কমলা ভাসিন-এর নারীবাদ পরিচিতি । পর্ব-১ 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন

 

পিতৃতন্ত্র শব্দটি প্রায়ই শোনা যায়। সংক্ষেপে পিতৃতন্ত্র বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি? 

শব্দটির অর্থ পিতার বা গোষ্ঠীপ্রধানের শাসন। শব্দটি এমন এক সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে পুরুষই পরিবারের সকল সদস্যদের সম্পর্ক, সম্পত্তি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে আর সকল বিষয়ে মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেয়।

এই সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয় যে, পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, পুরুষদের দ্বারা নারীদের নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ আর নারীরা পুরুষের সম্পত্তি।  এই চিন্তাধারা আমাদের অনেক ধর্মীয় আইন ও অনুশীলনের ভিত গঠন করেছে। এই মতাদর্শ সমাজের এসব আচার-ব্যবহারকে বৈধতা দেয় যা নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখে, তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।  

আমাদের নৈতিক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, আমাদের আইন-কানুন ও ব্যবস্থা যা নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি অধিকার ক্ষমতা প্রদান করে তা পিতৃতান্ত্রিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এগুলো ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় পরিমণ্ডলে নারীদের নির্যাতিত করে এবং পুরুষদের অধীন করে রাখে।

ঘরকন্নায় বেশি সংশ্লিষ্ট হওয়ায় নারীরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে কম উৎপাদনক্ষম— নারী-পুরুষের অসমতাই কি এর প্রকৃত কারণ নয়? 

পরিবারের প্রধান হিসেবে একজন পুরুষ একটি ‘পরিবার মজুরি’ পায় –এই মতের ভিত্তিতে ধনতন্ত্র উপরের যুক্তিটি ব্যবহার করে। ‘পরিবার মজুরি’ হলো পরিবার প্রধান, তার স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরণপোষণের খরচ। এই মতে, কারখানায় নিযুক্ত নারীরা সংসারের জন্য অতিরিক্ত আয়ের উদ্দেশ্যে কাজ করে। তাই কাজটি সমান গুরুত্বের হলেও, তাদের কম মজুরি দেওয়া হয়।

বাস্তবতা কিন্তু আলাদা। এ বিষয়ে গবেষণা থেকে জানা যায়, অনেক দেশে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পরিবার চলে নারীদের উপার্জন দ্বারা অথবা এক নারী অভিভাবকের আয়ে। এ নারীদের অধিকাংশই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে অথবা অল্প বেতনে চাকরি করে এবং কর্মক্ষেত্রে উপরোক্ত ধনতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক শর্তাবলির দ্বারা অসমতার শিকার হয়। 

এও সত্যি কথা যে, কলকারখানা, মাঠ অথবা ফসলের ক্ষেতে কাজ করা ছাড়াও নারীদের পারিবারিক কাজে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়, যেমন- রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাজাঘষা, অন্য জায়গা থেকে পানি আনা, জ্বালানি কাঠ আনা, শিশুদের যত্ন নেওয়া এবং আরও অনেক কিছু। 


সুতরাং  নারীদের দ্বিগুণ দিন, দ্বিগুণ বোঝা, দ্বিগুণ শিফটের কাজ করতে হয়। অর্থের বিনিময়ে কাজের বোঝা (মোট শ্রমশক্তির অংশ হিসাবে) ও বিনা পয়সার কাজের বোঝা (যেমন, ঘরের কাজ) বহন করতে হয়। এই দ্বিগুণ ভার, নারীদের পক্ষে ভালো কাজ সংগ্রহ করা, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং পেশার উচ্চতর ধাপে ওঠা কঠিন করে ফেলে। শিক্ষায় কম সুযোগ পাওয়ার কারণে কম দক্ষতার এবং স্বল্প বেতনের চাকরিতে ঢোকে।  

অবশ্য, এতগুলো কারণ সত্ত্বেও কেউ বলতে পারবে না যে নারীরা তাদের কাজে কম উৎপাদনক্ষম। প্রকৃতপক্ষে, অনেক শিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কারণ, তারা অধিক পরিশ্রমী, হাতের কাজে পারদর্শী এবং সুশৃঙ্খল। 

এতকিছু সত্ত্বেও, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আধুনিকায়নের সাথে সাথে নারীরা সমাজে তাদের যথাযথ স্থান পাবে। তাদের অবস্থান শুধু ঘরেই থাকবে না। তারা বাইরের পৃথিবীতে পদার্পন করে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করবে।

বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ছেলেদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া থেকে মেয়েদের আলাদা করে রাখছে; এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে কর্মশক্তির বাইরেই রাখা হচ্ছে।  

উদাহরণ হিসেবে উভয় পাঞ্জাবের (ভারত ও পাকিস্তান) সবুজ বিপ্লবের কথা বলা যায়। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজে অংশগ্রহণ থেকে নারীরা বাদ পড়ে যায়। সেখানে কৃষির আধুনিকায়নের সাথে সাথে কারিগরি জ্ঞানের দরকার হলো এবং যেহেতু আধুনিক কারিগরি জ্ঞান প্রধানত পুরুষদেরই রয়েছে বলে মনে করা হতো, তাই নারীদেরকে অন্যায়ভাবে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হলো। 

এছাড়া এসব ব্যবস্থার ফলে পুরুষ কৃষকরা অতিরিক্ত সম্পদ উপার্জন করা শুরু করলো। আর তার ফলে তাদের পক্ষে পরিবারের মেয়েদেরকে ঘরে বন্দি করে রাখা সম্ভব হলো— যা তাদের সমৃদ্ধি ও বর্ধিত সম্মানেরই তথাকথিত পরিচয়। 

শ্রীলঙ্কার মহাভ্যালি প্রকল্পের ফলাফলও একই ধরণের সমস্যা তৈরি করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে স্বাধীন নারী কৃষকদের জন্য অতি সামান্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে এ সকল নারী বঞ্চিত হয়েছে। এভাবে তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে স্বল্প বেতনের কাজের দিকে অথবা আবারও ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের সব সুযোগ। 

একই অবস্থা চলছে বাংলাদেশ ও নেপালে। সে কারণে বর্তমানে প্রচলিত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন ব্যবস্থা আমাদের দেশের নারীদের প্রকৃত সম্মান ও অবস্থার উন্নতি সাধন করবে, সেই আশা ক্ষীণ। এ অবস্থার দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরা আর বর্তমানের চেয়ে ভালো নীতি ও ব্যবস্থার দাবি করা প্রয়োজন। যাচাই-বাছাই এবং এতে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে নারী গবেষকদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র ও নারীদের জন্য বর্তমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া হলো ‘অপউন্নয়ন’ এবং ‘পুরুষের উন্নয়ন’। 

যে নারী শুধু একজন গৃহিণী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে কি নারীবাদী বলা যায়?

প্রথমত, একজন গৃহিণী কাজের ব্যাপ্তি জানা সত্ত্বেও আমাদের কখনও ‘শুধু’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিৎ নয়। নারীবাদীরা কখনও গৃহিণী কিংবা ঘরের কাজকে হেয় করে নি বা নিচু চোখে দেখে নি। আসলে ঘরের কাজকে মূল্যবান মনে করা ও যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্রধান দাবিগুলো অন্যতম। যদি গৃহিণীরা তাদের কাজের প্রাপ্য মর্যাদা, পরিচিতি ও মূল্য পায়, তবে পুরুষরা বুঝবে শুধু তাই নয়, তারা হয়তো ঘরের কাজে অংশহণ করাও শুরু করবে।  

বিশ্বজুড়ে নারীবাদীদের সংগ্রামই বাধ্য করেছে সব সরকারকে গৃহিণীদের মজুরিবিহীন কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করতে এবং এভাবে নারীদের অবদান সম্পর্কে সচেতনতা আনতে।  ১৯৯৫ সালের ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে, নারীদের সকল কাজের মোট মূল্য এসে দাঁড়ায় ১১ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার ( ১ ট্রিলিয়ন = ১০০০ বিলিয়ন এবং ১ বিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন বা ১০০ কোটি)। 

স্বেচ্ছায় গৃহিণী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত যে নারী নেন এবং মনে করেন এতেই তার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটবে, তাকেও নারীবাদী বলা যায়। নারীবাদী মানে এমন না যে সে ঘরের বাইরেই কাজ করবে। 

আসল কথা হলো, সমান সুযোগের ভিত্তিতে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের ধারণা, নারীদের যদি সুযোগ থাকতো তাহলে শুধুমাত্র গৃহিণী হিসেবে কাজ করার চেয়ে অন্য কোনো কাজও তারা বেছে নিতো। তবে এ ধরণের সিদ্ধান্ত অবশ্যই স্বতস্ফূর্ত ও বাধ্যবাধকতামুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো শর্তসাপেক্ষে, কিংবা কোনো রকম পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ চাপের মুখে, অথবা অন্য কোনো উপায় না দেখে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়।

কোনো সিদ্ধান্ত শর্তসাপেক্ষে নেয়া হচ্ছে, না কি শর্ত ছাড়াই নেয়া হচ্ছে, এটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। 

এক্ষেত্রে আরো একটা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। একজন নারীবাদী অবশ্যই গৃহিণীর পেশা বেছে নিতে পারবেন, যদি এ পেশায় তিনি সন্তুষ্ট থাকেন ও তার ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখতে পারেন । আর তিনি আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নন বলে তার স্বামী তার উপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি না করেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্য অবশ্যই সাম্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা উচিৎ। নারীবাদ শুধুমাত্র নারীদের কী করা উচিৎ এবং কী করা অনুচিত তা নির্ধারণ করার জন্য নয়। নারীবাদীরা এমন একটি সমাজের জন্য সংগ্রাম করছে, যেখানে একজন মেয়ে স্বাধীনভাবে তার জীবন বেছে নিতে পারবে, যেখানে সে গৃহিণীর পেশা বেছে নিতে বাধ্য নয়, যেখানে তাকে গতানুগতিক ‘মেয়েলি’ চরিত্রের অধিকারী এবং স্বপ্ন বেতনের ‘মেয়েলি’ চাকরি করতে হবে না এবং সর্বোপরি, যেখানে নারীদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হবে। 

আমরা নারী-পুরুষের অসমতারও একইভাবে বিরোধিতা করছি। 

প্রতিটি মেয়েরই, তার ইচ্ছা এবং যোগ্যতায় সে কী করবে, সে কী করতে চায় সে বিষয়ে সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকা উচিৎ। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে পুতুল, হাড়ি-পাতিলই তার খেলনা হবে না; যে বস্ত্রে তার শিরা উপশিরা আচ্ছাদিত থাকে, শুধু তাই তার কাপড় হবে না; তাকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ করে রাখা চলবে না, কিংবা শুধুমাত্র স্বামীর পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাকে বিনীত হতে হবে— এটাও আমরা মনে করি না। 

নারীবাদীদের চিন্তাধারাগুলো খুবই সহজ এবং যুক্তিযুক্ত।

নারীবাদীদের ধ্যানধারণা শুধুমাত্র হাতেগোনা কিছু ‘নারী ইস্যু’ যেমন, ধর্ষণ, স্ত্রীকে প্রহার করা, বন্ধ্যাত্ম এবং সমান মজুরি ইত্যাদি ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গেই নারীরা জড়িয়ে আছে কারণ সবই আমাদের প্রভাবিত করছে। 

সব ইস্যুই নারীবাদী ইস্যু। নারীবাদীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য, অসমতা, আধিপত্য ও বঞ্চনা দূর করে একটি ন্যায়সম্মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তারা জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল বিষয়কে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পৃক্ত করে সচেষ্ট। 

১৯৯৫ সালে বেইজিং কনফারেন্সের স্লোগান অনুসারে, নারীবাদীরা মনে করে ‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’।

যেহেতু সকল ইস্যুই নারীদের ইস্যু, সব বিষয়েই নারীদের নিজস্ব মতামত থাকা উচিৎ, হোক সেটা পরমাণু যুদ্ধ, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ, সাংস্কৃতিক সংঘাত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং উন্নয়নমূলক নীতি, মানবাধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা কিংবা পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়। সত্যিকার অর্থে, সীমিত মানব সমপদ সত্ত্বেও এবং অন্যান্য সম্পদের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও নারী সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই এ ধরণের কাজে জড়িত হয়েছে। 

শ্রীলঙ্কায় নারীরা সক্রিয়ভাবে উপজাতীয় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাইছে। পাকিস্তানে নারীরা ধারাবাহিকভাবে এবং খুবই দুঃসাহসিকতার সঙ্গে প্রাচীন নারীবিরোধী আইনগুলোর বিরোধিতা করছে– যেগুলো নারীদের উপর এবং পাকিস্তানী সমাজের উপর ইসলামের নামে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানি নারীরা সামাজিক আইন ও ইসলামী মৌলবাদেরও বিরোধিতা করে আসছে। নেপালে নারীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশে নারীবাদীরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও রাষ্ট্রের মৌলবাদী আন্দোলন, পরিবেশ বিপর্যয় ও ‘গরিব-বিরোধী’ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশীদার।  

ভারতে নারীরা পরিবেশ রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী সংগ্রামসহ অনেক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের দলগুলো নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিসমূহের সমালোচনা করে এবন জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও তারা পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার এবং সামরিকীকরণের বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। 

নারীবাদীরা কি ছোট ছোট বিষয়ে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে না? যেমনঃ কোনও নারীকে ‘চেয়ারম্যান’ বলাতে ক্ষতি কী? বাস্তবিকপক্ষে আমরা কি সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে পারবো?

আমাদের বৃহত্তর আন্দোলন ও প্রচারণাগুলো কখনও ভাষাকে প্রধান একটি বিষয় হিসেবে দেখে নি। তবুও আমরা ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করায় এবং পরিবর্তনের গুরুত্ব খুঁজে পাই। কেননা, ভাষাও পুরুষতান্ত্রিক।  

আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ভাষা ও শব্দ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের ভাষাগুলো জেন্ডারভিত্তিক। ভাষাও পুরুষের শ্রেষ্ঠতা ও প্রাধান্য বহন করে। নারীদের হেয় ও বর্জন করে। ধর্ম ও মতাদর্শের মতো ভাষাও পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণের পক্ষপাতী হয়ে থাকে। তবে আমরাই বা কেন এই রকম কিছু মেনে নেবো যা সমাজের আমাদের অস্তিত্ব ও প্রকৃত অবদান কোনোটাই স্বীকার করে না, আমাদের বিরুদ্ধে প্রভেদ সৃষ্টি করে। আমাদের অপমান করে।

আগের দিনে যখন নারীরা প্রকাশ্যে বৃহত্তর অনেক ক্ষেত্রেই প্রবেশ করে নি অর্থাৎ যখন সভা পরিচালন, খেলাধুলা সাংবাদিকতা বা অন্যান্য ধরণের পেশা গ্রহণ করে নি, যখন কোনো নারী ‘বৈজ্ঞানিক বা ধর্মতাত্ত্বিক ছিল না, তখন চেয়ারম্যান স্পোর্টসম্যান , মিডিয়াম্যান এই ধরণের ভাষা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করতো। 

ভাষার এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন সেকেলে হয়ে গেছে, কারণ সামাজিক বাস্তবতাও পালটে গেছে। এখন নারীরাও সক্রিয়ভাবে এ ধরণের কাজ করছে। এসব কাজে নারীদের বেশি মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে। তাই এসব ক্ষেত্রে চেয়ারপার্সন, স্পোর্টস-পার্সন, মিডিয়া পার্সন, নারী ইত্যাদি শব্দগুলো না আসার কোনও কারণ নেই। 

নারীদের প্রতি ভাষাগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য খুব বেশি প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এই শব্দগুলো ব্যবহার করা এবং শব্দকোষের অংশ করে তোলার জন্য প্রয়োজন কেবল সচেতন প্রচেষ্টার। অবশ্য ঠাট্টার ছলে আমাদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন যে, আমরা ‘নরখাদক’ ও ‘ম্যানহোল’ এর মতো শব্দগুলো পরিবর্তন করার উপর জোর দেবো না!

নারীবাদীরা কি বিয়ে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে নয়? আর তারা কি শান্তিপূর্ণ সংসার ধ্বংস করছে না? 

আমরা কোনো দেশের এমন কোনো নারীবাদী সম্পর্কে জানি না যিনি বলেছেন তিনি বিয়ে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে। তবে আমরা এমন অনেককেই জানি যারা অসুখি, অসম, অন্যায্য বিয়ে এবং সংসারের বিরুদ্ধে। অনেক নারীবাদী  বাস্তবিকভাবেই সংসার ধ্বংস করতে পারে (শান্তিপূর্ণ দিকটির প্রতি আমরা পরে মনোযোগ দেব)। তবে তা শুধু সেভাবেই যেভাবে হরিজনরা একটি ‘শান্তিপূর্ণ সম্প্রদায়’ ধ্বংস করে, যখন তারা অবমাননাকর কিছু গ্রহণ করতে অসম্মত হয়। অথবা কৃষক/শ্রমিকরা যখন কোন জমিদার/শিল্পপতির সামনে দাঁড়িয়ে আপোষহীনভাবে ন্যায় বিচার চায়। 


একজনের শান্তি অন্য ব্যক্তির অশান্তির কারণ হতে পারে। নারীদের জন্য এটা কি অন্যায় যদি সে গৃহের অভ্যন্তরের নিপীড়ন সম্পর্কে নীরবতা ভাঙে?

যদি কোনও নারী তার গুরুত্বহীন জীবন, কঠোর পরিশ্রম, যান্ত্রিকতা ও একঘেয়ে গৃহকর্ম এবং প্রতি বছর সন্তান প্রসব ইত্যাদিতে বিরক্ত হয় এবং প্রতিবাদ করে, তাকে কি ‘সংসার বিধ্বংসী’ বলা যায়? যে নারী তার স্বামীর ছায়া হতে চায় না, যে শুধুমাত্র তার স্বামীর ইচ্ছাগুলোর প্রতিধ্বনি করে না, সে তার জীবনের বাকি সময় স্বামীর ক্যারিয়ার গড়ার জন্য অথবা শুধুমাত্র স্বামীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে অস্বীকার করে, তাকে কি আমরা সমস্যা সৃষ্টিকারী বলতে পারি? 

যে নারী তার নিজের জন্যেও বাঁচতে চায়, যার নিজস্ব স্বপ্ন এবং লক্ষ্য আছে, যে একজন আদর্শ, বাধ্য অবরুদ্ধ স্ত্রী হতে চায় না, সে কি সংসার নষ্টকারী? প্রকৃত বিচারে, এসব ক্ষেত্রে পুরুষই কি ‘সংসার ধ্বংসকারী’ নয়? 

যদি কোনো নারী সম্মানজনক আচরণ চায়, তার পরিবার ও তার স্বামী যদি তা না দেয়, তবে নিশ্চয়ই নারীদের উপর গৃহের শান্তি নষ্ট করার দোষ চাপিয়ে অন্যদের উপরে চাপানো উচিত। 

নারীবাদীরা ( যারা সম্মান ও মর্যাদা চায়) মনে করে, সংসারে অশান্তি থাকলে  ভালো থাকা যায় না। কারণ, বেশির ভাগ সংসারে ‘শান্তিপূর্ণতা’ হচ্ছে একটি ঘরের সামনের ছবি, যার পেছনে অনেক নারীর অনুভুতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আবেগ এবং স্বপ্ন বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকে। 

যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা এই ধরণের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শান্তি বিরাজ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা পুরুষদেরকে ঘরের কাজে সহায়তা করতে বলে না, রাতের বেলা জেগে-ওঠা ক্রন্দনরত শিশুর পরিচর্যা করতে বলে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শান্তি বজায় থাকে। যখনই নারীরা সমতা এবং ন্যায় বিচার চাইতে শুরু করে, তখনই সমস্যার শুরু হয়। যখন নারীরা যন্ত্রণা, অপমান আর হতাশায় ক্রুদ্ধ হতে শুরু করে এবং যখন তারা তা প্রকাশ করতে শুরু করে, তখনই শান্তি নষ্ট হতে থাকে। আর তাদেরকে এই ধরণের মন্তব্য শুনতে হয় যে ‘সারাদিনের পরিশ্রমের পর এই ধরণের অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হতেই কি আমি ঘরে ফিরে আসি?’ 

