থেকে সৌন্দর্য আমার অধিকার— সবই জায়েজ। মুনাফার প্রয়োজনে বণিকেরা নারীর ক্লিভেজ দেখিয়ে পুরুষদের কাত করবে আর নারীদের কাত করতে বাজারে আনবে মোহনীয় সৌষ্ঠবের পুরুষ। প্রশস্ত উদোম বুক, সিক্স প্যাক শরীর, গ্রন্থিল পেশি দেখে নারী দর্শকরা ভক্ত হবে। বেনিয়ারা সবার জন্য ‘অপশন’ বা বেছে নেবার স্বাধীনতা রাখতে চায়। এই বাজারে কোনো নারী রাফ এন্ড টাফ লুক, শক্ত চোয়ালের পোড়খাওয়া চেহারার নায়ক বেছে নেবেন। কোনো নারী বেছে নেবে রনবীরের লাল ঠোঁট। কোমল-কমনীয় চেহারা নিয়ে রণবীরের চোখ মেরে দেওয়ার দৃশ্য এবং তার তোয়ালে খোলা নাচ দেখে কত নারী সম্মোহিত হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়েছিলো তার ইয়ত্তা আছে?

নানামুখী ঘটনার ঘাতে নারী-পুরুষের রূপ-সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার মাপকাঠি বদলাচ্ছে
অলংকরণ: রাজিব কান্তি

নিজের কথাই বলি। বয়স তখন আরও বছর দশ-বারো কম। তখন আমি ব্র্যাড পিটের পাগল ভক্ত। পিটের অনেক সিনেমায় শুধু তার অংশগুলো ৫/৭/১০ বারও দেখা হয়েছে। ট্রয়, রিভার রান্স থ্রু ইট, মি জো ব্ল্যাক, লিজেন্ডস অফ দি ফল, কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন, সিনেমাগুলোতে পিটকেই গিলতাম। এমনকি তার সাম্প্রতিক সিনেমা ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড- এ ব্র‍্যাড পিট যখন গল্পের এক পর্যায়ে শার্ট খুলে উদোম গায়ে বাড়ির চালে উঠে এন্টেনা ঠিকঠাক করছিলো, সেই দুশ্যও চুম্বকীয়। কাজের ফাকে বিরতি দিয়ে পিট সিগারেট ধরায়। সে সময় ক্লোজ আপে তার মুখ পর্দায় ভেসে ওঠে। পঞ্চাশোর্ধ সেই পোড়খাওয়া চেহারার আবেদনও ‘মারডালা’। বাড়ির চালে তুলে ব্র্যাড পিটকে দিয়ে পরিচালক এমনি এমনি কাপড় খোলাননি। কর্তারা জানেন, পিটের বুকে থাকা কচি কচি ঘাসের মতো লোম, তার ঘন লালচে চুল, তার লম্বা গড়ন, প্রশস্ত বুকের ছাতি, পোড়খাওয়া ড্যাম কেয়ার ভাবের চেহারা দেখতে দেখতে ভক্তরা মুখিয়ে আছে।  

সৌন্দর্য বেচে পয়সা কামানোর এমন মওকা বেনিয়ারা হাতছাড়া করবে না। তাই নারীর শরীরের মতোই পুরুষের শরীরের পণ্যায়নও এখন বেশি মাত্রায় গোচরে আসবে। মানুষের পণ্যায়ন করা ঠিক না বেঠিক, সেটি ভিন্ন বিতর্ক। সেটি অন্য দিনের জন্য তোলা থাকুক। বক্ষ্যমান লেখায় এটুকু বলে শেষ করতে চাই যে পুরুষরাও এখন সৌন্দর্য বিতানে ছুটছেন। ক্যাপিটালিজমের নারীর পায়ের লোম উঠানোকে শুধু গ্রহণযোগ্যতাই দেয়নি বরং এক প্রকারের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা পরিণত করেছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে এমনকি সুইমিং পুলে যাবার আগেও অনেক নারীই হাত-পায়ের লোম উঠানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এই তালিকায় যোগ হয়েছে পুরুষের বুকের লোম। সৌন্দর্যভাবনায় নয়া নির্মিতি বটে। 


কোনো পুরুষের বুকে লোম না থাকলে সেই পুরুষের বুককে আমাদের গ্রামদেশে সীমারের বুকের সাথে তুলনা করতো। লোমহীন বুকের পুরুষকে ভাবা হতো পাষাণ, নির্দয়। আর বুকে ঘন লোম মানে হৃদয়ে অধিক মায়া। কিন্তু চিন্তা পাল্টাচ্ছে। এখন বুকে অনেক লোম থাকা পুরুষের মনে অস্বস্তি উৎপাদন করে মলম বিক্রি করতে চায় বেনিয়ারা। পুরুষের এই অস্বস্তি আসলে সমাজের রক্ষণশীলতা ভাঙারও আভাস। 

বুকের লোমের সাথে দয়া-মায়ার সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। তবে ক্যাপিটালিজমের বুকে কোনো দয়া-মায়া নেই। বেনিয়ারা মুনাফায় রাশ টানতে জানে না। তাই নারীর হাত-পায়ের লোমের মতোই এখন পুরুষের বুকের লোমও পেয়েছে ‘অযাচিত’ তকমা। এই দুই ধরণের ‘অযাচিত’ লোম মিলে আমার হিসেবে দুটি ‘যাচিত’ ব্যাপার ঘটেছে। প্রথম যাচিত বিষয়টি হচ্ছে, নারী ও পুরুষের মধ্য পণ্যায়নের একটা বিশেষ ঐক্য। যদি পুরুষের বুকের লোম তোলাটাকে মানুষ হাস্যকর অদরকারী মনে করে, তাহলে নারীর লোম তোলা নিয়ে প্রশ্নের জোরও বাড়বে।   

দ্বিতীয় যাচিত বিষয়টি হচ্ছে, পুরুষেরা যতই কামাই করুক না কেন, নারীর মনের মতো হতে গিয়ে এখন তাকে মাখতে হচ্ছে রং ফর্সাকারী ক্রিম, তুলতে হচ্ছে বুকের লোম, করতে হচ্ছে চুলের যত্ম, রূপচচা করার জন্য যেতে হচ্ছে সৌন্দর্যবিতানে। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বলতেই এখন আপনি শুধু নারীকে বুঝবেন না। বরং এখানে পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডারও অন্তর্ভুক্ত হয়। তাছাড়া ভিটের এই বিজ্ঞাপনের ভেতর দিয়ে অলক্ষ্যেই নারীর পছন্দও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কচি ঘাসে ছাওয়া প্রান্তর নাকি মসৃণ-পেলবতা? এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে  মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে পুরুষের সৌন্দর্যে। লক্ষ্য করুন, পুরুষের শৌর্য-বীর্য নয়, সৌন্দর্য। সময় আসছে যখন শুধু নারীর সৌন্দর্য নয়, বরং তার সাহস-বীরত্ব নিয়ে বেশি কথা হবে। রক্ষণশীল সমাজে এটা বড় বদল। 

থেকে আরও পড়ুন

  • very good

    • thanks

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন