নারীমুক্তি প্রসঙ্গে কেতকী  কুশারী ডাইসন 

Katoki-kushari
কেতকী কুশারী ডাইসন

মনে পড়ছে আমার ক্যানাডাবাসের কোনো এক সময়ে আমি আমার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটিকে মানুষ করা আর অন্যান্য গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করা ছাড়া ‘আপাতত আর কিছুই করছি না’ জেনে একটি বাঙালি যুবক অকপট বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের ধারে-কাছে কোনো দাসদাসীর উপস্থিতি যে ছিলো না তা তো বলাই বাহুল্য, উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে-দেশে আমার অথবা আমাদের সন্তানের পিতার কোনো আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন না। ফলে ঘরের কাজ আর নবজাতকের দেখাশোনা নিয়ে আমরা দুজনেই বেশ ব্যাস্ত ছিলাম। তার আগে আমি বিলেপ্তে সপ্তাহে তিনবার দৈনিক চার ঘন্টা ট্রেনে যাতায়াত করে চাকরি করতাম; আমার ধারণা ছিলো বিয়োবার জন্যে মেয়েরা কিছু অবকাশ নিতে পারে; হাজার হোক, প্রসূতির প্রসবোত্তর দূর্বলতা থেকে সেরা ওঠার ব্যাপারটা তো আছে, এবং আমার প্রথম প্রসব যথেষ্ট কঠিনই হয়েছিলো, কিন্তু সেসব বোধ করি ছিলো যুবকটির ধারণার বাইরে। আমি তাকে তখনই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, সংসার সামলানো আর ছেলে মানুষ করা বুঝি কোনো কাজের কাজ নয়? তিনি লজ্জা পেয়ে তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেছিলেন যে, হ্যা ওগুলোও মর্যাদাসম্পন্ন মনুষ্যকর্ম বটে। 

অবশ্য ক্যানাডায় থাকাকালীন আমি যে ‘আর কিছুই’ করিনি তাও ঠিক কথা নয়। কিছু কবিতা আর গ্রন্থসমালোচনা লিখেছিলাম (আমার ধারণা আর্জেন্টাই লেখক বর্হেস সম্পর্কে বাংলায় দু’চার কথা হয়তো বা আমিই প্রথম লিখি, এবং সেটা লিখেছিলাম ক্যানাডা থেকে); তাছাড়া স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের জন্য কিছু খাতা দেখেছিলাম এবং সাহিত্যের ব্যাপারে একেবারেই সংবেদনশূন্য একটি ছাত্রীকে কয়েকটি টিউটোরিয়ালও দিয়েছিলাম। বসন্তসমাগমে পুষ্পোদগম দেখে কবিদের চিত্ত যে পুলকিত হয়ে ওঠে এই সাধারণ তথ্যটাও মেয়েটির জানা ছিলো না, এবং বেশ মনে আছে তাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে ফুলটুল দেখিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর একটা চেষ্টা করেছিলাম।  

বাঙালি যুবকটির সঙ্গে কথাবার্তার এই অভিজ্ঞতাটির বিপরীত কোণে অবস্থিত স্বল্পকাল পরবর্তী আরেকটি অভিজ্ঞতা। তখন আমি জাতে উঠেছিঃ দু’টি বাচ্চা মানুষ করছি, একই সঙ্গে অক্সফোর্ডে একটি বৃহদায়তন স্নাতোকোত্তর গবেষণাও আরম্ভ করেছি। ( আমার বিয়ের পর আমার জননী ও শ্বশ্রুঠাকুরাণী দু’জনে দুই ভিন্ন দেশের, দু’টি ভিন্ন সমাজের মহিলা হওয়া সত্ত্বেও দিয়েছিলেন একই সদুপদেশঃ পতিদেবতার স্নাতকোত্তর গবেষণার কালে সন্তান উৎপাদন ক’রে আমি যেন তার সাধনার বিঘ্ন না করি। সুবোধ বালিকার ন্যায় সে-উপদেশ আমি গ্রহণ করেছিলাম ব’লে শেষ পর্যন্ত কোলে-কাখে দুটি বাচ্চা নিয়ে নাকানি-চোবানি খেতে খেতে স্নাতকোত্তর গবেষণা করতে হয়েছিলো আমাকেই)। 

ঐ অবস্থা আমার অক্সফোর্ডের কলেজের একটি সান্ধ্য ভোজে আমার আসন নির্দিষ্ট হয় ইংরেজি সাহিত্যের জাঁদরেল অধ্যাপিকা ডেইম হেলেন গার্ডনারের পাশে। তিনি আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়িকা ছিলেন না এবং আমার অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেনও না। যখন কথাক্রমে কিছুটা অবগত হলেন তখন বেশ বকুনি দিয়েই যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে এইঃ ‘তোমরা আজকালকার মেয়েরা দুটো আলাআ দুনিয়ার সুযোগসুবিধগুলো পেতে চাও, এ তোমাদের বড় দুঃসাহস। আমাদের সময়ে এত আদেখলাপনার সুযোগ ছিলো না। হয় বিবাহ ও সংসারধর্ম, নয় বহির্জগতের কর্মজীবনঃ এ দুটোর মধ্যে একটাকে আমাদের বেছে নিতে হতো। ও দুটো একসঙ্গে হয় না। যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হয়।’ সারাজীবন অবিবাহিতা থেকে হেলেন গার্ডনার অবলম্বন করেছিলেন দ্বিতীয় বিকল্পটিকেই এবং তার কর্মজীবনে এমনই দীপ্তির পরিচয় দিয়েছিলেন যে অবশেষে উপনীত হয়েছিলেন সরকার-প্রদত্ত ‘ডেইম’ খেতাবটিতে।  

পরে ঐ কলেজের তৎকালীন আরেক রত্নবিশেষ, —ইতিহাস বিভাগের রিসার্চ ফেলো, আমার চাইতে বয়সে খানিকটা বড়, তিন সন্তানের জননী, যিনি কিনা সংসারধর্ম এবং কেরিয়র দুই নৌকাতেই পা রেখে স্রোত অতিক্রম করছিলেন,— এ বিষয়ে আমাকে যা বলেছিলেন তার সারাংশ এইরকমঃ আসলে এই দুরুহ সমন্বয় যে কোনো নারীর একেবারে অসাধ্য তা নয়, কিন্তু এ কাজে সফল হতে হলে আরও কান্ডজ্ঞান থাকা চাই। আপনি বিয়ে করেছেন আপনার এক সমবয়সীকে, যিনি নিজে এখনো তার কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত নন। আমি বিএ করেছি আমার চাইতে দশ বছরের বড় চাকুরিজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন অধ্যাপককে। ফলে কতগুল সুবিধা পাই। যেমন বিবিধ গার্হস্থ্য গ্যাজেট, বাচ্চা ধরার জন্যে একজন সহায়িকা। আপনার উচিৎ ছিলো অর্থের বনিয়াদে সুদৃঢ় বয়োজ্যেষ্ঠ একজন পুরুষমানুষকে পাকড়াও করা।’ শুনে কিছুটা থাবড়ে গেছিলাম,— গোড়াতেই গলদ হয়ে গেছে?— কিন্তু যা-ই হোক, বেচারা সমবয়স্ক জীবনসঙ্গীকে তালাক দিইনি। স্বীকার করতে আপত্তি নেই, সে বেচারা আমার জন্যে জীবনে অনেক স্বার্থত্যাগ করেছে। 

এই যে পুস্তক সমালোচনার নাম ক’রে কেবল ব্যক্তিগত কথা ব’লে  যাচ্ছি, তার কারণ বর্তমান প্রসঙ্গে কথাগুলো একটিও অবান্তর নয়। উপরে যে-বইটির নাম দিয়েছি সেটি মেয়েদের জীবনের এই জাতীয় এবং সম্পৃক্ত নানান সমস্যা নিয়ে লেখা একটি সুচিন্তিত দার্শনিক বই। ফেমিনিজমের বিভিন্ন ইশুগুলি আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকের  জীবনকেই কম-বেশি স্পর্শ করে, এবং আরও অনেক কথাই আমাদের স্পষ্ট করে আলোচনা করা উচিৎ। লক্ষনীয় উপরে উল্লিখিত অক্সফোর্ডের দুই মহিলাই ( ডেইম হেলেন এবং মেরিলিন বাটলার) প্রধানত তাদের নিজেদের কেরিয়রের মতো অ্যাকাডেমিক কর্মজীবনের কথাই ভাবছিলেন। শ্রমজীবী শ্রেণির মেয়েরা কিন্তু বরাবরই ঘরে-বাইরে খেটেছে, তাদের জন্য মধ্যবিত্তদের তেমন মাথা ব্যাথা হয়নি। এবং এই সুযোগে বলি, আমি অনেকবারই ভেবেছি, আমি যে ঠিক কীভাবে স্নাতকোত্তর গবেষণা করেছিলাম তার খুটিনাটি দিয়েই একটি স্বতন্ত্র বই লেখা যায়। সে-সময়ে আমি আমার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে এমনই ব্যস্ত থাকতাম যে কোনো কোনোদিন রাতে শুতে যাবার আগে খেয়াল করতাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত্রিবাসের উপরে ড্রেসিং-গাউন জড়িয়ে নিয়ে যে অবস্থায় দিনের কাজ আরম্ভ করেছি দিনশেষেও সেই অবস্থাতেই আছি, সারা দিনেও বেশ বদলে শাড়ি পরে নেবার সময় হয়নি। সত্যি বলতে কি, সে সময়ে আমার সমস্ত দায়িত্বের মধ্যে গবেষণার কাজটাই ছিলো সব থেকে সহজ, কেননা যার রিসার্সে মন আছে তার কাছে রিসার্চ তো স্রেফ আনন্দ, প্রেমের শ্রম, অপরপক্ষে সন্তানপালন ও গৃহস্থালির খুঁটিনাটি আরও বিবিধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ গুণাবলী দাবি করেঃ তাতে কেবল কায়িক পরিশ্রম লাগে না, লাগে অনেক মানসিক গুণ, স্থৈর্য এবং ধৈর্য থেকে নিমেষের মধ্যে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, জীবননৈপুণ্য, সামগ্রিক ‘ম্যানেজমেন্ট’। 

নারীমুক্তি সপক্ষে নানান ধারনাই আজকাল পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন দেশে কম-বেশি চালু হয়েছে, — সম্প্রতি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে, বিশেষত মোল্লাতান্ত্রিক ইরানে,— কিন্তু সর্বত্রই এইসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও ভুলভ্রান্তি  প্রচুর। 

একটি সুপ্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা এই যে সাম্য মানে জ্যামিতিক সাম্যঃ পুরুষ যেমন, নারীকেও অবিকল তেমনি হতে হবে।  যেন তারা সম্পূর্ণরূপে সমানধর্মা দু’টি ত্রিভুজ। নারী যেখানে পুরুষের থেকে আলাদা, সেই এলাকাটাকে একেবারের ভাজ করে মুড়ে গোপন করে ফেলতে হবে। কোনো মেয়ে যদি প্রসবের পরের দিন সকালেই ক্ষেতে হাজিরা দিয়ে ট্র্যাক্টর চালাতে পারেন তবেই তিনি আধুনিকা। 

এই ধারণার জের টেনে কারও কারও চোখ ঘরের বাইরে চাকরি করা এবং তার জন্যে মাইনে পাওয়াটাই হচ্ছে মুক্তির লক্ষণ। মেয়েদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নটা-পাচটার চাকরি করতে হবে, নয়তো তারা মুক্ত নারী হতে পারবে না। চাকুরীজীবী মানসতার সঙ্গে অর্থনীতিশাসিত বিভিন্ন শৈলীর মার্কসবাদী জীবন-ভাষ্যের মিলিত বিচিত্র ককটেলের প্রভাবে ‘আধুনিক’ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে নারীমুক্তির প্রধান তাৎপর্য এইখানেইঃ চাকরি করায় আর মাইনে পাওয়ায়। যে-মেয়ে চাকরি করে না এবং মাইনে পায় না, তার জীবন অন্য নানা দিকে কর্মব্যস্ত, সমৃদ্ধ, পূর্ণ, সার্থক হলেও এই নব্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সে ফেল্‌ ফেল্‌ ফেল্‌। 

এই প্রতিন্যাসের আরেকটি রকমফেরে মা হওয়াই এখনও নারীজীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা বটে, কিন্তু তার একটি আধুনিক রূপ আছে। যেমন ধরা যাক, কোনো বাঙালি মেয়ে বাচ্চা নিয়ে বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্না হয়েছে। সে যদি ঘরের বাইরে রোজগার করে এবং ঘরের ভিতরে ঝি-চাকর রেখে তার বাচ্চাদের ভরণপোষণ করতে পারে, তা হলে আজকের দিনে তার কপালে বিস্তর প্রশংসা অবশ্যই জুটবে, —’এমন লক্ষ্মী মেয়ে বড় চোখে পড়ে না’ — কিন্তু যে সে বলবে, ‘এবারে আরেকটা বিয়ে করা যাক, কেননা কেবল বাচ্চাদের মানুষ করে আর চাকরি করে আমার চরিতার্থতা হচ্ছে না, আমার একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সঙ্গী লাগবে’, অমনি আধুনিক মা-মাসীরা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসবেন, কেননা ১. ঐতিহ্যিক রীতিতে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে ধরে এবং ২. আধুনিক রীতিতে চাকরি করে তার তো ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণভাবে মোক্ষলাভ হয়ে আছে, তার বাইরে অল্প কিছু আবার লক্ষ্মী মেয়েদের লাগে নাকি, ছিঃ?  

কোনো নারী সেই অন্যদের কথামতোন নৌকো না বেয়ে নিজের জীবনের কোনো ক্ষেত্রে স্বকীয় নির্বাচনকে, স্ব-তন্ত্রতাকে, আত্মবশতাকে খাটাতে যাবেন, তখনই তাকে নানাবিধ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাঁতরাতে হবে। নারীর মুক্তি কীভাবে সম্ভব এই বিষয়টিতে সংকীর্ণ একদেশদর্শী গৃহীত মত এবং রক্তচক্ষু অনুশাসনের অভাব নেই। 

মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের ‘উইমেন’স চয়েসেজঃ ফিলসফিকাল প্রবলেমস ফেসিং ফেমিনিজম বইয়ের প্রচ্ছদ

জ্যামিতিক সাম্যের আদর্শ মেয়েদের কিছু-কিছু ক্ষতি করেছে। সন্তানপালন এবং সংসারধর্মের গুরুদায়িত্বগুলি অনেকাংশে  তাদের প্রাক্তন মর্যাদাগুলি হারিয়েছে। যেন প্রত্যেকটি মেয়েকে কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত কর্মী করে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের পাশে একটি করে সরকারি ক্রেশ গড়ে দিলেই মেয়েদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মেয়েদের দেখেছেন, তা হয় না। কয়েক দশক ধরে মেয়েদের প্রতিবাদের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রেও এ ব্যাপারে নীতি পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে, নীড়রচনার এবং গার্হস্থ্য জীবনের, মাতৃত্বের এবং শৈশবের দাবিদাওয়া মেনে নেবার একটা চেষ্টা চলেছে। যারা পুঁজিবাদী-বাণিজ্যিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ফরিয়াদী তাদের এটাও বুঝতে হবে যে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের স্বার্থে নাগরিকদের প্রোডাকশন লাইনের বলিতে পর্যবসিত করতে পারে। 

তর্কের ডামাডোলে আজকাল প্রায়ই একটি কেন্দ্রিক প্রশ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছেঃ পরবর্তী প্রজন্মকে কারা গঠন করবে? কেবল দুধভাত খাওয়ানোর কথা ভাবছি না, কিংবা কেবল বর্ণমালা শেখানোর কথাও ভাবছি না, ভাবছি মানসিক গঠনের, চরিত্রগঠনের কথা। কারা শিশুদের ভালো-মন্দের ভেদ শেখাবে, তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসা-শুভবুদ্ধি-নীতিবোধকে জাগ্রত করবে, আধুনিক পৃথিবীর সমস্যাগুলি সম্পর্কে তাদের অবহিত করবে? এ সমস্ত পুরো দায়িত্বই কি অর্পিত হবে ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন-বিদ্যালয় ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি উপরে? বাপ-মায়েরা কি অংশগ্রহণ করবে না? না করাটা কি কাম্য? যদি করে, তো করবে কখন? রোববার বিকেলে? অথচ এই দায়িত্ব কি আজকের পৃথিবীতে আগের দিনের চাইতে সূক্ষ্মতর, জটিলতর, ক্রমাগত আড়ও বেশি দাবিদার হয়ে উঠছে না? এ কাজে আমরা যে পরিমাণে ফাকি দেবো সেই পরিমাণেই প্রজাতির ভবিষ্যতকেও কি সংকটাপন্ন করে তুলবো না? 

এ কাজ কেবল মেয়েরাই করবে এমন কথা বলা হচ্ছে না, পুরুষদেরও যে যোগ দিতে হবে সেই ইঙ্গিতই দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কর্মের একটা ক্ষেত্র, একটা মঞ্চ তো চাই। পারিবারিক নীড় নতুন ধরণের পিতাকে লালন করতে পারে; ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন পারে। তাই ফেমিনিজম কেবল মেয়েদের ইশু নয়, সকলের ইশু। এবং এর খুঁটিনাটি সকলেরই তলিয়ে দেখা উচিৎ, পর্যালোচনা করা উচিৎ। ঘড়ির কাটাকে প্রাক-ফেমিনিস্ট সময়ে আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। 

ফেমিনিজম আজকের আন্দোলন নয়। জন স্টুয়ার্ট মিল পৃথিবীর একজন উল্লেখযোগ্য ফেমিনিস্ট। এই চিন্তাধারা বর্তমান সময়ে কোন্‌ উপত্যকায় পৌছেছে, এই পৌছানোর তাৎপর্য কী, এখান থেকে পৃথিবীটাকে কেমন দেখাচ্ছে, এখন থেকে তাকে কী ধরণের জমি অতিক্রম করতে হবে, কী কী সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হতে হবেঃ এইসব বিষয়ে ভারসাম্যযুক্ত আলোচনা যারা পড়তে চান তাদের মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। এটি আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে লেখা একটি সুমিত, বুদ্ধিপ্রোজ্জ্বল, বিশ্লেষণধর্মী বই। এটি পড়লে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন তারা যারা উনিশ আর বিশ শ্তকের ফেমিনিস্ট চিন্তার বিভিন্ন শাখা-উপশাখাগুলিকে কিছুটা অনুধাবন করেছেন, তার এযাবৎ বিবর্তনের সঙ্গে কিয়দংশে পরিচিত। ফেমিনিস্ট চিন্তায় মার্কসবাদী বিশ্লেষণপদ্ধতি কতটা স্বার্থক হয়েছে, মার্কসবাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের চেহারা এখন থেকে কেমন হবে, সত্তরের দশকের ফেমিনিস্ট আন্দোলনের উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গগুলির পর এই মুহূর্তে কী জাতের মূল্যায়ন ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন, শ্রীমতি শুলামিথ ফায়ারস্টোনের (Shulamith Firestone, The Dialectic of Sex, 1970)। প্রবলভাবে মৌলিক প্রস্তাবসমূহের উত্তরাধিকারে আমরা শেষ পর্যন্ত কী পেলাম, ফেমিনিস্ট চিন্তায় চরমপন্থার কোনো অর্থ বা ভূমিকা থাকতে পারে কিনাঃ এই ধরণের নানান প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে। যুক্তিনিষ্ঠার সঙ্গে এখানে মিলিত হয়েছে মাত্রাজ্ঞান এবং একটি বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারার ক্ষমতা; নেই কোন আতিশায্য বা কচকচানি বা অহেতুক পারিভাষিক শব্দের আমদানি। আমার ব্যক্তিগত রুচির পক্ষে বইটির রচনা-শৈলী একটু বেশি সাদামাঠা, সমতল; স্টাইলটা আরও উচ্চাবচ, আলোছায়াভরা হলে আমি আড়ও উপভোগ করতাম। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে একটা সাহিত্য সমালোচনা ঘেষা হলো; আলোচ্য প্রসঙ্গে এ অভিযোগ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

লেখিকাদ্বয় চেষ্টা করেছেন নির্বাচনের বিভিন্ন মিথ্যা দ্বান্দ্বিকতা থেকে নারীর এবং সঙ্গে সঙ্গে  পুরুষের জীবনকেও উদ্ধার করতে। যে দ্বান্দ্বিকতাগুলির মুখোমুখি আমাদের বারে বারেই দাঁড় করানো হয় সেগুলি আবশ্যিক নয়, তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। আপাতবিচ্ছিন্নদের নৈকট্যসাধনই, আপাতবিপরীতদের সমন্বয়সাধনই মনুষ্যধর্ম, উভয় লিঙ্গের পক্ষে। 

সে সাধনায় উভয় লিঙ্গই  যাতে উত্তীর্ণ হতে পারে তার জন্যে উপযুক্ত নির্ভরস্বরূপ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়,  যদি নারী আর পুরুষ মিলিতভাবে চেষ্টা করে। তার জন্যে সর্বাগ্রে মুক্ত করতে হবে বুদ্ধিকে। বর্জন করতে হবে যোদ্ধৃসুলভ সেই চিন্তাভঙ্গিকে, যা জীবনের যাবতীয় জটিলতাকে সরলীকৃত করে নিয়ে প্রথমেই নির্দিষ্ট করে একটি শত্রুকে, তার পর তাকে বিনাশ করতে ঝাঁটার মতন এগিয়ে যায়, বিনা বাধায়, ‘ফরাসী-বিপ্লবী কায়দায়’। জীবনের সূক্ষ্ম সমস্যাগুলির সমাধান ওভাবে হয় না। তার জন্যে লাগে আর সংবেদন, আরও বহুমাত্রিক প্রতিন্যাস, সূক্ষ্মতর পরিকল্পনা এবং তার সযত্ন বাস্তবায়ন।  

জ্যামিতিক সাম্যের আদর্শের সীমাবদ্ধতাগুলি ধরিয়ে দিয়ে এরা দুজনে বলেনঃ দুই লিঙ্গের মধ্য কিছু কিছু পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু পার্থক্য মানে এ নয় যে একটি অপরটির থেকে নিকৃষ্ট। যেগুলি তথাকথিত ‘মেয়েদের কাজ’  সেগুলি কোনো বিচারেই তথাকথিত পুরুষদের কাজের থেকে গুরুত্বে হীন নয়। আজকের মেয়েরা কী কী কাজ করবে, কীভাবে করবে, কীভাবে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, এ সমস্তর মীমাংসা করতে হবে মেয়েদের জীবনেরই প্রয়োজন অনুসারে এবং সেই নীতি হবে লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের শ্রমকে এবং তার মূল্যায়নকে আরও মনুষ্যোচিত করে তোলার বৃহত্তর প্রচেষ্টারই অন্তর্গত, কেননা কর্মজীবনের যে-মডেলটা পুরুষরা এ যাবত গড়ে তুলেছেন সেটা কোনো নিখুঁত মডেল নয়। (এই শেষ উদ্ধৃতিটিতে থেকে লেখিকাদের নিচু গলায় কথা বলার স্টাইলটা আশা করি খানিকটা বোঝা যাবে) সংক্ষেপেঃ 

… once we stop being obsessed with the ideas of treating men and women exactly alike, the immediate aim for women will be to make it possible for them to pass in and out of the child-bearing phase of life without either penalizing children or grotesquely interrupting and distorting women’s useful careers. 

এখানে উল্লেখ করি যে প্রজনন প্রক্রিয়ার উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আজকাল এৎ দ্রুতগতিতে বাড়ছে যে সাধারণ মানুষ কেন, দার্শনিকরাও তার সঙ্গে তাল রাখতে পারছেন না। মিজলি ও হিউজের এই বইটি বার হবার পরে গত কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কিছু বৈপ্লবিক খবরই বেরিয়েছে।  কাচপাত্রে সফল গর্ভাধানের এবং সেভাবে আহহিত প্রাণের নিরাপদ মানবজন্মের খবর এখন আর নতুন নয়, কিন্তু কিছু দিন আগেই পড়লাম এই প্রক্রিয়ায় আরেক ধাপ অগ্রগতির কথা। কাচপাত্রে  আরদ্ধজীবন ভ্রুণকে হিমপেটিকায় রাখা হয়েছে, তার পর থেকে বার ক্রে তার হিমত্ব ঘুচিয়ে তাকে মাতৃজরায়ুতে ঢোকানো হয়েছে, এবং সেই শিশু সুস্থদেহে জন্মলাভ করেছে। হিমসংরক্ষিত ভ্রুণকে ডিম্বদাত্রী মাতার জরায়ুতে না ঢুকিয়ে অন্য নারীর জরায়ুতেও ঢোকানো যায়। মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে একজন মেয়ে অপর কোনো মেয়ের ডিম্বজাত ভ্রুণকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে পারে এবং যথাসময়ে সেই শিশুকে প্রসব করতে পারে। তেমন শিশু দুজন আ থাকবেঃ ডিম্বদাত্রী ‘জনয়িত্রী’ এবং গর্ভধারিনী প্রসূতি। বহু ভ্রুণ এখনই ত্রিশঙ্কুতুল্য অবস্থায় হিমপেটিকায় সুপ্তিমগ্ন এবং বিদ্যুতের সরবরাহে ঘাটতি না ঘটলে অনির্দিষ্টকাল ওভাবে থাকতে পারে। হয়তো আজকের ভ্রুণ জন্ম নেবে ভবিষ্যতের কোনো নারীর গর্ভে, যে নারী এখনো অজাতা। অর্থাৎ কিনা কোনো নারীর পক্ষে তার পিসীমাকে গর্ভে ধরা অসম্ভব হবে না। এইসব সম্ভাবনার তাৎপর্য ও পরিণাম নিশ্চয়ই যুগান্তকারী। এদিকে কাচপাত্রে আহিত প্রাণকে জরায়ুর বদলে কৃত্রিম কোনো আশ্রয়ে, টিস্যুর নীড়ে কত দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়, বর্ধিত করা যায়, তা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এইসব গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে সমাজপতিদের মাথাব্যাথাও বাড়ছে। কিন্তু গবেষণা পিছিয়ে নেই। 

সত্তরের দশকের গোড়ায় আমরা প্রথম যখন শুলামিথ ফায়ারস্টোনের ভবিষ্যৎ-কল্পনায় পড়েছিলাম যে ভবিষ্যতের শিশুরা নারীদেহের বাইরে জরায়ুর বিকল্প আশ্রয়ে লালিত হয়ে আমাদের অধুনা-পরিচিত জীবনের ছককে একেবারে পালটে দেবে, তখন সে চিন্তাকে ইউটোপিয়াই মনে হয়েছিলো অধিকাংশ পাঠকের; কিন্তু বস্তুত এখন অস্বীকার করা যায় না যে যদিও সেই ইউটোপিয়া এখনো পুরোপুরি এসে পৌছয়নি, তবু তার পদধ্বনি ক্রমশ এগিয়েই আসছে, পিছু হটে যাচ্ছে না। আজকের গরম-গরম ইশুগুলি তত দিনে ঠান্ডা  হয়ে যাবে, তখন মানুষের সামনে হাজির হবে কত নতুন নতুন ‘চয়েস’, কত নতুন ‘ডিলেমা’। 

[ নারীবাদের বিভিন্ন দার্শনিক দিক বিষয়ে প্রভাববিস্তারকারী বই মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের ‘উইমেন’স চয়েসেজঃ ফিলসফিকাল প্রবলেমস ফেসিং ফেমিনিজম’। বর্তমান প্রবন্ধ ক্লাসিক বইটির পর্যালোচনা। সেমসেম-এ ক্লাসিক বইয়ের পরিচিতি ও সমালোচনামূলক ধারাবাহিক রচনার ধারাবাহিক প্রকাশ প্রকল্পের অংশ হিসেবে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। বর্তমান লেখাটি নেওয়া হয়েছে তার ভাবনার ভাস্কর্য বইয়ের ১৯৮৭ সালের সংস্করণ থেকে। –সম্পাদক]

থেকে আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

আমাদের একে অপরকে কী দেয়ার আছে?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

ইউরোপে আসা হাজার হাজার শরণার্থী প্রত্যেকদিন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন—দেয়াল, বেড়া বা কাঁটাতারের মতন দৃশ্যমান বাধাই কেবল নয়, বরং তার চেয়েও সুগভীর এক প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এই প্রতিরোধের উৎস পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-আতঙ্ক।  

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন—ইস্তাম্বুল, প্যারিস ও অন্যান্য স্থানে ইসলামিক স্টেটের হামলা, আর সেইসাথে ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলনে নারীদের উপর গণ-আক্রমণ—এই অপরায়নের ভিত্তিকে জোরদার করে অপরের প্রতি এই অযৌক্তিক ভীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর আবার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের আগমন নিয়ে বিতর্ক, যে বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও ফুটে উঠেছে।   

বর্তমানে, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের জন্য দ্বার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন, তাদের জন্য এই প্রতিরোধের ফলাফল কি? এই প্রতিরোধ কি আদৌ ন্যায্য? নিজেদেরকে নীতিবান দাবী করতে চাইলে এই দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কি আমাদের আরোও বেশি কিছু করা উচিত? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর লেভিনাসের মতন সরাসরি খুব কম দার্শনিকই দিতে পেরেছেন।   

১৯০৬ সালে লিথুনিয়ার কাউনাসে একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লেভিনাস। ১৯২৩ সালে তিনি ফ্রান্সে যান এবং ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে এডমন্ড হুসার্ল এবং মার্টিন হাইডেগারের অধীনে জার্মানিতে দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে হুসার্ল ও হাইডেগারের লেখা অনুবাদ করে নিজেকে ফেনোমেনোলজির প্রথম সমর্থকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন লেভিনাস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সত্তার অর্থ অনুসন্ধানের মত দুর্বোধ্য বিষয়ের প্রতি ফেনোমেনোলজির উৎসাহ নিয়ে তার বোঝাপড়া পরিবর্তিত হয় এবং এ বিষয়ে তার আগ্রহ স্তিমিত হয়। লেভিনাসকে ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালে নাৎসিরা তাকে বন্দী করে। অফিসার হওয়ার সুবাদে তাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে না পাঠানো হলেও, তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। যুদ্ধের পর, লেভিনাস সবসময়ই মানুষের মধ্যে নৈতিক সম্পর্কের, অর্থাৎ অন্যদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য কাজ করার ক্ষমতার, সুনির্দিষ্ট উৎস বর্ণনা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

লেভিনাসের আদারওয়াইজ দ্যান বিইং-এর এপিগ্রাফে লেখা আছে: ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের (নাৎসি বাহিনী) হাতে খুন হওয়া ষাট লক্ষের মধ্যে যারা সবচেয়ে আপন ছিলেন, এবং আরো কোটি কোটি মানুষ—সব ধর্মের, সব জাতির—যারা সেই একই ঘৃণার শিকার হয়েছেন, একই ইহুদি-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন—তাদের সবার স্মরণে’। বইটি অপরায়নের  এসেন্স সম্পর্কে  গভীর মননশীলতার ফলাফল।  

একইসাথে বইটা সবিস্তারে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তার কথা বলে, যা আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এছাড়া, লেভিনাসের অন্যান্য রচনাও আমাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। 

জাতীয়তাবাদ হলো চিহ্নিতকরণ ও পার্থক্যকরণের ফল, যা নিজেদের এবং অন্যদের মধ্যে দেখা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত হয়। একজন আমেরিকান হিসেবে আপনি অন্যান্য অনেক আমেরিকানদের মতন একটা শৈশবই পেয়েছেন। আপনার ছোটবেলাটা সে হিসেবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ বা ইতালীয়দের থেকে আলাদা।  ফলে, আমেরিকানদের সাথে আপনার যে মিলগুলো আপনি পান, সেগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে, এবং সেই বৈশিষ্টগুলোর সাথে অন্যান্য দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য খুঁজে বের করার মাধ্যমেই অনেকাংশে আপনি আপনার নিজের পরিচয় গঠন করেন। কিন্তু, ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, পরিচয় গঠনের এরূপ প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে গেলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। 

যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা ‘একই’ এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করি, তার মধ্যেই লেভিনাস জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজে পান। আর এই চিহ্নিতকরন ও পার্থক্যকরণ যদিও আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করে, এই প্রক্রিয়াটা ভয়ংকর বৈরিতায়ও রূপ নিতে পারে। এ বিপদ ঘটে তখন, যখন, যেই বৈশিষ্টগুলোর মিল বা অমিলের ভিত্তিতে আমরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করি, সেই বৈশিষ্টগুলোকে আমরা সর্বজনীন পরম সত্য হিসেবে ধারণা করি। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পরম সত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অবস্থাটাকে যখন একটি গোষ্ঠীর কিছু সদস্যের একটি বৈশিষ্ট্যকে সেই গোষ্ঠীর সকলের সর্বকালীন বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনটা হয় যখন কিছু প্রচলিত ধারণা যেমন ‘আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ’, ‘ব্রিটিশরা গম্ভীর’ এবং ‘ইতালীয়রা আবেগপ্রবণ’ একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা ইতালীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।  ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যে, এই প্রচলিত ধারণাগুলো যখন নেতিবাচক হয়, যেমন, ‘ইহুদিরা লোভী’, ‘কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক’, বা ‘মুসলিমরা সন্ত্রাসী’, তখন এগুলো এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আক্রমণ ও বৈরিতার পেছনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এখানে দেয়া প্রতিটি উদাহারণেই, যারা ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’, তারা একটা বৈশিষ্ট্যের বাক্সে বন্দী হচ্ছে যা ‘তাদেরকে’ ‘আমাদের’ থেকে একেবারে ভিন্ন করে তুলছে। মানুষকে কিছু প্রচলিত ধারণার বাক্সে বন্দী করার এই অভ্যাস বেশিরভাগ সময়ই ‘অন্য’দের প্রতি এক অসহনীয়তার জন্ম দেয় যার উদাহারণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই ইউরোপের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করার এক প্রবণতা, যা আফগান, ইরাকি এবং সিরিয়ান শরণার্থীদের ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।    

আমাদের এই অসহনীয়তার দাওয়াই হিসেবে লেভিনাস তিনটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন:
১. মানুষের মধ্যকার অসীমতার প্রতি আবেদন,
২. মানুষের সাথে মানুষের মুখোমুখি সাক্ষাত এবং
৩.সেই স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা যা মানবতাকে ধারণ করে।   

অসীমতা বলতে লেভিনাস বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষ সবসময়ই যেকোন শ্রেণীভিত্তিক বাক্সের চাইতে অনেক বেশি কিছু। আপনি মিডল্যান্ড থেকে আসা একজন ব্রিটিশ অ্যাংলিকান হতে পারেন, কিন্তু আপনি কেবল তা-ই নন। আপনি কারোর বাবা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। আপনার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামী আর আপনার দাড়ি হাল্কা পেকে যাচ্ছে। আপনার রাজনৈতিক মতামত আছে, বিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস আছে ইত্যাদি। একইভাবে, একজন সিরিয়ান অভিবাসী হয়তো মুসলিম, কিন্তু তিনি কেবল তা-ই নন। তিনি আরো অনেক কিছু! তিনি কারোর মা, কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী। তার চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ বাদামি—তার চোয়াল ধারালো! তার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক মতামত আছে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো তা নিয়ে আছে বিতর্কিত বিশ্বাস ইত্যাদি। 

মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো
প্রতীকী ছবি

মানুষের মধ্যের এই অসীমতার দিকে নজর এনে লেভিনাস আমাদেরকে দেখাতে চাচ্ছিলেন যে আমরা চিহ্নিতকরণ এবং পার্থক্যকরণের মাধ্যমে কখনোই অন্যদের পরিপূর্ণ কোন পরিচয় গঠন করতে পারিনা। মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতার দিকে আলোকপাত করার মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী-আতংকের প্রবৃত্তি এবং মানুষকে বাক্সে আটকে রাখার প্রবণতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দিতে চান লেভিনাস। 

অন্য মানুষের মনুষ্যত্বের অসীমতা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তাদের চেহারায়। মানুষের মুখ তাদেরকে বাক্সে বন্দি হতে দিতে নারাজ। লেভিনাস মানুষের অসীমতার কথা বলতে গিয়ে মানুষের চেহারায় ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা বলেন। এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন যে মানুষের মুখ মানুষের আরেকটি দিকও প্রকাশ করে- নাজুকতা। মুখের কোন রাখঢাক নেই, মুখ উন্মুক্ত—আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে যেকোন সময়। মুখ সুরক্ষা খোঁজে, খোঁজে যত্ন। লেভিনাস অপরিচিত, বিধবা এবং এতিমকে বঞ্চিতদের উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। আমরা এর সাথে সাথে আশ্রয়প্রার্থী এবং সংকটাপন্ন নির্বাসিতদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে পারি চূড়ান্ত বঞ্চিতদের তালিকায়। তবে, নাজুকতা সম্পর্কে লেভিনাসের বিশ্লেষণ আমাদেরকে দেখায় যে তার মতে, অন্যের প্রয়োজনের সময় আতিথেয়তা প্রদান করা কেবল ব্যক্তিত্ব বিকাশেই সহায়তা করে না, বরং মানবতার এমন এক রূপ প্রকাশ করে যা সকল জাতি, ধর্ম, দেশের সীমানার উর্ধ্বে। 

লেভিনাসের মতে, আতিথেয়তা অর্থ অন্যের চাহিদার মুখে নিজের ভোগ কমিয়ে আনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে আমাদের বাসায় স্বাগত জানিয়ে তার সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়া। অন্যদেরকে স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সাথে আমাদের যা আছে তা ভাগাভাগি করে নেয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় আমরা মানুষ হিসেবে কেমন। একটা ব্যক্তিনিষ্ঠতার আলোচনায় লেভিনাস এই ধারণাটা প্রকাশ করেন, যে আলোচনায় নিজ সত্তাকে বর্ণনা করা হয় একইসাথে হোস্ট এবং জিম্মি হিসেবে। আমরা অন্যদের জন্য হোস্ট, কারণ অন্যদেরকে আমাদের জগতে স্বাগত জানানো তাদের সাপেক্ষে আমাদের নিজেদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকরণের পূর্বশর্ত। এবং আমরা জিম্মি, কারণ অন্যরা আমাদের কাছে যে দাবি করে, সে দাবির প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ধারিত হয়।  

যেমন, আপনার পরিচয় হলো আপনি একজন ইতালীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার এই পরিচয় গঠিত হয়েছে অন্যদের শিক্ষার চাহিদাকে স্বীকার করে, সেই চাহিদার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়ার ফলে। একইভাবে, ধরে নেই একজন সিরিয়ান লোকের কথা যে শরণার্থী পাচারকারী হিসেবে পরিচিত। তার এই পরিচিতি হয়তো একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিরাপদে সমুদ্র পারাপারের চাহিদাকে স্বীকার করে সেই চাহিদার প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।  উদাহারনগুলো আমাদেরকে দেখায় যে মানবসমাজের যেকোন জায়গায় আমাদের স্থানের ভিত্তিই হলো অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর এবং চাহিদার পূরণ করার সক্ষমতা। লেভিনাস আমাদেরকে আরো দেখান যে আতিথেয়তা কেবল নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের পরিচয় নির্ধারণেই ভূমিকা রাখেনা, বরং এটা মানবতার প্রতীকও।  এ হিসেবে, আতিথেয়তা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি।   

বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পূর্বশর্তই হলো অন্যদেরকে স্বাগতম জানানো।  তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার সক্ষমতা। টোটালিটি অ্যান্ড ইনফিনিটি-তে লেভিনাস লিখেছিলেন, ‘অপরের সত্তাকে স্বীকার করার অর্থ হলো হলো ব্যক্তিমালিকানার এই দুনিয়ায় অন্যের দিকে এগিয়ে আসা এবং  উপহার প্রদানের মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’  

অন্যের চাহিদা যখন আমাদের পার্থিব আমোদ-প্রমোদে বাধ সাধে, তখন আতিথেয়তা আমাদেরকে দিতে শেখায়, ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। এছাড়া আতিথেয়তার মাধ্যমে তৈরি হয় এক নতুন ভাষা, যা আতিথেয়তা প্রদানকারী এবং গ্রহণকারী দুইজনেরই ভাষা। এভাবে আতিথেয়তা বন্ধুত্বপূর্ণ মানবসমাজ সৃষ্টি করে। লেভিনাস লিখেছেন যে, ভাষা সর্বজনীন কারন ভাষা একক ব্যক্তি থেকে সর্বসাধারণের কাছে যাওয়ার মাধ্যম—অর্থাৎ, যা আমার, তা অন্যকে দেয়ার মাধ্যম হলো ভাষা। আমরা যখন কথা বলি, আমরা পৃথিবীকে জনসাধারণের করে তুলি। ভাষা কেবল কিছু বিমূর্ত ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করেনা, বরং ভাষা এ সকল ধারণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছেড়ে দেয়—জনসাধারণের বোঝাপড়ার একটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। এটা উপভোগের অবিচ্ছেদ্য এক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে।   

আলোচনার জগত আর একজনের মধ্যে আটকে থাকে না—কেবল আমি আর আমার সংস্পর্শে আসা সব চিন্তা-ভাবনা, ধারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা এই জগত; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমার অবদানটুকুও—এ জগত হয়ে ওঠে যোগাযোগের জগত, চিন্তাভাবনার জগত, সর্বজনীন জগত।  

সবার ব্যবহার্য একটি ভাষা তৈরি করা অবশ্যই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি। কিন্তু এর পাশাপাশি, ভাষা আমাদেরকে অন্যদের চিহ্নিত করার এবং একইসাথে নিজেদেরকে তাদের থেকে আলাদা করার সুযোগও দেয়। এর ফল হিসেবেই দেখা যায় যে কেবল একটা অভাবগ্রস্ত মুখ না দেখে আমরা দেখি একটা ‘সিরিয়ান’ মুখ বা ‘মুসলিম’ মুখ। একটা মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি এই ‘অন্য’দের প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে—যেখানে যেকোন মুখোমুখি সাক্ষাৎ অন্য কারোর মুখ দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।  অর্থাৎ, আমাদেরকে বলা হয় অন্য সকল মানুষের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগ করে নিতে। লেভিনাস এই অনুরোধকে একইসাথে খুব জরুরি কিন্তু অসম্ভব একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখেন, কারণ আমাদের যা আছে তা আমরা যে কাউকে দিতে পারলেও সবাইকে দেয়ার মতন পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ আমাদের নেই। আমরা এই অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি হলে,  তখন আমাদের ন্যায়বিচার প্রয়োজন হয়: সকল মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সম্পদের বণ্টন। আবার এই পর্যায়ে আমরা সেই অপরিবর্তনশীল পরিচয় আর দৃশ্যমান সীমারেখা নিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কাছেই চলে আসি—যেখান থেকেই আলাপের শুরু হয়েছিল।     

যদিও মনে হচ্ছে যে আমরা ঘুরেফিরে সেই একই আলাপে এসে পৌঁছেছি, লেভিনাস আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বই মানব সম্প্রদায়ের ভিত্তি, আর একটা অর্থবহ পৃথিবীতে বসবাস করা কেবলমাত্র অন্যদের জন্য নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমেই সম্ভব। যেহেতু আমাদের ঘরে অন্যদের স্বাগত জানানো এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়াই  সেই ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, নিপীড়িত বা বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের সামনে কোনভাবেই কোন আতিথেয়তাহীন জাতীয়তাবাদকে নিরন্তর সমর্থন করা যাবেনা। ‘একই’ এবং ‘অন্য’-এর সম্পর্কের মধ্যে আমার ‘অন্য’কে স্বাগত জানানোটাই’, লেভিনাস বলেন, ‘চূড়ান্ত সত্য’। এটাই মানবতার আতিথেয়তা—বা, সব শত্রুতার আগে বিদ্যমান এক শান্তি। আর এই আদি শান্তিতে, শরণার্থীদের প্রতি খুব স্বতঃস্ফূর্ত এই আতিথেয়তার মাঝে, যেমনটা লেভিনাস মনে করিয়ে দেন, ‘কোনকিছুই কোনো একজনের দ্বারা নির্মিত হয়না, বরং, সবকিছুই মানুষের সামষ্টিক অবদানের প্রতিফলন।’   

ওয়েবসাইট এক্সেস করতে প্রবেশ অথবা রেজিস্টার বাটন এ ক্লিক দিন