একজন নারীকে
তখনই নারীবাদী বলা হয়
প্রতি মুহূর্তে সে যখন
পাপোশের মতো ব্যবহৃত হতে চায় না। 

আসুন আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ গৃহের দিকে আরেকটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিই। 

পরিবারের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব, চাপা উত্তেজনা ও অত্যাচারের প্রচুর নজির আছে। সমাজের সকল স্তরেই অসংখ্য পরিবারের স্ত্রীরা চোখ রাঙানি, নির্যাতন এবং অপমানের শিকার। দক্ষিণ এশিয়ার হাজার হাজার পরিবারে মেয়ে শিশুর জন্মকেই অশুভ লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের মধ্যে মেয়ে ও শিশু হত্যার অপরাধ ঘটে চলেছে। এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে, ভারতীয়রা নারী ভ্রুণ হত্যাও ঘটাচ্ছে। অনেক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ছেলে শিশুদের তুলনায় মেয়ে শিশুদের কম সময় বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, কম খাবার দেওয়া হয় এবং কম চিকিৎসা প্রদান করা হয়। 

নারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনগুলোর প্রতি খুব সামান্যই নজর দেয়া হয়। প্রতি বছর দক্ষিণ এশিয়ায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাজার হাজার অল্পবয়সী নারী মৃত্যুবরণ করে।
নারীদের বিরুদ্ধে এই সকল অবহেলা এবং নির্যাতনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার-সমতার হার ভয়ংকর রকমের কম। পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন, অবহেলা, বৈষম্যের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ মিলিয়ন নারীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কি নারীদের শান্তির উদাহরণ? 

নববধুদেরকে অপর্যাপ্ত যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারা হয়, তালাক দেয়া হয় অথবা আত্মীয়স্বজনরা তাদের শারীরিকভাবে আহত, হত্যা করে। এটাও কি নারীর শান্তিপূর্ণ জীবনের নমুনা?

নারীবাদীদের মাধ্যমে নয় বরং আমাদের সরকার আর জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, পরিবারই সম্ভবত নারী শিশুদের জন্য সবচাইতে অনিরাপদ স্থান! 

দ্বন্দ্ব ও অবিচারে পূর্ণ পরিবারগুলোর ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে নারীবাদীরা চেষ্টা করছে পরিবারের সুখ শান্তি প্রতিষ্ঠার। 

একজন ডাক্তার যিনি আমাদের দেহের অসুস্থতা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন, তাকে নিশ্চয়ই আমরা শত্রু বলে অভিহিত করতে পারি না। আমরা সেই ডাক্তারের কাছেই যাই যে ডাক্তার রোগ নির্ণয়ে দক্ষ। ঠিক তেমনই নারীবাদীদের সাহস, সরলতা এবং আমাদের পরিবারের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন করার জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে অভিনন্দিত করা।

যারা যে কোনও মূল্যে প্রচলিত অন্যায়ভিত্তিক শান্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের তুলনা করা যেতে পারে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে যারা বর্ণপ্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এবং ভারতীয় গ্রামগুলোর তথাকথিত সংহতি সংরক্ষণ করতে চায়; অথবা জমিদারদের সঙ্গে যারা দাসত্বমূলক শ্রমিকপ্রথা বজায় রাখতে চায়। 

এটা কি ন্যাক্কারজনক নয় যে, মেয়েদের কথা উঠলেই প্রগতিশীল লোকেরা ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যাকুল হন?

কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি কোনও ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলে এবং পরিবর্তন আনলে তারা ঐতিহ্য বিনাশের দায়ে অভিযুক্ত হয়। সংসার ধ্বংস করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই কি দায়ী নয়? যখন অধিকাংশ নারীবাদীই সংসার ও পরিবারের বিরুদ্ধে নয় তখন আমরা উভয়কে রক্ষা করার একটি মাত্র পথ হিসাবে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন পাল্টানোর জন্য কাজ করার অবস্থান নিতে পারি। 

নারীদের ক্ষতি সাধন করে সংসারের শান্তি ও সামঞ্জস্য আর রক্ষা করা যাবে না। 

আমরা পরিবারের ভেতর পুরুষদের একনায়কতন্ত্র মেনে নিয়ে পরিবারের বাইরে গণতন্ত্র সম্পর্কে বড় বড় কথা বলতে পারি না। 

আমরা প্রকৃত পক্ষে বিশ্বাস করি যে, গণতন্ত্র, নারী-পুরুষের সমতা সমাজে সত্যিকার অর্থে তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যখন আমরা আমাদের পরিবারগুলোতে গণতন্ত্র, সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা করতে পারবো।সমাজের সত্যিকারের শান্তি কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যখন আমরা পরিবারে শান্তি অভিজ্ঞতা লাভ করবো। 

অনেক নারীবাদিই মনে করেন যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত মনোনয়ন ও পছন্দের ভিত্তিতে পরিবার, বিয়ে এবং পার্টনারশিপের বিভিন্ন ধরণ হতে পারে।  হেটারোসেক্সুয়াল কার্যকলাপ এবং বিয়ে হচ্ছে একট ধরণ এবং হোমোসেক্সুয়াল পরিবার এবং বিয়ে হচ্ছে আরেক ধরণ।  

কেউ ইচ্ছা করলে বিয়ে না করেও একসঙ্গে বসবাস করতে পারে আবার কয়েকজন মিলে একট সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারে, যেখানে তারা পারিবারিক দায়িত্ব ও ধনসম্পত্তি সমভাবে ভাগ করে নিতে পারবে। 

নারীবাদীরা কী মাতৃত্ববিরোধী? 

 এ ধরণের প্রশ্ন কেন? মাঝে মাঝে আমাদের এমন সব প্রশ্ন করা হয় এবং নারীবাদীদের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ করা হয় যা খুবই বিরক্তিকর। এই ধরণের প্রশ্নগুলো বারবার নারীবাদীদের অস্বস্তিকর অবসথায় ফেলে দেয়।

সুস্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে নারীবাদীরা সন্তান গ্রহণের বিরুদ্ধে নয়। তবে মাতৃত্বকে প্রত্যেক নারীর একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে আমরা গণ্য করতে পারি না। নারীত্বকে মাতৃত্বের সমকক্ষ বলেও আমরা মনে করি না। 

আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক নারীর সন্তান নেয়া বা না নেয়ার ব্যাপারে তার নিজস্ব পছন্দ থাকা উচিত। বর্তমানে আমাদের অনেক দেশেই আইনগত সামাজিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক কোনোভাবেই এই ধরণের পছন্দ করার সুযোগ নেই। অতএব নারীরা যাতে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দিতে পারে, সেই জন্য আমাদের সংগ্রাম। 

এছাড়া আমরা মনে করি, যদিও একজন নারীই একটি সন্তান ধারণ করতে পারে, কিন্তু যে কেউ (পুরুষও হতে পারে) সে শিশুকে লালন-পালন করতে পারে এবং তাকে মায়ের স্নেহ দিতে পারে। 

মাতৃত্ব বলতে কেবল শারীরিকভাবে সন্তান জন্ম দেয়াকেই বোঝায় না। এর অর্থ আরেকজন মানব সন্তানের দেখাশোনা, সেবা এবং তত্ত্বাবধান করা। এর অর্থ আরেকজন ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে, আবেগ দিয়ে এবং মানসিকভাবে বুদ্ধিপ্রাপ্ত হতে সাহায্য করা। 

 এ ধরণের মাতৃত্ব যে কারও হতে পারে। শুধুমাত্র যে নারী সন্তান জন্ম দেবে, অপরিহার্যভাবে তার দ্বারাই হতে হবে তা নয়। এমন অনেক নারী আছেন যারা সন্তান জন্ম দিতে পারেন নি কিন্তু তারা চমৎকার মা। এমন অনেক নারীও আছেন যারা সন্তানের জন্ম দিলেও মা হিসেবে ভালো নন, এমনকি সহিংসও। 

যাই হোক, বেশিরভাগ নারীই মাতৃত্বকে তাদের নিয়তি হিসাবে দেখে থাকে। তবে তা বিকল্পের অভাব এবং মাতৃত্বের গৌরববোধ এই উভয় কারণেই। নারীরা তাদের ত্যাগ স্বীকার, কষ্ট স্বীকার এবং অন্যের জন্য বাঁচার যে ইচ্ছা সে কারণে প্রশংসিত হয়ে থাকে। এটি নারীর জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ হয়ে আছে। এই ধরণের গৌরব আরোপ হচ্ছে তেতো ঔষধের উপর চিনির প্রলেপ মেশানোর মতো। নারীরা বংশপরম্পরায় এই চিনির দানার মোহে পড়ে আছে এবং তারা এমন ভূমিকা পালন করেছে যা তাদেরকে অবরুদ্ধ করেছে, তাদের শ্বাসরোধ করেছে এবং তাদেরকে গতিহীন করেছে। 

নারীদের সন্তান দেখাশোনার জন্য বিশেষ অঙ্গ নেই বা এমন বিশেষ গ্রন্থিও নেই যা ভালোবাসা ও যত্ন উৎপাদন করে। 

যদি একজন নারী রাঁধতে পারে
তবে একজন পুরুষও তা পারবে
কারণ
নারী তার জরায়ুর সাহায্যে রান্না করে না!

সত্যিই যদি এ পৃথিবী মাতৃত্ব, ত্যাগ স্বীকার, অন্যের সেবা করা এবং অন্যের জন্য বেঁচে থাকতে সব কাজের মধ্যে সবচেয়ে মহৎ বলে গণ্য করতো (যদি এর জন্য তুমি নোবেল পুরস্কার পেতে) তবে পুরুষরা কখনও নারীদের এক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে কর্তৃত্ব করতে দিত না।

মাতৃত্বের প্রশংসা পুরুষরা ঠিকই করে, কিন্তু নিজেরা এর অনুশীলন করতে অনিচ্ছুক। 

বস্তুত অন্যের জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করাটা যদি সকল কাজের চেয়ে উৎকৃষ্ট হয়, তবে আমরা নারীরা নিঃস্বার্থভাবে পুরুষদেরকে মাতৃত্ব, অংশীদারিত্ব এবং যত্ন গ্রহণের সুযোগ দিতে পারি। 

মায়ের ক্ষমতা ও যোগ্যতা অপরিহার্যভাবে প্রাকৃতিক নয়, কাজেই শারীরিকভাবেও নির্ধারিত নয়। 

পুরুষরাও মা হতে পারেন এবং অনেক পুরুষ তা করেনও। মহাত্ম গান্ধী সম্ভবত বলেছিলেন যে, তিনি নিজেকে একজন ভালো মানবসন্তান হিসেবে তখনই মনে করবেন যখন তিনি মাতৃসুলভ গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন। আমাদের মতে, পুরুষতান্ত্রিক যে সকল নিকৃষ্টতম কাজ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, নারী ও পুরুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, আবেগময়তা ও যুক্তিশীলতার মাঝে অপ্রয়োজনীয় বিভেদ সৃষ্টি করা। পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদ পুরুষদের সন্তান লালন-পালন ও দেখাশোনার দায়িত্ব অস্বীকার করে। যার ফলে অধিকাংশ পুরুষ কঠোর, কর্কশ, অসংবেদনশীল এবং অযত্নশীল হয়ে পড়ে। 

অনেক নারীবাদীই এটা বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেকেই ভদ্র কিন্তু বলিষ্ঠ সেবাপরায়ণ, ত্যাগী, অনুভুতিপ্রবণ এবং যুক্তিবাদী হতে পারে এবং হওয়া উচিত। 

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন